বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
আমরা ওয়াজ করি এবং শুনতে যাই। সেখানে বিশেষ কতগুলো দিক নিয়ে আলোচনা হয়। যেমন- মাদরাসার ওয়াজ মাহফিলে দান-খয়রাতের কথা বেশি বেশি বলা হয়। পীর সাহেবগণ তাঁদের মাহফিলে লতিফা, কলব, নফস, ইবাদতের প্রতি বেশি জোর দেন। আমি বলি না এগুলোর প্রয়োজন নেই। যথেষ্ট প্রয়োজন আছে। কিন্তু মানুষের দৈনন্দিন সমস্যাগুলোর সমাধান নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার, যাতে মানুষ বুঝতে পারে, এই আধুনিক বিশে^ চলতে হলে তাকে কী করতে হবে, আর এগুলো কোরআন-হাদিসে আছে কি না। মানুষ যদি বুঝতে পারে যে, কোরআন-হাদিসে আধুনিক বিশে^র সাথে তাল মিলিয়ে চলার সমস্ত উপকরণই আছে এবং বিশে^র আধুনিক সভ্য জাতিগুলো যে কাজগুলো করে সভ্যতার উচ্চ শিখরে আরোহণ করেছে, এর সবগুলোই ইসলাম থেকে ধার করে নেয়া, তাহলে প্রতিটি মানুষের মনেই ইসলামের প্রতি মহব্বত উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকবে। কোরআন-হাদিস শিক্ষা করার প্রতি মানুষের আগ্রহ বেড়ে যাবে।
আজ একটি হাদিস নিয়ে আলোচনা করব। হাদিসটি বোখারী শরীফের দ্বিতীয় খন্ডের ৬২৩ নং পৃষ্ঠার ‘কিতাবুল মাগাজী’তে বর্ণিত আছে : রাসূল (সা.) হযরত মুয়াজ এবনে জাবাল (রা.)-কে ইয়েমেন দেশে বিশেষ দূত ও গভর্নর হিসেবে প্রেরণ করেন। সেখানে যে বিষয়গুলো তাঁকে অনুসরণ করতে হবে সে বিষয়গুলো তাঁকে তিনি সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেন।
মহানবী (সা.) হযরত মুয়াজ (রা.)-কে বলেন, তুমি যে দেশে যাচ্ছ সেখানে মুসলমানের সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য। সেখানে আছে আহলে কিতাব। আহলে কিতাব অর্থ যারা পবিত্র কোরআন ছাড়া অন্যান্য কিতাব অর্থাৎ জবুর, তাওরাত, ইঞ্জিলের অনুসারী। প্রথমে তুমি তাদেরকে ইসলাম অর্থাৎ কালিমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’-এর দাওয়াত দেবে। যদি তারা তোমার দাওয়াত গ্রহণ করে তাহলে তুমি বলবে যে, তুমি যে আল্লাহর ‘অহদানিয়্যাতে’র স্বীকৃতি দিয়েছ, সে আল্লাহ তোমার ওপর দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছেন। তোমাকে এই নামাজ আদায় করতে হবে। নামাজ কারও জন্য মাফ নেই। প্রতিটি বালেগ-আলেক নর-নারীকেই নামাজ পড়তে হবে।
মহানবী (সা.) বলেছেন, নামাজ হল বেহেশতের চাবি। বেহেশতে যেতে হলে চাবি সঙ্গে নিতেই হবে। অন্যথায় বেহেশতের দরজা খোলা যাবে না। প্রবেশও করা যাবে না। কিছু কিছু ভন্ড বলে, আমরা মারেফাতপন্থী। আমাদের নামাজের প্রয়োজন নেই। আমরা বাতেনি নামাজ পড়ি। আসলে বাতেনি নামাজ পড়ার কোনো পদ্ধতি ইসলামে নেই। রাসূলে পাক (সা.) থেকে নিয়ে সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে-তাবেয়ীন, পীর-মাশায়েখ, ছলফে ছালেহীন, আয়িম্মায়ে মুজতাহেদীন, আলেম-ওলামা কেউ কি এই বাতেনি নামাজ পড়েছেন বা এর পক্ষে কোনো ফতওয়া দিয়েছেন? দেননি। কারণ বাতেনি নামাজ বলে কোনো কিছু নেই। কেউ যদি বলে, তাহলে ধরে নিতে হবে যে, সে ইসলামের শত্রু। আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনের ৮২ জায়গায় এবং রাসূল (সা.) অসংখ্য হাদিসে আমাদের তাকিদ করেছেন। এমনকি ইন্তেকালের সময়, যখন তিনি কথা ঠিকভাবে বলতে পারছিলেন না, তখনও অস্পষ্ট স্বরে ‘সালাত, সালাত’ বলছিলেন।
আল্লাহ তা’আলা তাঁর মাহবুব মহানবী (সা.)-কে পর্যন্ত নামাজ পড়া থেকে রেহাই দেননি। এমনকি রাতে একটু আরাম করবেন, তখনও আল্লাহ পাক তাঁর ফেরেশতা জিব্রাইল (আ.)-কে পাঠিয়ে ওহী মারফত জানিয়ে দেন যে, ‘হে বস্ত্রাবৃত! রাতে দন্ডায়মান হন, কিছু অংশ বাদ দিয়ে। অর্ধরাত অথবা তদপেক্ষা কিছু কম অথবা তদপেক্ষা বেশি এবং কোরআন আবৃত্তি করুন সুবিন্যস্তভাবে ও স্পষ্টভাবে।’ (সূরা : মুযযাম্মিল, আয়াত : ১-৪)। কাজেই নামাজ প্রত্যেককেই পড়তে হবে। এ থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো উপায় নেই।
হযরত মুয়াজ (রা.)-কে রাসূল (সা.) বলেন, তুমি তাদেরকে দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের দাওয়াত দেবে। এই দাওয়ারতটিও যদি তারা গ্রহণ করে তাহলে তাদের প্রতি তিন নম্বর নির্দেশ দেবে। এখানে উল্লেখ্য, প্রথম দু’টি দাওয়াতের সাথে কিন্তু কোনো অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। নামাজ পড়তে এবং কালিমা পাঠ করতে হলে কোনো টাকা-পয়সা খরচ করতে হয় না। কাউকে কিছু দিতেও হয় না।
কিন্তু এবার যে নির্দেশটা দিলেন, তা হলো, সম্পদের মায়া ত্যাগ করতে হবে। মাল খরচ করতে হবে। এটি কিন্তু ধনীদের বেলায়। এই নির্দেশের লক্ষ্য হলো, গরিবদের সহায়তা করা। কেউ তে’তলায় থাকবে, আবার কেউ না খেয়ে থাকবে, তা হতে পারে না। ইসলাম তা স্বীকার করে না। এই গরিবদের বেঁচে থাকার অধিকার আছে। তাই মহানবী (সা.) হযরত মুয়াজ (রা.)-কে নির্দেশ দিয়ে দিলেন; তুমি ঐ এলাকার ধনী লোকদের নিকট থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ জাকাত হিসেবে আদায় করবে এবং তা আবার গরিবদের মধ্যে বিতরণ করে দেবে।
মহানবী (সা.) তাঁর সাম্রাজ্যে এমন একটা অর্থনৈতিক ফর্মুলা দিলেন, যা প্রয়োগ করলে সে সাম্রাজ্যে কোনো গরিব থাকবে না। আজ আমদের সমাজে এত অন্যায়, অনাচার, ছিনতাই, রাহাজানি, চুরি, ডাকাতি, ঘুষ, দুর্নীতি- সবকিছুর মূলে হলো দারিদ্র্য। মহানবী (সা.)-এর এই ফর্মুলা প্রয়োগের মাধ্যমে আরব তথা ইসলামী সাম্রাজ্যে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে, ধনীরা জাকাতের মাল নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াত; কিন্তু যাকাত গ্রহণ করার মতো মানুষ খুঁজে পেত না।
- (আলহাজ¦ মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ:)-এর রচনাবলী হতে সংগৃহীত)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।