Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রবৃদ্ধির হিসাব বাস্তবতা বিবর্জিত -সিপিডি

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৩ নভেম্বর, ২০১৯, ৭:০৩ পিএম

দেশের ব্যাংকিংখাত চরম দুর্দশায়। শেয়াবাজারে চলছে সংকট। প্রতিনিয়ত কমছে রাজস্ব আদায়। বৈদেশিক বাণিজ্যেও কালোমেঘ। সরকারি অর্থের অপচয় হচ্ছে ব্যাপকহারে। খেলাপিদের কাছে যে পরিমান টাকা আটকে আছে তা দিয়ে তিনটি পদ্মাসেতু তৈরি করা যাবে। শেয়ারবাজারে অর্থ হাতিয়ে নিতে আবার দুষ্টচক্র প্রবেশ করেছে। এই সংকটের মধ্যেও দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হুহু করে বাড়ছে। প্রবৃদ্ধির এই হিসাব বাস্তবতা বিবর্জিত এক পরাবাস্তব উপাখ্যান। প্রকৃত উন্নয়নের জন্য অর্থনীতিতে সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু রাজনৈতিক অর্থনীতির দুষ্টচক্রের কারণে সংস্কার করা সম্ভব হচ্ছে না।

রোববার (৩ নভেম্বর) বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) চলতি অর্থবছরের প্রথম তিনমাসের প্রারম্ভিক পর্যালোচনা নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে এসব মন্তব্য করেছে। সংবাদ সম্মেলনের সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, প্রবৃদ্ধি এখন সুতা কাটা ঘুড়ির মতো। বাস্তবতার সঙ্গে সুতার যে সংযোগ থাকে সেটা এখানে নেই। প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক উন্নয়নের যে উপাখ্যান তৈরি হয়েছে তা অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, জিডিপিতে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ ২৩ শতাংশে রয়েছে। অথচ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ থেকে ৬ এবং ৭ ছাড়িয়ে ৮ শতাংশে গেছে। বাড়তি ব্যক্তিগত বিনিয়োগ ব্যতিরেকে জিডিপি প্রবৃদ্ধির উৎস কী - এতে আমরা চিন্তিত। বেসরকারি খাতে ঋণ সর্বকালের মধ্যে কম, ব্যাংকের তারল্যের সংকট, ব্যাংক টাকা ফেরত পাচ্ছে না, শেয়ারবাজারে সংকট অথচ প্রবৃদ্ধি বাড়ছে। যারা যে তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে প্রবৃদ্ধি নিরুপন করেছেন তারা প্রকাশ্যে এসে এর ব্যাখা দেন। প্রবৃদ্ধির তথ্যভিত্তিক প্রমাণ সামনে এলে তখন আলোচনা করা যাবে দেশের উন্নতি কতটুকু হয়েছে। প্রবৃদ্ধির উন্নয়নমূলক উপাখ্যান তা দেশের অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়নের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। এতে করে পরাবাস্তব পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে।

ড. দেবপ্রিয় বলেন, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় গতিশীলতা, সংযুক্তি ও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এককেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনা চলছে। সরকার রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগভিত্তিক সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনা তৈরি করেছে। রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ও অবকাঠামো বিনিয়োগের সঙ্গে ব্যক্তিবিনিয়োগ, রাজস্ব নীতি ও বাণিজ্য নীতির সম্পর্ক দুবল। নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে অর্থমন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বের অভাব রয়েছে। নীতি নির্ধারণ করা হচ্ছে অ্যাডহক ভিত্তিতে। বিচার বিশ্লেষণ না করে প্রভাবিত হয়ে তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। এসব নীতি সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীকরণ হচ্ছে। মন্ত্রণালয় বা তার চেয়ে বড় জায়গা থেকে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। এরফলে অর্থনীতিতে অস্বীকৃতির মনোভাব সৃষ্টি উঠছে। সাধারণভাবে অ্যাখ্যান দাড় করানো হচ্ছে যার সঙ্গে প্রকৃত পরিস্থিতির মিল নেই।

তিনি বলেন, ক্যাসিনোতে করফাঁকি, ব্যাংকের টাকা ফেরত না দেওয়ার অর্থ ও বিদেশে পাচারের অর্থ উদ্ধার হচ্ছে। সরকারি প্রকল্পের ১০ টাকার জিনিস হাজার টাকায় কেনায় হচ্ছে। এগুলো ফৌজদারি প্রক্রিয়ায় বন্ধ করা যাবেনা। এরজন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক সংস্কার। কিন্তু সরকার সে পথে না হেটে সংস্কারের পরিবর্তে প্রণোদনা চালু করেছে। রেমিটেন্স ও রপ্তানি প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এই প্রণোদনা দেওয়ার ক্ষমতা ফুরিয়ে আসছে। রাজস্ব আদায় কমে যাচ্ছে। এখন অর্থনীতিতে প্রণোদনার যে আসক্তি তৈরি হয়েছে তা বন্ধ করতে হবে।

ড. দেবপ্রিয় বলেন, সরকার নির্বাচনী ইশতেহার যে প্রতিশ্রুত দিয়েছিল গত ৩মাসে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ চোখে পড়েনি। রাজনৈতিক অর্থনীতির কারণে সংস্কার না হলে যারা সুবিধাভোগী সেই সুবিধাভোগী শ্রেণী সংস্কারের বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক সংস্কার দরকার স্বচ্ছতা জবাবদিহীতা বৃদ্ধি করতে হবে। এটি না করলে অর্থনীতির ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাবে। প্রবৃদ্ধির গতি হঠাৎ পড়ে যাবে। বৈষম্য ও অসাম্য বৃদ্দি পাবে। এ জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। কারণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না হলে কোন সংস্কার করা সম্ভব হবে না।

তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া ক্রমান্বয়ে দুস্কর হয়ে পড়েছে। যেটা পাওয়া যায় সেটার সঙ্গে বর্তমানের সঙ্গে সঙ্গতিপূণ নয় এবং নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এই তথ্যের অভাব সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ সরকার এবং নীতি নির্ধারকেরা। এতে বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়না। নীতি সংস্কার পিছিয়ে পড়ছে।

ব্যাংকিং খাত নিয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদ খাতুন বলেন, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত হিসেবে খেলাপি ঋণের পরিমান ১ লাখ ২০ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে ৩টি পদ্মাব্রিজ, তিনটি বড় রেলসেতু, মাতারবাড়ির মত বড় ৩টি পাওয়ারপ্লান্ট, ৫টি মেট্রোরেল, ৬টি রেললাইন ও রামপালের মতো ৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা যাবে। গত আট বছরে সরকারি ব্যাংকগুলোতে যে পরিমান মূলধন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা দিয়ে ৭টি পায়রা বন্দর নির্মান করা যাবে। তিনি বলেন, ব্যাংকখাতে মূলত ৭টি সমস্যা। সর্বকালে সবচেয়ে কম ঋণ বৃদ্ধি, তারল্য সংকট, নয়-ছয় সুদহার কার্যকর, খেলাপি ঋণ, গণহারে পুনঃতফসিল ও অবলোপন, মূলধন ঘাটতি ও মূলধন যোগান। ব্যাংক খাতের সংকট সরকারি ব্যাংক থেকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।

বৈদেশিক খাত নিয়ে প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গত দশবছরের মধ্যে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে রপ্তানি আয় কমেছে। পণ্য ও বাজারের কেন্দ্রীকরণ ঘটছে। বছর দুয়েক আগে প্রতিবছর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। কিন্তু বর্তমানে রিজার্ভ ৩১ থেকে ৩২ বিলিয়ন ডলারে উঠানামা করছে। একসময় ৮ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোরমত রিজার্ভ ছিল কিন্তু এখন রয়েছে মাত্র সাড়ে চার মাস। তিন মাসে নেমে এলে তা আশঙ্কাজনক। বৈদেশিক বাণিজ্যে স্বস্তিদায়ক অবস্থা থেকে সরে আসছে। প্রতিযোগী দেশগুলো রপ্তানি বাণিজ্যে টিকে থাকতে নিজেদের মুদ্রার অবমূল্যায়ণ করছে। বাংলাদেশকেও এটি করতে হবে।

শেয়ারবাজার প্রসঙ্গে সিপিডির গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পুঁজিবাজারে দুষ্টচক্রের আনাগোনা বেড়েছে। এরফলেই ক্রমাগতভাবে পতন হচ্ছে সূচকের। দুর্বল আইপিও, অস্বচ্ছ বার্ষিক প্রতিবেদন, বিও অ্যাকাউন্টের অপর্যাপ্ত স্বচ্ছতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের প্রশ্নবিদ্ধ কার্যক্রম অস্থিতিশীল করে তুলেছে পুঁজিবাজারকে। বাজারে কোন আর্থিক সংকট নেই। মূল সমস্যা সুশাসন, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতার অভাব। তিনি বলেন, বাজারে ২৭ লাখ বিও অ্যাকাউন্টের তথ্য উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মোট বিও একাউন্টের সংখ্যা ৬৬ লাখের অধিক। নতুন নতুন একাউন্টের মাধ্যমে পুঁজিবাজার থেকে তুলে নেওয়া হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এই সমস্যা সমাধানে বিও একাউন্ট খোলার জন্য টিআইএন নাম্বার, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বাধ্যতামূলক করার পরামর্শ দেন তিনি।

রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি নিয়ে সিপিডির সিনিয়র গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, দেশে যে হারে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে সেই হারে রাজস্ব আদায় বাড়ছে না। আয় না বাড়লে প্রবৃদ্ধি কিভাবে বাড়ে সেটি নিয়ে প্রশ্ন থাকে। গত অর্থবছরের প্রকৃত হিসেবে রাজস্ব আদায়ে ৮৭ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে। এই ঘাটতি না হলে স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ চারগুণ, শিক্ষাখাতে দ্বিগুণ এমনকি এক অর্থবছরের ঘাটতি দিয়ে ৩টি পদ্মাসেতু করা যেতো। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২ দশমিক ৬ শতাংশ যেখান বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা ৪৫ দশমিক ৪ শতাংশ। এইভাবে ঘাটতি হলে সরকারকে টাকার জন্য ব্যাংক ঋণ নিতে হবে। ব্যাংক ঋণ বেশি নিলে ব্যক্তিখাতের চাপ বাড়বে। এতে বিনিয়োগের প্রভাব ফেলে প্রবৃদ্ধি চাপ বাড়াতে পারে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সিপিডি

২৭ জানুয়ারি, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ