Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সীরাতুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও আজকের মুসলিম উম্মাহ

মুফতী পিয়ার মাহমুদ | প্রকাশের সময় : ৩১ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

সৃষ্টির উষালগ্ন থেকেই এই ধূলির ধরায় আগমন ঘটেছে অসংখ্য মহামানবের। কিন্তু পৃথিবী স্বীকার করে নিয়েছে যে, সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ মহামানব হলেন রাসূলে আরাবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এ কথা স্বীকার না করার কোনো উপায়ও ছিল না। কারণ ইতিহাস সাক্ষী পৃথিবীর কেউ কোনো বিচারেই তাঁর মতো হতে পারেন নি, পারবেও না কোনো দিন। তিনি তাঁর চরিত্র মাধুরী, আচার-আচরণ তথা সকল কর্মকান্ড দিয়ে তারই নজীর রেখে গেছেন এই পূতিগন্ধময় বিশ্ব দরবারে। তিনি তাঁর জীবনে এমন কিছুই করেন নি, যার কোনো ক্রটি বা খুঁত চোখে পড়ে কিংবা তার সমালোচনা করা যায়। বস্তুত: এমন নিখুঁত, অমলিন ও পরিপূর্ণ জীবন ও চরিত্র বিশ্বের আর কোনো মানুষের মাঝে দেখা যায় না। সাহাবায়ে কিরাম প্রাণপ্রতিম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সকল অতুলনীয় আচার-আচরণ, স্বভাব-চরিত্র ও রীতিনীতি তথা জীবনের সকল দিক যথাযথ বিশ্বস্ত বর্ণনার মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌছে দিয়েছেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এই অতুলনীয় ও ঈর্ষণীয় সীরাত ও জীবন চরিত বিশ্ব মানবের মুক্তি ও সফলতার জন্য অনুকরণীয়। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে-‘তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মাঝে রয়েছে উত্তম আদর্শ সেই ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহ ও পরকালের আশা রাখে এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করে।’ [সূরা আহযাব:২১] বক্ষমান প্রবন্ধে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বর্ণাঢ্যময় অমলিন জীবনের কয়েকটি দিকের কিঞ্চিত আলোচনা করার প্রয়াস পাবো। যেন আমাদের জীবনেও সেগুলোকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে জীবন যুদ্ধে সফল হতে পারি এবং মুক্তি পেতে পারি পরপারে। সাহাবী আনাস রা. থেকে বর্ণিত, ‘একদা এক বেদুঈন নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর চাদর ধরে জোরে হেচকা টান মারে বললো, হে মুহাম্মাদ! আল্লাহর যে সম্পদ তোমার কাছে আছে, তা থেকে আমাকে কিছু দান করার নির্দেশ দাও। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, এতে তাঁর ঘাড়ে দাগ পড়ে গেছে। তা সত্তেও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার এ আচরণের কোনো বিরুপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন নি। অধিকন্তু তার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলেন এবং তাকে কিছু সম্পদ দান করার নির্দেশ দিলেন।’ [বুখারী, হাদীস: ৫৮০৯; মুসলিম, হাদীস: ১০৫৭;আখলাকুন নবী: ৪৩, হাফিজ আবূ শায়খ ইসফাহানী রহ.] উক্ত ঘটনায় শিক্ষনীয় বিষয় হলো, চরম দুর্ব্যবহার সত্তেও তার দিকে তাকিয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হেসে দিলেন। শুধু তাই নয়, সে যা চাইলো তাও দিয়ে দিলেন। এ যেন এ আয়াতেরই বাস্তব রুপ- আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘ভালো ও মন্দ সমান নয়। মন্দের জবাবে তাই বলুন, যা উৎকৃষ্ট। তখন দেখবেন, আপনার সাথে যে ব্যক্তির শত্রুতা রয়েছে, সে যেন আপনার অন্তরঙ্গ বন্ধু। এ চরিত্র তারাই লাভ করে, যারা সবর করে এবং যারা অত্যন্ত ভাগ্যবান।’ [সূরা হা-মীম সিজদা:৩৪ -৩৫] জীবন চলার পথে এমন ঘটনা আমাদের জীবনেও নেহায়াত কম ঘটে না। কিন্তু আমরা কি করি? ‘ইট মারলে পাটকেলটি মারো’ এই নীতি অবলম্বন করে আমি যে পরিমাণ আঘাত পেয়েছি, তার চেয়ে দ্বিগুণ আঘাত না করলে মনের ঝাল মিটে না। আর কোনো ভিক্ষুক বা সাহায্যপ্রার্থী এ আচরণ করলে তো কোনো কথাই নেই। সে জীবন নিয়ে পালাতে পারবে কি না তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অনেক সময় দেখা যায়, ভিক্ষুক ভিক্ষার জন্য পথ আটকে দাড়ায়। আবার অনেক সময় ভিক্ষার জন্য কাপড়ে ধরে বা গায়ে হাত দেয়। তখন আমরা সাধারণত তাদেরকে ধমক দেই বা গালি দেই। অনেকে আবার মারধরও করে। কিন্তু নবীজীর এ হাদীস থেকে আমরা কি শিক্ষা পায়? ভিক্ষুক বা প্রার্থনাকারী ব্যবহার ভালো না করলেও তার সাথে ভালো ব্যবহার করা এবং তাকে বঞ্চিত না করে সাধ্যানুপাতে তাকে দান করা। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর একজন উম্মত হিসাবে আমাদেরও ভিক্ষুক ও কষ্টদানকারীর সাথে আচরণ এমনই হওয়া উচিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের শিক্ষাদান পদ্ধতিতেও আমরা এই দয়া ও দরদেরই প্রাবল্য দেখতে পাই। হাদীস শরীফে তাঁর শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে কোমলতা ও দরদী আচরণের অনেক ঘটনাই বর্ণিত হয়েছে। একটি ঘটনা হলো, ‘একবার মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম সাহাবায়ে কিরামসহ মসজিদে নববীতে বসা ছিলেন। এ অবস্থায় এক গ্রাম্য লোক এসে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের সাথে সাক্ষাত করলো। এরপর সে মসজিদের এক পাশে গিয়ে পেশাব করতে শুরু করলেন। সাহাবায়ে কিরাম এটি দেখে তাকে ধমকাতে লাগলেন এবং তার দিকে তেড়ে গেলেন। তা দেখে তিনি তাদেরকে এমন আচরণ করতে বারণ করলেন। যখন তার পেশাব করা শেষ হলো, তিনি তাকে কাছে ডাকলেন। [কোনো ধমক বা কঠোর আচরণ না করে কোমল ভাষায়] তাকে বললেন, দেখ, এ মসজিদ এমন স্থান নয়, যেখানে পেশাব করা যাবে; বরং এটা নির্মিত নামায পড়ার জন্য, যিকর-আযকার, তাসবীহ-তাহলীল ও কুরআন তিলাওয়াত করার জন্য। তারপর তিনি সাহাবায়ে কিরামকে আদেশ করলেন, বালতিতে করে পানি এনে উক্ত স্থানে ঢেলে দাও। [ তাঁর এ দরদী ও কোমল আচরণে মুগ্ধ হয়ে] বেদুঈন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামকে লক্ষ্য করে বললো, আপনার উপর আমার পিতা-মাতা উৎসর্গ হোক। পরবর্তীতে সে বলত, তিনি আমাকে একটু তিরস্কারও করলেন না; একটু গালিও দিলেন না।’ [বুখারী, হাদীস: ২২০; নাসায়ী, হাদীস: ৫৬] আমরা সাধারণত এ হাদীসের একটি দিক নিয়েই আলোচনা করি থাকি। তাহলো, মাটিতে পেশাব বা অন্য কোনো তরল নাপাকি পড়লে তা পবিত্র করার উপায় কি? এ হাদীস থেকে তার সমাধান নেওয়া হয় এবং এ বিষয়ে যথেষ্ট আলোচনাও হয়। কিন্তু এ হাদীসের আরও একটি দিক আছে, যার দিকে আমরা সাধারণত নজর দেই না। এই হাদীসে শিক্ষাদানের এক গুরুত্বপূর্ণ নীতি বর্ণিত হয়েছে। তা হচ্ছে, শিক্ষার্থীর সাথে কোমল ও দরদী আচরণ করা। তাদের কোনো ভুল হলেই হুট করে চটে না যাওয়া কিংবা আঘাত না করা। তাহলে এর ফল হবে সুদূর প্রসারী। যেমনটি দেখেছি হাদীসে বর্ণিত বেদুঈনের বেলায়। আম্মাজান আয়েশা রা. হতে বর্ণিত এক দীর্ঘ হাদীসের শেষাংশে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা আমাকে হঠকারী ও কঠোর আচরণকারীরুপে প্রেরণ করেন নি, তিনি আমাকে কোমল ও সহজ আচরণকারী শিক্ষকরুপে প্রেরণ করেছেন। [মুসলিম, হাদীস: ১৪৭৮] উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় ইমাম গাযালী রহ. বলেন, এ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, শিক্ষার্থীর ভুলগুলো যথাসম্ভব কোমলতা ও উদারতার সাথে সংশোধন করতে হবে এবং দয়া ও করুণার পন্থা অবলম্বন করতে হবে। ধমক, ভর্ৎসনার পথ এড়িয়ে চলতে হবে। [আররাসূলুল মুআল্লিম, পৃষ্ঠা: ১১] খতীবে বাগদাদী ইমাম আবু বকর আহমাদ ইবনে আলী রহ. ‘আল ফকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ’ নামক কিতাবে উস্তাদের আদব সম্পর্কিত আলোচনায় বলেন, ‘উস্তাদের উচিত, ভুলকারীর ভুলগুলো কোমল ও নরম ভাষায় বলে দেওয়া; কঠোর আচরণ ও রুক্ষ ভাষার মাধ্যমে নয়।’ [আল ফকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ: ২/২৮৪] খতীবে বাগাদাদী রহ. তাঁর এ বক্তব্যের স্বপক্ষে প্রমাণ স্বরুপ অনেক হাদীস উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে একটি হাদীস হলো, সাহাবী হযরত মুআবিয়া ইবনে হাকাম রা. বর্ণনা করেন, ‘একদিন আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পিছনে নামায আদায় করছিলাম। (চলবে)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ