Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পরিকল্পনা অধিদফতরের আইইএম ইউনিট কর্মশালা না করেই অর্থ উত্তোলন

স্বাক্ষর জাল ও ভুয়া বিল-ভাউচার প্রদান

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ৩১ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

স্কুল-মাদরাসা শিক্ষকদের বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কিশোর-কিশোরীর প্রজনন স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে অবহিতকরণে এসব কর্মশালার আয়োজন করার কথা পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের আইইএম ইউনিটের। এরই অংশ হিসেবে আইইসি অপারেশনাল প্ল্যানের আওতায় ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে দেশের উপজেলা পর্যায়ে ৪৮৬টি কর্মশালা পরিচালনা করার কথা। এ জন্য বরাদ্দও ছিল ৭ কোটি টাকা। যদিও আইইএম ইউনিটের পরিচালকের তত্ত্বাবধানে এসব কর্মশালা হয়েছে। তবে তা বাস্তবে নয়; কাগজে কলমে। অধিদফতরের আইইএম ইউনিটের পরিচালক আশরাফুন্নেছা কর্মশালা না করেই এই টাকা উত্তোলন করেছেন বলে অভিযোগ অধিদফতরের সংশ্লি­ষ্ট বিভাগের কর্মীদের। এক্ষেত্রে তিনি কর্মশালার নামে কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল এবং ভূয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে সব টাকা উত্তোলন করেছেন। অধিকাংশ বিল ভাউচারের প্রতিষ্ঠানেরই কোন অস্তিত্ব নেই।

এসব অভিযোগের প্রেক্ষিতে, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের আইইএম ইউনিটে গত বৃহস্পতিবার অভিযান পরিচালনা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের সহকারী পরিচালক তানভীর আহমদ এবং উপসহকারী পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম এ অভিযান পরিচালনা করেন। অভিযানে দুদক কর্মকর্তারা দেখেন, গত অর্থ বছরে উপজেলা পর্যায়ে ৪৮৬টি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে তথ্য দেখানো হয়েছে। কিন্তু এসব কর্মশালার বিল-ভাউচার পর্যালোচনায় অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। অভিযানে দুদক কর্মকর্তারা আরও দেখেনÑ আমদানী-রপ্তানীকারকের লাইসেন্সধারী ‘সুকর্ন ইন্টারন্যাশনাল কোং’ এবং ‘মেসার্স রুহী এন্টারপ্রাইজ’ নামে দু’টি প্রতিষ্ঠানকে বিজ্ঞাপন প্রচারের কাজ দেয়া হয়েছে। দরপত্রের শর্ত লংঙ্ঘন করে এ দুটি প্রতিষ্ঠানকে ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকার বিল প্রদান করা হয়েছে বলে দুদক দলের কাছে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এসব বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধানের অনুমতি চেয়ে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মহাপরিচালক কাজী আ খ ম মহিউল ইসলাম বলেন, অভিযোগের প্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত দল প্রাথমিক তদন্তে এসেছিল। আমি সংশ্লিষ্ট সবাইকে সব ধরনের সহযোগীতা করতে নির্দেশ দিয়েছি। আইইএম পরিচালক আশরাফুন্নেছার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি তদন্তাধীন। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে উল্লেখ করেন আ খ ম মহিউল ইসলাম।

আইইএম ইউনিট সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বিভিন্ন জেলা উপজেলায় ৪৮৬টি কর্মশালার নামে কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল এবং ভূয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে সব টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। কর্মশালার ব্যয়বাবদ তিনি যে সব বিল ভাউচার ব্যবহার করেছেন তার বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেরই কোন অস্তিত্ব নেই।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কর্মশালায় ব্যবহারের জন্য কেন্দ্রীয় ভাবে কোন ধরনের টেন্ডার বা কোটেশন ছাড়াই কিছু ব্যাগ, কলাম, প্যাড ক্রয় করে আইইএম ইউনিট। তিনটি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান আইইএম পরিচালকের মৌখিক নির্দেশের ভিত্তিতে এসব পণ্য সরবরাহ করে। যেখানে ব্যাগের জন্য ৩৭০ টাকা এবং কলম ও প্যাড যথাক্রমে ১০ ও ২০ টাকা মূল্য নির্ধারন করা হয়। অথচ বিল ভাউচারে ব্যাগের দাম দেখানো হয়েছে ১ হাজার ৫০ টাকা, প্যাড ৭০ টাকা এবং কলম ৮০ টাকা। এছাড়া কর্মশালায় রিসোর্স পার্সনদের সম্মানী ভাতা আয়করসহ ১ হাজার ৬৮০ টাকা, স্থানীয় সমন্বয়কারীদের সম্মানী আয়করসহ ১ হাজার টাকা, অংশ্রগহণকারীদের ভাতা বাবদ ৭শ’ টাকা দেখিয়ে উত্তোলন করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, মৌলভীবাজারে অনুষ্ঠিত কর্মশালার জন্য ‘মেসার্স আচল পেপার, স্টেশনারী এন্ড লাইব্রেরী’ থেকে ব্যাগ, প্যাড কলাম কেনা হয়েছে। যার ঠিকানা স্টেশন রোড, মৌলভীবাজার। ক্যাশ মেমোতে ক্রেতার নাম ঠিকানা লেখা হয়েছে, ‘পরিচালক আইইএম এবং প:প: অধি, ঢাকা’। এছাড়া ‘সাম্পান রেস্টুরেন্ট এন্ড ক্যাটেরিং’ নামে একটি ক্যাশ মেমোতে ক্রেতার একই ঠিকানা ব্যবহার করে আপ্যায়ন উদ্বোধনী ও আপ্যায়ন সমাপনী নামে বিল করা হয়েছে। কিন্তু কোন পণ্যের নাম সেখানে নেই। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, মৌলভীবাজারে স্টেশন রোড নামে কোন সড়ক নেই। এমনকি ‘মেসার্স আচল পেপার, স্টেশনারী এন্ড লাইব্রেরী’ ‘সাম্পান রেস্টুরেন্ট এন্ড ক্যাটেরিং’ নামে কোন প্রতিষ্ঠানও নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইইএম ইউনিটের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, একই ঘটনা ঘটেছে দেশের প্রায় বেশিরভাগ উপজেলায়। মাত্র ৩ দিনে ময়মনসিংহ বিভাগের চারটি জেলার ৩৩টি উপজেলায় কর্মশালা সম্পন্ন করা হয়েছে। বাস্তবে যা অসম্ভব। উপজেলা পর্যায়ে কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের সম্মানী প্রদানের তালিকার নাম ও স্বাক্ষর ঢাকা অফিসে বসেই ইচ্ছেমতো বসিয়ে এসব টাকা আত্মসাত করা হয়েছে। এ ধরনের কিছু নমুনা ইনকিলাবের হাতে রয়েছে।

আইইএম শাখার কর্মকর্তারা জানান, কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের ব্যাগ প্রদানের জন্য কেন্দ্রীয় ভাবেও ব্যাগ কেনেন পরিচালক আশরাফুন্নেসা। তবে কোন ধরনের টেন্ডার বা কোটেশন ছাড়াই তিনজন সরবরাহকারীকে তিনি ব্যাগ প্রদানের জন্য মৌখিক নির্দেশ দেন। তার প্রেক্ষিতে উইমেক্স ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, জারিন এন্টারপ্রাইজ এবং এমআর এন্টারপ্রাইজ যথাক্রমে ৮ হাজার, ৩ হাজার ৪’শ এবং ২ হাজার ব্যাগ সরবরাহ করে। কিন্তু ৩৭০ টাকা থেকে ৪শ’ টাকায় ব্যাগ সরবরাহ করলেও তিনি সরবরাহকারীদের অর্ধেক টাকা পরিশোধ করলেও বাকী টাকা দিতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন।

উইমেক্স ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের কর্ণধার একেএম হারুন অর রশীদের সঙ্গে। তিনি বলেন, দুই কোয়ালিটির ৮ হাজার ব্যাগ সরবরাহ করেছেন তিনি। যার মূল্য ৩৫ লাখ টাকা। এ পর্যন্ত তাকে মাত্র ১৪ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। বাকী ২১ লাখ টাকা চাইতে গেলে আর কোন টাকা দেয়া হবে না বলে জানান পরিচালক আশরুফুন্নেছা। একই বক্তব্য দেন জারিন এন্টারপ্রাইজের কর্ণধার হাবিবুর রহমান। যিনি আইইএম শাখার ডিপিএম খন্দকার মাহবুবের বড় ভাই। এছাড়া এম আর এন্টারপ্রাইজের মালিক আবু জাফরও একই মন্তব্য করেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৯-২০ অর্থ বছরে কোন কাজ না করেই ৪৮টি কোটেশনের মাধ্যমে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন আশরুফুন্নেসা। যার কোন নথিপত্র নেই। ভুয়া কার্যাদেশ তৈরি করে বিলের সঙ্গে সংযুক্ত করে এসব বিল এজি অফিস থেকে পাশ করানো হয়েছে। যদিও সরকারি নিয়মানুযায়ী একজন পরিচালক বছরে ৬টি বেশি কোটেশন করার কোন নিয়ম নেই। এসব বিল তিনি তার ব্যক্তিগত ব্যাংক এক্যাউন্টে (উত্তর ব্যাংক-০০১২১০-০২১-১২৩১) জমা দিয়ে ক্যাশ করে নিজেই উত্তোলন করেছেন। কিন্তু সরকারি অর্থ ব্যক্তিগত একাউন্টে রাখাও বিধি সম্মত নয়।

সংশ্লি­ষ্টরা জানান, নিজের ভাগ্নের প্রতিষ্ঠান ময়মনসিংহের রুহি এন্টারপ্রাইজের ট্রেড লাইসেন্সে ‘আমদানীকারক’ উল্লেখ থাকলেও তিনি অধিদফতরের শর্ত ভঙ্গ করে এই প্রতিষ্ঠানকে সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রচারের কাজ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে দরপত্রে উল্লেখিত ৩ বছরের অভিজ্ঞতার শর্তও মানা হয়নি। তেমনিভাবে কাজ দিয়েছেন নিজের চাচাতো ভাইয়ের ময়মনসিংহের প্রতিষ্ঠান সুকর্ণ ইন্টারন্যাশনালকে। ভাগ্নে ও চাচাতো ভাইয়ের প্রতিষ্ঠান নামে হলেও মূলতঃ ১ কোটি ৮৫ লাখ টাকার এই দুটি কাজ তিনি নিজেই করছেন। বিজ্ঞাপন প্রচারের ক্ষেত্রে দরপত্রে উল্লিখিত শর্তও ভঙ্গ করেছে এই দুটি প্রতিষ্ঠান। এসব নথিও ইনকিলাবের হাতে রয়েছে।

অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, শিক্ষা ক্যাডার থেকে প্রশাসন ক্যাডারে আসা এই কর্মকর্তা ইতোপূর্বে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির দায়িত্বে থাকা অবস্থায় অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। দুর্নীতির কারণে তাকে সেই সময় ওএসডি করা হয়। তার বিরুদ্ধে এ ধরনের বিভিন্ন অভিযোগ থাকায় পদোন্নতি বঞ্চিত হওয়ায় তিনি বর্তমানে এই পদে নিযুক্ত হয়েছেন।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের পরিচালক (আইইএম) আশরাফুন্নেছার সাথে মোবাইলে কথা বলতে চাইলে তিনি একটু পরে কল দিতে বলেন। পরে কল করলেও কিন্তু তিনি কল রিসিভ করেননি।####

 

 



 

Show all comments
  • ahammad ৩০ অক্টোবর, ২০১৯, ৩:১১ এএম says : 0
    এরা শিখখিত নামের কুলাঙ্গার, এধরনের দুসি ব্যাক্তিদেরকে স্হায়ীভাবে চকুরীচ্যুত করে দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তির দাবী জানাচ্ছি।
    Total Reply(0) Reply
  • ASa ৩০ অক্টোবর, ২০১৯, ৯:১৯ এএম says : 0
    NC.....
    Total Reply(0) Reply
  • Babul ৩০ অক্টোবর, ২০১৯, ১১:৫৬ এএম says : 0
    সুন্দর নিউজ। ধন্যবাদ দৈনিক ইনকিলাব। দোষীদের দ্রুত শাস্তির আওতায় আনা হোক....
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ