Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কিশোর গ্যাং : উজ্জ্বল তারুণ্যের জন্য চাই উন্নত অভিভাবকত্ব

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক | প্রকাশের সময় : ২৯ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

পত্র-পত্রিকার একটি উদ্বেগজনক সাম্প্রতিক শিরোনাম কিশোর গ্যাং। অভিভাবকদের জন্য তো বটেই, ইতোমধ্যে তা হয়ে উঠেছে সামাজিক উদ্বেগেরও বিষয়। এই শিরোনামের সাথে জড়িয়ে আছে স্কুলপড়–য়া কিশোরদের মধ্যকার সিনিয়র-জুনিয়রের দ্ব›দ্ব, আধিপত্য বিস্তারের মানসিকতা, মাদক, নারী-নির্যাতন এমনকি খুনখারাবির প্রবণতা। বিষয়টি খুনখারাবির পর্যায়ে চলে যাওয়ার পর প্রশাসন ও মিডিয়াসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে তা আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

সমাজবিজ্ঞানী ও শিশু-মনস্তত্ত¡বিদগণ এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছেন এবং বিভিন্ন কারণ নির্দেশ করছেন। তাদের বলা ও না-বলা কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে হিরোইজম ও লোকের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রবণতা, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা ও অশ্লীলতার সয়লাব, বলিউড-হলিউডের ছায়াছবির হিংস্রতা ও পাশবিকতা, মাদকের বিস্তার, ছেলে-মেয়ের অবাধ মেলামেশা, পারিবারিক অশান্তি ও অস্থিরতা, ছেলে-মেয়েকে পর্যাপ্ত সময় না দেওয়া ইত্যাদি। এককথায় পশ্চিমা পুঁজিবাদী ও ভোগবাদী জীবনধারার নানা অনুষঙ্গ। এই জীবন-দর্শন ও জীবন-ধারার নানাবিধ কুফল, যা প্রতিনিয়ত বিভিন্নরূপে প্রকাশিত হয়ে চলেছে, উপরের বিষয়টিও তার সা¤প্রতিক দৃষ্টান্ত।

তিক্ত হলেও সত্য যে, ইসলামী জীবনবোধ ও জীবনব্যবস্থার অনুসরণের অভাব আমাদেরকে নানা সমস্যায় পর্যুদস্ত করে রেখেছে। এইসকল সমস্যা থেকে মুক্তির যথার্থ ও স্থায়ী উপায় হচ্ছে, সমাজের সর্বস্তরে ইসলামী জীবনবোধের বিস্তার ও ইসলামী জীবন-ব্যবস্থার অনুসরণ।

ইসলামী জীবনবোধ জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায়, জীবনের যথার্থ মূল্য সম্পর্কে সচেতন করে, নেতৃত্ব ও মর্যাদার সঠিক সংজ্ঞা ও যথার্থ উপলব্ধি দান করে, সর্বোপরি জীবনকে জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কাজে ব্যবহারের পথনির্দেশ করে। সাধারণভাবে প্রতিটি মানুষের জন্য, আর বিশেষভাবে কিশোর-তরুণ প্রজন্মের জন্য ইসলামী জীবনবোধ তাই অতি প্রয়োজন।

জীবনের অতি মূল্যবান অংশের নাম তারুণ্য। স্বপ্ন ও সম্ভাবনার, উদ্যম ও গঠনের এ এক সতেজ অধ্যায়। আর তাই সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে তরুণ-সমাজ। এরাই তো নতুন সূর্য- সমাজের স্বপ্ন ও সম্ভাবনার। এই সূর্য ক্ষয় ও অবক্ষয়ের কালো মেঘে ঢাকা পড়ে যাওয়ার মানে, সমাজের ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যাওয়া। কাজেই আমাদের কিশোর-তরুণদের অবক্ষয়ের রাহু-গ্রাসে পতিত হওয়া থেকে অবশ্যই ফেরাতে হবে।

সেই ফেরানো যতটা না পারিবারিক ও সামাজিক শাসনের দ্বারা তার চেয়েও বেশি সোহাগ ও সঠিক নির্দেশনার দ্বারা। জীবন সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের কিশোর-তরুণদের হিংস্রতা ও অবক্ষয়ের পথে ধাবিত করছে তার কি কোনো দায় নেই? ভোগবাদী, আগ্রাসনবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, অহঙ্কার ও তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিভঙ্গি, ঘৃণা ও হিংসার দৃষ্টিভঙ্গি যারা সরবরাহ করছেন তাদের কি কোনো দায় নেই? নাটক-সিনেমা, বিনোদন-সংস্কৃতি, সংবাদ-সাহিত্য, রাজনীতি-শিক্ষানীতি ইত্যাদির কি কোনো দায় নেই?

সত্যি কথা হচ্ছে, জীবন ও সমাজের যে অঙ্গন থেকেই আল্লাহমুখিতা ও আখেরাতমুখিতার আলো বিদায় নেবে সে অঙ্গনেই বাসা বাঁধবে নানাবিধ অন্ধকার। ওখান থেকেই ছড়িয়ে পড়বে নানা রোগব্যাধি। অন্ধকারের এই রোগব্যাধি থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় হচ্ছে ঈমানের দীপ জ্বেলে দেয়া।

আজ আমাদের কিশোর-তরুণদের একটি অংশে ছড়িয়ে পড়া গ্যাং-কালচার আলোচনায় এসেছে। কেউ কি বলতে পারেন আগামীকাল অন্য কিছু আলোচনায় আসবে না? এর পরের দিন আসবে না অন্য কিছু? কাজেই গোড়ার সমাধান নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তা হচ্ছে ঈমানের আলোর বিস্তার। বাস্তবিকই এর কোনো বিকল্প নেই।

আজ যে কারণগুলো সাধারণত আলোচনায় আসছে তা দূর করার কী উপায়? ইন্টারনেট ও যোগাযোগমাধ্যম অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। কিন্তু এগুলো তো আধুনিক জীবনের অনুষঙ্গ। এগুলো একেবারে বাদ দেয়ার সুযোগ নেই। তাহলে শেষ কথা এই দাঁড়াবে যে, এসব উপকরণ ব্যবহারে সংযমি হতে হবে। এই সংযমটা আসবে কোত্থেকে- আল্লাহর ভয় ও আখেরাতের চেতনা ছাড়া?

পরিবারে ছেলে-মেয়েকে সময় দিতে হবে। ঠিক কথা। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব হবে- যদি না অন্য ব্যস্ততা কিছুটা হ্রাস করা যায়? এই ত্যাগের প্রেরণা কিভাবে আসবে- অল্পে তুষ্টির চেতনা ছাড়া?

আমরা বলতে পারি যে, কিশোর-তরুণদের বোঝাতে হবে, ‘নেতৃত্ব অর্থ জালিম হওয়া নয়, নেতৃত্ব অর্থ সেবক হওয়া।’ কিন্তু কেন তারা জালিম না হয়ে সেবক হবে- যখন জালিমেরাই সমাজে সমীহের পাত্র? লোকের সমীহের মোহ ছেড়ে নিঃস্বার্থ সেবকের স্তরে কিভাবে কেউ উন্নীত হবে- আখেরাতের জবাবদিহিতা ও মহা পুরস্কারের অটল বিশ্বাস ছাড়া?

আমরা বলছি, কিশোরেরা কাদের সাথে চলে তা মনিটরিং করতে হবে! অবশ্যই করতে হবে। কিন্তু একইসাথে তার জন্য উত্তম সাহচর্যের ব্যবস্থাও তো করতে হবে। এটা কি ভাবতে হবে না যে, কিশোর ছেলেটি কেন ক্ষতিকর সাহচর্যের দিকেই প্রলুব্ধ হচ্ছে? তাকে ক্ষতিকর সাহচর্য থেকে ফিরিয়ে রাখা যেমন কর্তব্য তেমনি কর্তব্য, তার জন্য উত্তম সাহচর্যের ব্যবস্থা করা। আরো কর্তব্য, সেই উত্তম সাহচর্যের প্রতিই তার মনে আকর্ষণ তৈরি করা। কিন্তু কিভাবে তা হবে আখেরাতমুখী জীবনবোধের বিস্তার ছাড়া?

সর্বোপরি আমাদের কিশোর-তরুণদের মাঝে যেসব সৎগুণের সমাবেশ আমরা দেখতে চাই- আমাদের কর্তব্য, নিজেদেরকেও সেইসব সৎগুণের উত্তম নমুনা হিসেবে গড়ে তোলা। সেবার মহিমা, বিনয়ের মাহাত্ম্য, সংযমের শক্তি, জীবনের মূল্য, এককথায় মানবজীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদের নিজেদেরও সচেতন হতে হবে, আমাদের সন্তানদেরকেও সচেতন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সন্তানের উজ্জ্বল-তারুণ্য নির্মাণে আমাদের উন্নত অভিভাবকত্বের কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহ তায়ালা আমাদের তাওফিক দান করুন। আমীন।



 

Show all comments
  • Mirja Jewel ২৯ অক্টোবর, ২০১৯, ১:৫৫ এএম says : 0
    কিশোর অপরাধীরাই সবচাইতে বেশি ভয়ংকর। তাই এদের কোন ছাড় নয়। কিশোর সংশোধন কেন্দ্রে না পাঠিয়ে এদের জেলের ব্যবস্থা করা হউক। বাকী জীবনে এইসব অপরাধীদের ভালো হওয়ার সম্ভাবনাও একেবারে কম।
    Total Reply(0) Reply
  • Shariful alam ২৯ অক্টোবর, ২০১৯, ১:৫৭ এএম says : 0
    এলাকার মুরব্বি ও অভিভাবকদের দায়িত্ব নিতে হবে। কিশোর-তরুণদের গঠনমূলক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে যুক্ত করতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • এম সোহেল ২৯ অক্টোবর, ২০১৯, ১:৫৭ এএম says : 0
    এসব আকাশ কালচারের প্রভাবে ভয়াবহ এক সামাজিক ব্যাধি ।
    Total Reply(0) Reply
  • farukh ২৯ অক্টোবর, ২০১৯, ১:৫৭ এএম says : 0
    বাংলাদেশে ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষাক্রম ২০ বছরের ধরে চলছে, এর দ্বারা দেশের বিশেষ কোন উপকার হয়েছে বলে জানা যায়নি।
    Total Reply(0) Reply
  • Akhlakur Rahman ২৯ অক্টোবর, ২০১৯, ১:৫৭ এএম says : 0
    এ সকল অপসংস্কৃতির লাগাম শুরু থেকে ধরতে না পারলে এক সময় পুরো সমাজটা নষ্ট হয়ে যাবে। তখন কারো হাতে নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।
    Total Reply(0) Reply
  • Sayem Hossain ২৯ অক্টোবর, ২০১৯, ১:৫৮ এএম says : 0
    ছেলের দোষ খুব একটা দেখি না আমি। বাবা-মা হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব পালন না করার কারণেই সন্তান বখে যায়।
    Total Reply(0) Reply
  • আসম হাফিজুল ইসলাম সবুজ ২৯ অক্টোবর, ২০১৯, ১:৫৮ এএম says : 0
    বাবা–মা কি করেন? সন্তানের অধঃপতনের জন্য তাঁরাও সমানভাবে দায়ী।
    Total Reply(0) Reply
  • Binoy Debnath ২৯ অক্টোবর, ২০১৯, ১:৫৯ এএম says : 0
    সন্তানের প্রতি অভিভাবকদের উদাসীনতাও এসবের জন্য অনেকাংশে দায়ী। তাই তাদের সচেতন হওয়া খুবই জরুরী।
    Total Reply(0) Reply
  • Abdul Awal ২৯ অক্টোবর, ২০১৯, ১:৫৯ এএম says : 0
    পারিবারিক মূল্যবোধ বলে একটা কথা আছে, যা বাঙালি ভুলতে বসেছে। বাবা মায়ের উদাসীনতাই এই সব কিশোরদের বিপথে যাওয়ার কারণ।
    Total Reply(0) Reply
  • Md. Abu Saeed Rony ২৯ অক্টোবর, ২০১৯, ১:৫৯ এএম says : 0
    অপসংস্কৃতির জোয়ারে ভাসতে ভাসতে আমরা কোথায় গিয়ে ঠেকব তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। সঠিক ধর্মীয়, পারিবারিক, সামাজিক শিক্ষা ও সচেতনতা সৃষ্টি না করতে পারলে এরকম গ্যাং কালচার একসময় ঘরে ঘরে তৈরী হবে, যা থেকে আমরা কেউই রেহাই পাব না।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলাম

৩ মার্চ, ২০২৩
২ মার্চ, ২০২৩
১ মার্চ, ২০২৩
২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন