বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
প্রয়োজনে মানুষ ঋণ গ্রহণ করে। অভাব-দারিদ্র্যের কারণে দরিদ্ররাই যে ঋণ গ্রহণ করে, তা নয়, ধনী ও বিত্তবান লোকেরাও অনেক সময় ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। সাধারণভাবে ঋণ গ্রহণ করাকে ভালো চোখে দেখা হয় না। কিন্তু যেহেতু প্রয়োজন ঋণ গ্রহণকে অনিবার্য করে তোলে, তাই ঋণ গ্রহণকে সমর্থন না জানানোর সুযোগ নেই। অবশ্য ঋণ নিয়ে ‘ঘি খাওয়া’ মোটেই উচিত নয়। এতে ঋণের জালে আটকা পড়ার সমূহ আশঙ্কা থাকে এবং এর পরিণতি কখনো কখনো শুভ হয় না। ঋণ একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিতে হয়। এই সময়ের মাঝে ঋণ পরিশোধ করলে কোনো সমস্যা নেই। সময় মতোই ঋণ পরিশোধ করা উচিত। কোনো কারণে সেটা সম্ভব না হলেই বিপত্তি। আমাদের দেশে এমন কিছু লোক আছে, যারা প্রয়োজনে, কম প্রয়োজনে এমনকি অপ্রয়োজনেও ঋণ গ্রহণ করে। ঋণদাতা, বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার কাছ থেকে তারা ঋণ নেয় এবং নেয় সুদে। এভাবে ঋণ গ্রহণকে তারা অভ্যাসে পরিণত করে নিয়েছে। এই অপরিণামদর্শী ঋণগ্রহীতাদের বিপাকে পড়া খুবই স্বাভাবিক।
ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে জমি-জমা, সহায়-সম্বল হারিয়ে নিঃস্বে পরিণত হওয়া আমাদের দেশ ও সমাজে মোটেই বিরল নয়। এনজিওর ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ ব্যক্তিদের হয়রানি-পেরেশানি ও গ্রামছাড়া হওয়ার খবর প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হতে দেখা যায়। নিরূপায় ঋণগ্রস্তদের আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে দেখা যায়। ক’দিন আগে এরকমই একটা খবর প্রায় সব পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এক ব্যক্তি তার স্ত্রী ও পুত্রকে বিষ খাইয়ে হত্যা এবং নিজে সিলিং ফ্যানে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন। জানা যায়, নানাজনের কাছে তার ঋণ ছিল। ব্যাংক থেকেও তিনি ঋণ নিয়েছিলেন। ঋণদাতাদের তাগদা ও ব্যাংকঋণের জন্য তার বিরুদ্ধে মামলা হয়, যা তাকে চরমভাবে হতাশ করে ফেলে। এই হতাশারই ফল হত্যা-আত্মহত্যা। ঋণের কারণে, বলা যায়, একটা পরিবার শেষ হয়ে গেছে। এর চেয়ে মর্মান্তিক আর কিছু হতে পারে না।
ঋণ গ্রহণকে ইসলাম অনুৎসাহিত করেনি। মানবিক প্রয়োজন হিসাবে মানুষের ঋণ গ্রহণকে ইসলাম সমর্থন করে। আল্লাহপাক দায়গ্রস্ত লোকদের সহায়তার জন্য সামর্থ্যবান ও সংগতিসম্পন্ন লোকদের ঋণ প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন: কে সে, যে আল্লাহকে কর্জে হাসানা প্রদান করবে? আল্লাহ তা তার জন্য বহুগুণে বৃদ্ধি করবেন। (আল কোরআন ২ : ২৪৫)। বলা বাহুল্য, আল্লাহ সম্পূর্ণ অভাবমুক্ত। তার কোনো ঋণের প্রয়োজন নেই। তিনি ঋণ চেয়েছেন তার অভাবী বান্দাদের জন্য। কর্জে হাসানা অর্থ, উত্তম ঋণ। উত্তম ঋণ সুদ বা লাভমুক্ত। এই ঋণের জন্য আল্লাহপাক বেশুমার পুরস্কার বা বিনিময় দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন : তোমরা আল্লাহকে কর্জে হাসানা দাও, আমি অবশ্যই তোমাদের গোনাহসমূহ মাফ করব এবং তোমাদের জান্নাতে প্রবেশ করাবো। (আল কোরআন ৫:১২)।
রাসূলপাক নিজে কর্জে হাসানা গ্রহণ করেছেন। ইসমাইল ইবনে ইবরাহীম ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে আবু রাবীআ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি তার পিতা থেকে, তার পিতা, তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, নবী সা. আমার নিকট থেকে ৪০ হাজার দিরহাম কর্জ নিলেন। তার কাছে মাল এলে তিনি আমার পাওনা আমাকে ফেরত দেন এবং বলেন : আল্লাহ তোমার পরিবার-পরিজন ও মালে বরকত দান করুন। ঋণের প্রতিদান হলো প্রশংসা করা ও তা পরিশোধ করা।
কর্জে হাসানার শর্ত হলো, যথাসময়ে তা পরিশোধ করতে হবে। উপযুক্ত কারণ ছাড়া কেউ ঋণ থেকে মুক্তি পেতে পারেনা। ঋণ আত্মসাতের কোনো অভিপ্রায় গ্রহণযোগ্য নয়। ঋণ আত্মসাৎকারীর বরবাদি অবধারিত। রাসূল সা. বলেছেন: কোনো ব্যক্তি অপর ব্যক্তির মাল গ্রহণ করলে এবং তা পরিশোধের অভিপ্রায় রাখলে আল্লাহপাক তার পক্ষ থেকে তা পরিশোধের ব্যবস্থা করে দেন। আর কোনো ব্যক্তি অপরের মাল আত্মসাতের অভিপ্রায় গ্রহণ করলে আল্লাহ তাকে বরবাদ করেন।
সত্য সত্যই যদি ঋণগ্রহীতা ঋণ পরিশোধে অপারগ হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে তাকে সহায়তা করার জন্য রাসূল সা. নির্দেশ দিয়েছেন। আবু সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত একটি হাদীস আছে, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূল সা. যুগে ফল খরিদ করে লোকসানের শিকার হয়। এতে তার ঋণের পরিমাণ বেড়ে যায়। রাসূলুল্লাহ সা. সাহাবীদের বললেন, তোমরা তাকে দান-খয়রাত করো। লোকেরা দান-খয়রাত করলো। কিন্তু তা ঋণ পরিশোধের জন্য যথেষ্ট ছিল না। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সা. ঋণদাতাদের বললেন: যে পরিমাণ তোমরা পাচ্ছ তাই গ্রহণ করো। এর অধিক কিছু পাবেনা।
ঋণগ্রহীতা যদি ঋণ পরিশোধ করতে না পারে এবং ঋণ রেখে যদি মৃত্যুবরণ করে, সে ক্ষেত্রে ঋণদাতাদের উচিত তাকে মাফ করে দেওয়া। ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে প্রত্যেকের উচিত, সুদ বা অতিরিক্ত লাভ দেয়ার শর্তে ঋণ না নেয়া। সুদ বা লাভের শর্ত যুক্ত ঋণ শোষণম‚লক এবং ঋণ গ্রহীতার সামর্থ্যকে তা নিঃশেষ করে দেয়। তাকে দরিদ্রেতর পর্যায়ে নিয়ে যায়। এ কারণে ইসলাম সুদকে হারাম ঘোষণা করেছে। আরো একটা কথা মনে রাখতে হবে, সংসার জীবনে সমস্যার অন্ত নেই। যে কোনো সমস্যা ও সংকটে ধৈর্য ধারণ করে আল্লাহপাকের সাহায্য কামনা করতে হবে। আল্লাহপাক তাঁর রহমত সম্পর্কে নিরাশ না হতে বলেছেন। তিনি বলেছেন: তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ তোমাদের সকল অপরাধ মার্জনা করবেন। (আল কোরআন ৩৯: ৫৩)।
তাই সমস্যা সঙ্কটে দিশেহারা হয়ে হত্যা বা আত্মহত্যা করা উচিত নয়। নির্দোষ কাউকে হত্যা করা যেমন মহাপাপ তেমনি আত্মহত্যা করাও মহাপাপ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।