হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মুনশী আবদুল মান্নান
ক্ষমতাসীন মহাজোটের বড় শরিক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম অন্যতম ছোট শরিক জাসদের দিকে একটি ঢিল ছুড়ে মেরেছেন। জাসদের ’৭২ থেকে ’৭৫ পর্যন্ত সময়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, জাসদ ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধারক ও বাহকেরা শতভাগ ভ-। জাসদের একজনকে মন্ত্রী করায় আওয়ামী লীগকে আজীবন প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। তিনি এই অভিযোগও এনেছেন যে, জাসদই বঙ্গবন্ধু হত্যার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।
জলাশয়ে ঢিল ছুঁড়লে তাতে তরঙ্গ উঠবেই। এটা প্রাকৃতিক নিয়ম। এর বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যাও হাজির করা যায়। এক্ষেত্রেও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। সৈয়দ আশরাফ যে ঢিলটি ছুঁড়েছেন তা মোটেই ক্ষুদ্র নয়। তাই তরঙ্গটাও বড় হয়ে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। জাসদের সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু থেকে শুরু করে অনেকেই তাদের স্ব স্ব দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ তাদের মতামত জানিয়েছেন। সৈয়দ আশরাফ তার বক্তব্য প্রদানের পর একেবারেই চুপচাপ, আর কোনো কথা বলেননি। জানা গেছে, ইতোমধ্যেই তিনি লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছেন। ওবায়দুল কাদের তার প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, এটা সৈয়দ আশরাফের ব্যক্তিগত মত। দলীয় অভিমত নয়। এ বিষয়ে দলীয় বা সরকারি ফোরামে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। মাহবুব-উল আলম বলেছেন, আমরা অতীত জেনেই ঐক্য করেছি। ছাত্রলীগে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জ্ঞানদান করতে গিয়ে নানা কর্মশালা হয়। হয়তো সেই প্রেক্ষাপটে অতীতের একটি ইতিহাস সম্পর্কে সৈয়দ আশরাফ সাহেব একটা কথা বলেছেন। এর মানে এই নয় যে, ১৪ দলের মধ্যে কোনো অনৈক্য সৃষ্টি হয়েছে। আমরা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতে চাই, ১৪ দলের মধ্যে কোনো বিভ্রান্তি নেই। ১৪ দল ঐক্যবদ্ধ আছে।
মহাজোট সরকারে জাসদের তরফে একমাত্র মন্ত্রী হলেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যে তার প্রতি স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। এ কারণে হাসানুল হক ইনুর অধিকতর ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হওয়ার কথা। তিনি সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যকে অনভিপ্রেত, দুঃখজনক ও অপ্রাসঙ্গিক বলে অভিহিত করেছেন। এই সঙ্গে বলেছেন, এ সময়ে ১৪ দলের অভ্যন্তরে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি উচিত নয়। ইতিহাস চর্চার সময় এটা নয়। এটা জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করার সময়। জনগণের নিরাপত্তা বিধান করার সময়। তিনি উল্লেখ করেছেন, ’৭২ থেকে ’৭৫ পর্যন্ত সময়ের প্রতিটি ঘটনা এখনো ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করা আছে। তাই ইতিহাস ইতিহাসের মতোই বিশ্লেষণ করবে। বঙ্গবন্ধুর সমর্থনে যে তল্পিবাহক-তোষামোদকারী গোষ্ঠী ছিল তারা বা প্রকাশ্যে বিরোধিতাকারী জাসদÑ কার কতটুকু ভুল বা কে কতটুকু ক্ষতি করেছে বা ক্ষতি করেনি তার মূল্যায়নটা ইতিহাসই করবে। তিনি ১৪ দলের ঐক্য অটুট থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন এবং উসকানিতে পা না দেয়ার ও উত্তেজিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ধৈর্য ও ঐক্য বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। জাসদ (ইনু-শিরিন) সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের প্রতিবাদে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। ওই কর্মসূচি পালনকালে দলীয় নেতৃবৃন্দ প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সৈয়দ আশরাফের মুখের লাগাম টেনে ধরার আহ্বান জানিয়েছেন।
ক্ষমতার বাইরে থাকা জাসদের একাংশের সভাপতি ও প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক আ স ম আবদুর রব সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য, অন্যায্য ও অনভিপ্রেত। বঙ্গবন্ধুর হত্যার জন্য আওয়ামী লীগই দায়ী। বিবৃতিতে তিনি আরও বলেছেন, আওয়ামী লীগের দলীয় ভুল রাজনীতি বঙ্গবন্ধুকে দলীয় আবর্তে বন্দী করে, ঔপনিবেশিক শাসনের বেড়াজালে আবদ্ধ করে, জনগণ থেকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। আ স ম আবদুর রবের ভাষায়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আওয়ামী লীগই সরকার গঠন করে। ৩২ নং ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর লাশ রেখে আওয়ামী লীগ নেতারাই মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্দেশেই জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয় এবং সেই সরকারই দেশে প্রথম সামরিক শাসন জারি করে। এসব সত্য এবং ভুল রাজনীতি আওয়ামী লীগের স্বীকার না করাই হবে অতি মাত্রায় ভ-ামি। জাসদের আরেক অংশের সভাপতি শরীফ নুরুল আম্বিয়া বলেছেন, সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের হঠাৎ এমন বক্তব্য শুনে আমরা বিস্মিত হয়েছি। তিনি যা বলেছেন, তা সত্য নয়; বরং বিভ্রান্তিকর। তার বক্তব্যে প্রকৃত সত্যকে আড়াল করা হয়েছে। মহাজোটের অন্যতম ছোট শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশাহ বলেছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাসদের মতপার্থক্য থাকতে পারে। আমাদেরও আছে। মতপার্থক্য মেনে নিয়েই জোট করা হয়েছে। যখন গুপ্তহত্যা চলছে, জঙ্গিবাদের তৎপরতা চলছে সেই সময় ঐক্য আরো মজবুত করা দরকার। সৈয়দ আশরাফের এই সময় জাসদের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে কোনো বক্তব্য রাখতে দেখা যায়নি আওয়ামী লীগের কোনো শীর্ষ নেতাকে। এমনকি জাসদের ভূমিকা নিয়ে যিনি প্রথম প্রশ্ন তোলেন এবং সৈয়দ আশরাফ যে কথা বলেছেন প্রায় হুবহু সে কথা বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে তোলপাড় সৃষ্টি করেন সেই আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমকেও কোনো কথা বলতে শোনা যায়নি। ২০১৫ সালের ২৩ আগস্ট জাতীয় সংসদে জাসদের ’৭২ থেকে ’৭৫ সালের কর্মকা-ের তদন্তের দাবি করে শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের ক্ষেত্র তৈরির জন্য জাসদ দায়ী। এর আগে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, স্বাধীনতাবিরোধীরা কখনো বঙ্গবন্ধুর ওপর আঘাত হানতে পারত না, যদি এই গণবাহিনী, জাসদ বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করে বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতি করে, মানুষ হত্যা করে, এমপি মেরে পরিবেশ সৃষ্টি না করত। সুতরাং বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল রহস্য বের করতে হবে, কারা কারা জড়িত ছিল। উল্লেখ করা যেতে পারে, তার এ বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সে সময় মাহবুব-উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক প্রমুখ জাসদকে রীতিমতো তুলাধোনা করেন। সৈয়দ আশরাফের একই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে মাহবুব-উল আলমের বক্তব্য আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। জাহাঙ্গীর কবির নানকও এবার নিশ্চুপ।
আওয়ামী লীগ নেতাদের সমর্থন থেকে বঞ্চিত হলেও সৈয়দ আশরাফ অনেকটা অযাতিতভাবেই নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়েছেন এককালের ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতা এবং বর্তমান জাতীয় পার্টির সভাপতিম-লীর সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদের। গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে ফ্লোর নিয়ে তিনি ’৭২ থেকে ’৭৫ সময়কালে জাসদের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, একাত্তরে একসঙ্গে যুদ্ধ করলাম। সব কিছু করলাম। একই বিছানা থেকে উঠে উনারা (জাসদ) আমাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরলেন। অস্ত্র ধরার বিনিময়ে কী করলেন? আমাদের গুনে গুনে ২০ লাখ লোককে হত্যা করলেন। এই যে হত্যা করলেন, আজকে যে দুর্দিন-দুরবস্থা, সেদিন যদি জাসদ গণবাহিনী করে নির্বিচারে মানুষ হত্যা না করত তাহলে দেশের এত বড় ক্ষতি হতো না। বঙ্গবন্ধুর মতো এত বড় জাতীয় নেতাকে আমরা হারাতাম না।
দেখা যাচ্ছে, ১০ মাস আগে যে বিতর্কের সূচনা করেন শেখ ফজলুল করিম সেলিম সে বিতর্ক নতুন করে সামনে এনেছেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। সাম্প্রতিককালে ঘুরেফিরে এই বিতর্ক কেন উঠে আসছে, পর্যবেক্ষক মহলে তা একটি বড় প্রশ্ন। ’৭২ থেকে ’৭৫ পর্যন্ত সময়ে জাসদের ভূমিকা নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের বারবার প্রশ্ন তোলার উদ্দেশ্য কি? মহাজোটে শরিক দলগুলোর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে ব্যত্যয় ঘটেছে কিনা সঙ্গতকারণে সে প্রসঙ্গ আলোচনার দাবি রাখে। অনেকেরই এটা জানা, মহাজোটে জাসদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে আওয়ামী লীগের একাংশের অমত ছিল। জাসদকে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান এবং একটি প্রভাবশালী মন্ত্রীর পদ দেয়া নিয়েও নানা অসন্তোষের কথা বিভিন্ন সময়ে শোনা গেছে। যে কোনো কারণেই হোক, জাসদ-বিতর্ক মহাজোটের ঐক্য ও সংহতিতে কোনো বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি। এর একটি প্রধান কারণ সম্ভবত এই যে, জাসদের পৃথক রাজনীতি বলতে এখন আর তেমন কিছু অবশিষ্ট নেই। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জাসদের রাজনীতি একাকার হয়ে গেছে। অন্য আরেকটি কারণ হতে পারে, আওয়ামী লীগের নীতি-দর্শন, উদ্যোগ, পদক্ষেপ সবকিছু বিনা প্রশ্নে জাসদ সমর্থন জানিয়ে আসছে আগাগোড়া। জাসদকে কখনো কখনো আওয়ামী লীগের চেয়েও বেশি আওয়ামী লীগ বলে প্রতীয়মান হয়। সবচেয়ে বড় কথা, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আনুগত্যের প্রশ্নে জাসদ তার আন্তরিকতার প্রমাণ দিতে সমর্থ হয়েছে। অনেকের মতে, মহাজোট ছাড়লে জাসদের অস্তিত্ব খুব বেশি দিন স্থায়ী হবে না। সে কারণেই জাসদ মহাজোট ধরে আছে। আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করা কিংবা মহাজোট ত্যাগ করার চিন্তা তার নেতাদের মাথায় নেই। বাস্তবতা ও কার্যকারণ সূত্রে অনিবার্য বান্ধব হয়ে থাকা জাসদের প্রতি আওয়ামী লীগ নেতাদের একাংশের এই বিরূপ মনোভাব কেন? হতে পারে, তারা মনে করছেন জাসদের কোনো প্রয়োজন নেই। যার প্রয়োজন নেই তাকে এত গুরুত্ব দেয়া কেন? ক্ষমতার ভাগ ও মন্ত্রিত্ব দেয়া কেন?
’৭২ থেকে ’৭৫ পর্যন্ত সময়ে জাসদের রাজনীতি ও তার ভূমিকা সম্পর্কে কমবেশি সবাই অবহিত। ওই সময় জাসদই ছিল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে শক্তিশালী ও সংগঠিত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। জাসদের ভুল রাজনীতি, সশস্ত্র লাইন, হঠকারী সিদ্ধান্ত ইত্যাদির যত সমালোচনাই করা হোক, সেদিন কেন আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ একটি রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন হয়েছিল, সেটা কিন্তু এড়িয়ে যাওয়ার মতো প্রশ্ন নয়। জাসদের অপরাজনীতি, সশস্ত্র লাইন ও অপরিণামদর্শিতা জাসদকেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে। দেশ এবং রাজনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই আলোচনার পাশাপাশি জাসদের উত্থানের পটভূমি ও কার্যকরণ আলোচনায় আসা উচিত। সেই আলোচনা হলে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আচরণ, ভূমিকা ও কার্যকলাপের কথাও অনিবার্যভাবে উঠে আসবে। জাসদের নেতারা এখন আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে রয়েছে। তাদের পক্ষে আওয়ামী লীগের সে সময়ের অপকর্ম ও নেতিবাচক ভূমিকার কথা তুলে ধরা হয়তো সম্ভব নয়। আবার নিরপেক্ষ গবেষকও তেমন নেই যারা এই আলোচনার অবতারণা করতে পারেন। আলোচনা করলে দেখা যাবে, জাসদের উদ্ভব ও উত্থানের পেছনে তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের বেপরোয়া আচরণ, কাজকর্ম ও ভূমিকা বিশেষভাবে দায়ী।
এ বিষয়ে বিস্তারিত কেন, সংক্ষিপ্ত আলোচনাও এ নিবন্ধের লক্ষ্য নয়। বিষয়টি উল্লেখ করার হেতু কেবল এটা স্মরণ করা যে, কোনো কিছুই একতরফা যায় না বা হয় না। জাসদের সমালোচনার সঙ্গে সঙ্গে সেই সময়কার ক্ষমতাসীনদের সমালোচনাও প্রাসঙ্গিক। মুদ্রার এপিঠ যেমন জানা দরকার তেমনি ওপিঠও জানা দরকার। তাহলেই জানাটা সম্পূর্ণ হবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট রচনায় জাসদের ভূমিকা আছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে সেটা তর্কের খাতিরে মেনে নিয়েও প্রশ্ন করা যায়, আওয়ামী লীগের কি কোনো ভূমিকা ছিল না?
যা হোক, রাজনীতিতে এমন অনেক কিছু হয় বা ঘটে যা বিস্ময়কর বলে প্রতিভাত হয়। এও বলা হয়, রাজনীতিতে শত্রু-মিত্র বলে কিছু নেই। আজ যে চরম শত্রু, কাল সে পরম মিত্র হয়ে উঠতে পারে। এ রকম নজির আমাদের দেশও কম নেই। আওয়ামী লীগ ও জাসদ এক সময় ছিল পরস্পরের প্রতিপক্ষ। একদল ওপর দলের বিনাশ বা ধ্বংস চাইতো। একের ওপর অন্যের প্রতিষ্ঠা ছিল তাদের কাম্য। পারস্পরিক হানাহানি, সংঘাত, হত্যা, সন্ত্রাস-কী না করেছে তারা! আবার এ দু’দলই নিজেদের প্রয়োজনে অতীতের তিক্ততা ভুলে জোট করেছে। প্রথমে দু’দল ১০ দলীয় জোটের শরীক ছিল। পরে ওই জোট ১৪ দলীয় জোটে রূপান্তরিত হয়। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এ জোট ভেঙে যায়। জাসদ সমমনাদের নিয়ে পাঁচ দলীয় জোট করে। আওয়ামী লীগ আট দলীয় জোটে শামিল থাকে। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাসদ ১৪ দলীয় জোটে একে অপরের সঙ্গী হয়। ২০০৯ সাল থেকে জাসদ সরকারেরই একটা অংশ।
কেউ কেউ মনে করেন, আওয়ামী লীগ আত্মগর্বী একটি দল। আত্মপ্রীতি তার মধ্যে প্রবল। এ কারণেই তার স্থায়ী বা দীর্ঘস্থায়ী মিত্র হয়ে কেউ থাকতে পারে না। প্রয়োজনে দলটি যে কাউকে মিত্র বলে বুকে টেনে নিতে পারে, আবার প্রয়োজন না মনে করলে দূরে ছুড়ে ফেলে দিতে মোটেই দেরী করে না। জাসদ- বিতর্কের শেষ পরিণতি কি দাঁড়াবে, কেউ বলতে পারে না। আওয়ামী লীগের একান্ত ইচ্ছার ওপরই তা নির্ভর করে। সৈয়দ আশরাফ কেবল আওয়ামী লীগের একজন নেতা বা মন্ত্রী নন, তিনি দলের সাধারণ সম্পাদকও। তার বক্তব্যকে কথার কথা বলে উপেক্ষা করা যায় না। একে তার ব্যক্তিগত বক্তব্য বলে গণ্য করাও ঠিক নয়। তার বক্তব্য থেকে মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে, মহাজোটের মধ্যে এক ধরনের টানাপোড়েন চলছে। বড় শরীক ছোট শরীকদের আর তেমন মূল্য দিতে চাচ্ছে না। এটা জোটের রাজনীতির খেলাপ। এতে জোট দুর্বল, এমন কি ভেঙেও যেতে পারে। তবে সব কথার এক কথা: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যা চাইবেন, তাই হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।