বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
উম্মতে মুহাম্মদের উৎকৃষ্ট গুণ বা পরিচিতি হচ্ছে ন্যায় কাজের আদেশ দান করা এবং অন্যায় কাজ প্রতিরোধ করা। এ প্রসঙ্গে আল কুরআনে এরশাদ হয়েছে- ‘তোমরাই হলো সর্বোত্তম উম্মত। তোমাদেরকে মানুষের কল্যাণ সাধনের জন্য পৃথিবীতে আবির্ভূত করা। তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে এবং অন্যায় ও পাপ কাজ হতে মানুষকে বিরত রাখবে। (সূরা আল ইমরান : আয়াত ১৬৮)।
বস্তুত: মানুষের জীবন বহুমুখী কর্মব্যস্ততার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ন্যায় কাজের আদেশ এবং অন্যায় কাজের প্রতিরোধ দিয়ে সকলেই যদি ব্যাপৃত হয়ে যায়, তাহলে রাষ্ট্রে, সমাজে ও জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে আসা স্বাভাবিক ব্যাপার। এই অভিপ্রেত অবস্থাকে সামাল দেয়ার জন্য আল্লাহপাক রাষ্ট্র, সমাজ ও জনগণের মধ্য হতে কতিপয় লোককে এ দায়িত্ব পালন করার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন। আল-কোরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘তোমাদের মধ্যে এমন কিছু লোক অবশ্যই থাকতে হবে যারা কল্যাণ ও মঙ্গলের দিকে আহ্বান করবে, ন্যায় ও সৎকাজের নির্দেশ দিবে এবং অন্যায় ও পাপ কাজ হতে বিরত রাখবে। যারা এ কাজ আঞ্জাম দেবে পরিণামে তারা সফল হবে।’ (সূরা আল ইমরান : আয়াত ১০৪)।
পরিবার, সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্র নারী ও পুরুষের দ্বারাই গঠিত হয় এবং এই উভয় শ্রেণীর লোকের দ্বারাই এই পৃথিবী ফুলে ফলে, রস গন্ধে, সুশোভিত হয়ে ওঠে। তবে নারী ও পুরুষের মধ্যে যারা ঈমানদার ও বিশ্বাসী তাদের মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্ব এবং গুণাবলী একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। এ প্রসঙ্গে আল-কোরআনে ঘোষণা করা হয়েছে, ‘অবশ্যই মুমিন পুরুষ ও মুমিন স্ত্রীলোক পরস্পর পরস্পরের দোসর, সঙ্গী ও বন্ধু। তারা যাবতীয় ভালো কাজের নির্দেশ দেয়, সকল অন্যায় ও পাপ কাজ হতে বিরত রাখে। (সূরা তাওবা : আয়াত ৭১)।
মুমিন নর এবং মুমিন নারীদের উচিত নম্রতা ও ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বন করা এবং মূর্খ লোকদের এড়িয়ে চলা। আল-কোরআনে এই বিশেষত্বটি এভাবে তুলে ধরা হয়েছে, ‘তোমরা নম্রতা ও ক্ষমাশীলতার নীতি অবলম্বন করো, সৎকাজের নির্দেশ দাও এবং মূর্খ ও অজ্ঞ লোকদের এড়িয়ে চলো।’ (সূরা আরাফ : আয়াত ১৯৯)।
ন্যায় কাজের আদেশ ও অন্যায় কাজে প্রতিরোধ না করার দরুন প‚র্ববর্তী উম্মত বনি ঈসরাইলের সদস্যরা কুফুরীর পথে গা ভাসিয়ে দিয়েছিল এবং হযরত দাউদ আ. ও হযরত ঈসা আ.-এর প্রতি বিদ্রোহ প্রকাশ করেছিল। এতে তারা খুবই বাড়াবাড়ি করেছিল এবং পরস্পরকে পাপ কাজ হতে বিরত না রেখে অত্যন্ত জঘন্য কর্মপন্থা গ্রহণ করেছিল। আল-কোরআনে তাদের এই পাপের কথা এভাবে তুলে ধরা হয়েছে, ‘বনী ইসরাইলের মধ্যে যারা কুফরির পথ অবলম্বন করেছে, তাদের প্রতি দাউদ ও ঈসা ইবনে মরিয়ম এর জবানিতে অভিশাপ বর্ষণ করা হয়েছে। কারণ তারা বিদ্রোহী হয়ে পড়েছিল এবং অত্যন্ত বাড়াবাড়ি শুরু করে দিয়েছিল। তারা একে অপরকে পাপ কাজ হতে বিরত রাখা পরিহার করে ছিল, অত্যন্ত জঘণ্য কর্মপন্থাই তারা অবলম্বন করেছিল।’ (সূরা মায়েদা : আয়াত ৭৮-৭৯)।
আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত নবী মুহাম্মদ সা. কে ন্যায় কাজের আদেশ ও অন্যায় কাজের প্রতিরোধ করার সার্বিক দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন। তিনি বিশ্বনবীকে সরাসরি বলে দিয়েছেন, হে নবী, যে জিনিসের হুকুম আপনাকে দেয়া হচ্ছে তা উচ্চকণ্ঠে জানিয়ে দিন। (সূরা হিজর : আয়াত ৯৪)।
তবে, যারা কুফরীতে নিমগ্ন হবে তারা যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির হাত হতে রেহাই পাবে না। আল-কোরআনে ঘোষণাই জারি করা হয়েছে- ‘আমি এমন লোকজনদেরকে মুক্তি প্রদান করলাম, যারা খারাপ কাজ হতে বিরত থাকত। যারা সীমালঙ্ঘনকারী জালেম ছিল তাদেরকে তাদের বিপর্যয়মূলক কাজের জন্য কঠিন আযাবে পাকড়াও করলাম। (সূরা আরাফ : আয়াত ৯৫)।
হাদীস শরীফে ন্যায় কাজের আদেশ ও অন্যায় কাজে প্রতিরোধের বিষয়টি খোলসা করে বয়ান করা হয়েছে। হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা: হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা. কে বলতে শুনেছি, তোমাদের মধ্যে কেউ যখন কোনো খারাপ কাজ হতে দেখে সে যেন হাত দিয়ে তা বন্ধ করার প্রচেষ্টা চালায়, যদি সে ক্ষমতা না রাখে তবে যেন মুখের ভাষা দ্বারা তা বন্ধ করে দেয়, যদি সে এতোটুকু ক্ষমতাও না রাখে তবে যেন সে অন্তরের ধারা তা ঘৃণা করে। আর এটা হল ইমনের দুর্বলতম স্তর। (সহিহ মুসলিম)।
এই হাদিসে ঈমানের দুর্বলতম স্তরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই স্তরে অবস্থানকারীরা মুমিন থাকবে কি-না এই সন্দেহের নিরসন করেছেন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সা.। হযরত ইবনে মাসউদ রা: হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন. আমার পূর্বে কোনো জাতির নিকট যে নবীকেই পাঠানো হয়েছে, তার সহযোগিতার জন্য তার উম্মতের মধ্যে একদল সাহায্যকারীও নির্ধারণ করা হতো। তারা তার সুন্নতকে আঁকড়ে ধরত এবং তার নির্দেশ অনুসরণ করত। তাদের পরে এমন কিছু লোকের উদ্ভব হলো, নবীরা যা বলতো তা নিজেরা করত না এবং এমন কাজ করতো যা করার নির্দেশ দেয়া হয়নি। অতএব, এই শ্রেণীর লোকদের বিরুদ্ধে যে ব্যক্তি হাত দিয়ে জিহাদ করবে সে মুমিন, যে ব্যক্তি মুখ দিয়ে এদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে সেও মুমিন, আর যে ব্যক্তি অন্তর দিয়ে এদের বিরুদ্ধে জিহাদ করবে সেও মুমিন বলে গণ্য হবে। এরপর আর সরিষার দানা পরিমাণও ঈমানের স্তর নেই। (সহীহ মুসলিম)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।