বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
আল্লাহপাক মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদত করার জন্য। তাঁর ফরমাবরদারী করার জন্য। তাঁর হুকুম পালন করার জন্য। তাঁর রেজামন্দি হাসিল করার জন্য।
উপরোক্ত কাজগুলো করার জন্য আল্লাহপাক মানুষকে অসহায়ভাবে ছেড়ে দেননি। তিনি অত্যন্ত দয়া পরবশ হয়ে যুগে যুগে পাঠিয়েছেন নবী-রাসূল এবং হুকুম-আহকাম সম্বলিত কিতাব ও ছহিফা। নবী-রাসূলগণ আল্লাহপাকের নির্দেশে নির্দেশিত হয়ে মানুষদের হেদায়েতের পথপ্রদর্শন করেছেন। কীভাবে ইবাদত করতে হবে, কী পথ অবলম্বন করলে আল্লাহপাক রাজি হবেন, তিনি খুশি হবেন, বান্দাকে পুরস্কৃত করবেন- সব কিছুই বিস্তারিতভাবে বর্ণনা এবং নিজে অনুশীলনের মাধ্যমে দেখিয়ে গেছেন। নবী-রাসূলগণ যেসব আসমানী কিতাব অনুসরণ করেছেন সেগুলো আজও আছে। তবে পবিত্র কোরআন নাজিল হওয়ার পর ঐ সব কিতাবের অনুকরণ রহিত হয়ে গেছে। এখন আসমানী কিতাবের মধ্যে একমাত্র পবিত্র কোরআনই কিয়ামত পর্যন্ত অবিকৃত অবস্থায় থাকবে এবং সমস্ত মানুষের পথ-নির্দেশিকা হিসেবে বলবৎ থাকবে। কাজেই পবিত্র কোরআনের প্রতিটি হুকুম মানা বান্দার উপর ফরজ।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বিভিন্ন জাতির বর্ণনা দিয়েছেন। এর মধ্যে যারা আল্লাহপাকের হুকুম পালন করেছেন, তাদেরকে কীভাবে পুরস্কৃত করেছেন এবং যারা তাঁর নাফরমানী করেছে, তাদেরকে কীভাবে শাস্তি দিয়েছেন, এগুলোও বান্দাকে সতর্কতা অবলম্বনের জন্যে আলোচনা করেছেন। যেসব জাতির কথা আল্লাহপাক বলেছেন, তাদের মধ্যে একটি নাফরমান জাতি হল সাবা।
কউমে সাবা : ইয়ামেন সম্রাট বা সে দেশের অধিবাসীদের উপাধি ছিল ‘সাবা’। ইমাম আহমদ (রহ.) হযরত এবনে আব্বাস থেকে বর্ণনা করেন, জনৈক ব্যক্তি হুজুরে পাক (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, কোরআনে উল্লেখিত ‘সাবা’ কোন পুরুষের নাম, নাকি নারীর নাম, না কোন ভূখন্ডের নাম? রাসূল (সা.) বললেন, সাবা একজন পুরুষের নাম। তার দশটি পুত্র ছিল। তন্মধ্যে ছয়টি ইয়েমেনে এবং চারজন শাম দেশে বসতি স্থাপন করে। তাদের ঔরসজাত সন্তান শাম ও ইয়েমেনে বিস্তার লাভ করে এবং তারাই সাবা নামে পরিচিত। সাবার আসল নাম ছিল ‘আবদে শামস’। ইতিহাসবিদগণের মতে সাবা ছিলেন ধর্মপরায়ণ অতি নেকবখত। তিনি তাওরাত এবং ইনজিলের পন্ডিত ছিলেন। তিনি শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহ আলাইহি অসাল্লাম-এর আগমনের সুসংবাদ মানুষকে দিয়েছেন। তিনি হুজুরে পাক (সা.)-এর শানে আরবিতে কয়েক লাইনের একটি কবিতাও রচনা করেছিলেন। সে কবিতায় হুজুর (সা.)-এর অবির্ভাবের সুসংবাদ ছিল এবং তিনি বাসনা প্রকাশ করেছিলেন যে, আমি যদি জীবিত থাকি তাহলে তাঁকে সাহায্য করতাম। আমি এবং আমার সম্প্রদায়কে নিয়ে তার প্রতি ঈমান আনতাম।
তাবাবেয়া সম্প্রদায় এবং রানী বিলকিস সাবা সম্প্রদায়েরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। আল্লাহপাক তাদের প্রতি রাজি ছিলেন। তাদের সম্প্রদায়ে ১৩ জন নবী এসেছিলেন। দীর্ঘকাল পর্যন্ত আল্লাহর প্রতি ঈমান তাদের মজবুত ছিল। আল্লাহপাক তাদের সুখ-শান্তির সকল প্রকার উপকরণাদি দিয়ে সাহায্য করেছিলেন।
ইবনে কাসীরের মতে, ইয়েমেনের রাজধানী সানা থেকে তিন মঞ্জিল দূরে মাআরেব নগরীতে ছিল, সাবা সম্প্রদায়ের বসতি। এই নগরীর দুই দিকে ছিল দুইটি পাহাড়, তারা পাহাড় থেকে নেমে আসা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্যে মজবুত একটি বাঁধ নির্মাণ করেছিলেন। এই বাঁধের উপর থেকে নিচে তিনটি গেইট ছিল। এখান থেকে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে নগরে এবং তাদের বাগানে পানি সরবরাহ করা হতো। এই বাঁধ থেকে তারা বারটি খাল তৈরি করে পানির যোগান দিত। এই খালগুলোর দুই কিনারায় প্রচুর ফলের বাগান গড়ে ওঠে। সেগুলোতে এতো বেশি ফলন হতো যে, একটি মানুষ যদি মাথায় করে একটি খালি টুকরী (ঝুড়ি) নিয়ে গাছের নিচ দিয়ে যেতে থাকতো, কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা যেত যে, তার টুকরী ফলে ভরে গেছে। ফল পাড়ার আর প্রয়োজন হতো না। আল্লাহপাকের আনুগত্য ও কৃতজ্ঞতার জন্য আল্লাহপাক তাদের প্রতি অত্যন্ত প্রসন্ন ছিলেন। আল্লাহপাক তাদের শহরের আবহাওয়াকে করেছিলেন স্বাস্থ্যসম্মত ও বিশুদ্ধ। মশা-মাছি, সাঁপ-বিচ্ছু বা কোনো প্রকার প্রাণী এই শহরে ছিল না। বাইরে থেকে কোন ব্যক্তি কাপড়ে বা শরীরে করে কোন পোকা-মাকড় বা উকুন নিয়ে এলে এই শহরে প্রবেশের সাথে সাথে এগুলো মরে যেত। অর্থাৎ, প্রাচুর্য আরাম-আয়েশের কোন কমতি ছিল না। আল্লাহপাকের এই অশেষ নিয়ামত পেয়ে আস্তে আস্তে আল্লাহকে তারা ভুলে যেতে থাকল, অবশেষে অস্বীকারই করে বসলো। নবী-রাসূলগণের কথাও অগ্রাহ্য করতে আরম্ভ করল। তারা নিজেরাই এই বলে দোয়া করতে আরম্ভ করল, ‘হে আমাদের প্রভু! আমাদের পথের দূরত্ব সৃষ্টি করে দিন। নিকটবর্তী কোনো গ্রাম যেন না থাকে। ভ্রমণ পথে কিছু জঙ্গল জনমানবহীন প্রান্তর করে দিন। যাতে কিছু কষ্ট সহ্য করতে হয়। অর্থাৎ বনি ইসরাইলরা ‘মান্না সালওয়া’ খেতে খেতে যেমন বলেছিল, এই খাবার আমাদের আর ভাল লাগে না। আমাদের শাক-সবজি, তরিতরকারী, আদা, জিরা দান করুন। আল্লাহপাক তাদের না-শুকরীর কারণে ফলমূলের বরকত ও স্বাদ তুলে নিলেন, পরিশেষে বাধভাঙা বন্যা দিয়ে সব কিছু ধ্বংস করে দিলেন।’
উপরোক্ত ঘটনা বর্ণনা করে আল্লাহপাক বান্দাকে সতর্ক করে দিলেন যে, ‘হে বান্দা! তোমাদেরকে ঐশ্বর্য দান করলে তার শুকরিয়া আদায় করা তোমাদের উপর ফরজ। তবে মনে রেখো আমি ঐশ্বর্য দিতেও পারি, নিয়েও যেতে পারি।
আল্লাহপাক যদি কাউকে সরিয়ে দিতে চান, তাহলে কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না। এক ব্রিটিশ মন্ত্রী যেমন গাড়ীতে বসে তার দেহরক্ষীকে প্রশ্ন করেছিলেন যে, বল তো আমাকে কেউ মেরে ফেলতে চাইলে তুমি কি আমাকে রক্ষা করতে পারবে? দেহরক্ষী অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে জবাব দিয়েছিল, ‘না’। তখন মন্ত্রী তাকে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে তুমি বসে আছ কেন? তখন সে বললো, আপনাকে যদি কেউ মেরে ফেলে, তাহলে বিচারের জন্যে একজন সাক্ষীর প্রয়োজন পড়বে। আমি সেই সাক্ষী। আল্লাহপাক বলেন? তুমি যেখানেই থাক, মৃত্যু তোমার নিকট পৌঁছবেই। তুমি যদি সুরক্ষিত দুর্গেও বাস কর (সূরা-নিসা : আয়াত-৭৮)। কাজেই মৃত্যু থেকে কেউই রেহাই পাবে না। আল্লাহর বিচার থেকেও কেউ রেহাই পাবে না। কওমে সাবার ভাগ্যবরণ করা থেকে আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন। আমীন।
[আলহাজ মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.)-এর রচনাবলী হতে সংগৃহীত]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।