বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসা, মায়া-মমতা, স্নেহ, অনুরাগ মানব জীবনের অন্যতম ভ‚ষণ। যে মানুষের মাঝে প্রেম নেই, প্রীতি নেই, ভালোবাসা নেই, মায়া-মমতা নেই, স্নেহ নেই, অনুরাগ নেই, তার আকার-আকৃতি, চলাফেরা ও রং-রূপ মানুষের মত হলেও তাকে মানুষ বলা যায় না। বরং সে এমন কঠিন প্রস্তর, যার মাঝে কখনো ফাটল দেখা দেয় না। তার অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না। এমনকি মানবিক সৎগুণাবলীর আলোকচ্ছটা তার জীবনের কোনো অঙ্গনেই পরিদৃষ্ট হয় না। আর হয় না বলেই, সে মানবরূপী একটা এমন কঠিন শিলা, যেখানে কোনো কিছুর অঙ্কুরোদগম একান্তই অসম্ভব।
আমি যখন ১৯৬২ সালে ঢাকা মাদ্রাসা-ই আলিয়ায় কামিল হাদিস বিভাগের ছাত্র ছিলাম তখন তাফসিরে কাশশাফ পাঠদানের সময় তৎকালীন দুনিয়ার আরবি ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম দিকপাল হযরতুল আল্লামা আব্দুর রহমান আল কাশঘরী রহ. ভালোবাসার ব্যাপারটি বোঝানোর জন্য দু’লাইন আরবি কবিতা উচ্চারণ করেছিলেন, যা আমার মন মগজে এখনো ঝলঝল করে জ্বলছে। লাইন দু’টি হলো এই, ‘ইজা কানা হুব্বুল হাইমীনা মিনাল ওয়ারা, বিলাইলী ও সালমা ইয়ছলুবুললুব্বু ওয়াল আকলা’। ফামাজা আছা আইয়াফ আলাল হায়িমুল্লাজি, ছারা কালবুহু শাওকান ইলাল আলামিন আ’লা। অর্থাৎ, লাইলী এবং সালমার ভালোবাসাই যখন দুনিয়ার মানুষকে উদভ্রান্ত পাগল বানিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে, তখন সে আল্লাহ প্রেমিক কি-না করতে পারে, যা তৃষিত অন্তর প্রকৃত প্রেমাষ্পদ আল্লাহপাকের প্রেমের টানে ঊর্ধ্বজগতে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়।
আমরা দেখতে পাই, লাইলির প্রেম কায়েস নামের ছেলেকে মজনু অর্থাৎ পাগল বানিয়ে ছেড়েছে। ধন-সম্পদ ও বিত্ত-বিভবের মোহ কারুনকে চিরতরে ভ‚-গর্ভে লিন করেছে। মান-মর্যাদা, শৌর্য-বীর্য ও ক্ষমতার মোহে ফেরাউন নীল নদে ডুবে মরেছে। অপরদিকে সাইয়্যেদুশ শুহাদা হযরত হামজা রা., হযরত জাফর তাইয়্যার রা., আরেফ বিল্লাহ হযরত হানযালা রহ. মহান আল্লাহপাক ও তার প্রিয় হাবিব মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সা. এর প্রেমে আত্মসমর্পণ করে জামে-শাহাদাত পানে পরিতৃপ্ত হয়েছেন। এই দুই শ্রেণীর প্রেমিকদের মাঝে কতনা পার্থক্য, কতনা ফরাক বিদ্যমান। তাদের একদল বিফল, ভগ্নমনোরথ ও অকৃতকার্য। অপরদল সৌভাগ্যশালী ও সফলতা লাভে ধন্য হয়েছে। যারা সফলকাম হয়েছে, তাদের মাঝে ছিল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি নির্মল ভালোবাসা। যেমনটি আমরা আসাদুল্লাহ হযরত আলী রা. এর মাঝে দেখতে পাই। তিনি আল্লাহ তার প্রিয় নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভালোবাসার গহীন সমুদ্রে নিজেকে বিলীন করে দিয়েছিলেন। তার প্রশংসায় বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্টই বলেছেন, ‘আলী এমন এক ব্যক্তি, যে আল্লাহ তার রাসূলকে ভালোবাসে এবং তাকে আল্লাহ তাঁর রাসূল ভালবাসেন। আলহামদুলিল্লাহ, প্রকৃত ভালোবাসা তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর সাথে হওয়া উচিত। যা আমরা আল্লাহর ওলীদের মাঝে এবং তার প্রিয় বান্দাদের মাঝে লক্ষ্য করে থাকি। তারা এ দুইয়ের ভালোবাসার মাঝে প্রকৃত সুখ ও শান্তি খুঁজে পেয়েছেন। মূলত ওই সকল ব্যক্তি প্রকৃত ভাগ্যবান, যারা আল্লাহর মহব্বত লাভ করাকে নিজেদের জীবনের চরম ও পরম উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করেছে। তাদের সম্পর্কে মহান রাব্বুল আলামিন আল-কুরআনে এই শুভ সংবাদ প্রদান করেছেন, এরশাদ হয়েছে, ‘তিনি আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন এবং তারাও তাকে ভালবাসে। (সূরা আল মায়েদা : আয়াত ৫৪)।
এ আয়াতে কারীমার অর্থ ও মর্মের প্রতি গভীর দৃষ্টিতে তাকালে অবাক না হয়ে পারা যায় না। কেননা, আল্লাহর ওলী ও প্রিয় বান্দাগণ আল্লাহকে ভালোবাসবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ, আল্লাহপাক তাদের সৃষ্টি করেছেন, রিযিক প্রদান করেছেন, কিতাব ও নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে সৎপথ প্রদর্শন করেছেন, দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবকিছুই প্রদান করেছেন। এতকিছুর পর আল্লাহপাক তাদেরকে ভালোবাসবেন। মায়া করবেন, এটা কেন? এর হেতু কি? হ্যাঁ, এর হেতু আছে, কারণ আছে। এর কারণ হলো এই যে, ভালোবাসা একতরফা হয় না। এখানে প্রেমিক এবং প্রেমাষ্পদ উভয়েরই দরকার। আল্লাহর ওলী ও প্রিয় বান্দাগণ প্রেমিক এবং আল্লাহ পাক প্রেমাষ্পদ। তাই তিনি প্রেমিকের প্রেম নিবেদন সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেন না। আর পারেন না বলেই তিনি প্রেমিককে ভালোবাসেন। দোয়া ও করুণার শামিয়ানার নিচে স্থান দান করেন। সুবহানাল্লাহ!
আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত ঈমানদার বান্দাগণ কে তার সাথে ভালোবাসা স্থাপন করার সহজ পথ প্রদর্শন করেছেন। এর উপায় হলো তার প্রিয় হাবিব মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ভালোবাসা। এপ্রসঙ্গে আল-কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, হে মুহাম্মদ সা., আপনি বলে দিন। যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসতে চাও, তাহলে তোমরা আমার অনুসরণ কর, তবে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন। (সূরা আল ইমরান : আয়াত ৩১)। এই আয়াতের দ্বারা বোঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সা. এর অনুসরণ ছাড়া আল্লাহপাকের ভালোবাসা লাভ করা যায় না। কিন্তু রাসূলবিদ্বেষী ইহুদী ও খ্রিস্টানরা দাবি করে যে, তারা আল্লাহর সন্তান ও প্রিয়ভাজন। তাদের মিথ্যাবাদীকে ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছে আল্লাহ পাকের এই বাণী। এরশাদ হয়েছে, ‘আর ইহুদী ও খ্রিস্টানরা বলে আমরা আল্লাহর সন্তান ও প্রিয়ভাজন। আপনি বলে দিন, তবে তিনি তোমাদের পাপের কারণে তোমাদেরকে শাস্তি দিবেন কেন? বরং তোমরা তাঁর সৃষ্টির অংশ মাত্র, তিনি যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন ও যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন।’ (সূরা মায়েদা : আয়াত ১৮)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।