Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে তালেবান

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১২ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

আফগানিস্তানের তালেবানরা আবারো একটি জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে। তাদেরকে এমনভাবে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করতে হবে, যাতে খুব বেশি শক্তি ক্ষয় না করেই লক্ষ্য অর্জিত হয়। এতদিন পর্যন্ত তালেবান নেতৃত্বের ধারণা ছিল, শান্তি প্রক্রিয়ায় তাদের জয় হবে। প্রকৃতপক্ষে, তারা জয়ের অনুভ‚তি নিয়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনা শুরু করেছিল এবং নিজেদেরকে কঠিন প্রতিপক্ষ হিসেবে তুলে ধরেছিল।
বিজয়ী ‘সেনাবাহিনীর’ মতো কাবুলের রাস্তায় প্রবেশের জন্য তারা পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল, কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শেষ মুহূর্তে ক্যাম্প ডেভিডে তালেবান প্রতিনিধি দলের সাথে তার ‘গোপন’ বৈঠক বাতিল করায় তাদের সে স্বপ্ন ভেঙে যায়। এই বেঠকেই দু’পক্ষের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তি সম্পন্ন হবে বলে আশা করেছিলেন অনেকেই। এটিই সম্ভবত বর্তমান তালেবান নেতৃত্বের সবচেয়ে দুর্বল মুহূর্ত। তারা চুক্তি সম্পাদনের খুব কাছাকাছি ছিল।
অনেকে আশঙ্কা করেছিলেন যে, শান্তি প্রক্রিয়াটি ভেঙে পড়তে পারে। তালেবানরা সম্ভাব্য সমস্ত উপায়েই আর্ন্তজাতিক সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছে। এজন্য তারা মস্কো, বেইজিং এবং বিশেষ করে ইসলামাবাদেও গিয়েছিল। কিন্তু সবাই তাদেরকে শান্তি প্রক্রিয়ায় ফিরে আসার পরামর্শ দেয়। তালেবানরাও পরামর্শ মেনে নিয়েছিল। যে কারণে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আগের মতো সহিংসতা তারা এবার দেখায়নি। এর মাধ্যমে তারা ইঙ্গিত দিয়েছিল যে, শান্তি আলোচনা আবার শুরু হলে তালেবান মিলিশিয়া সহিংসতার মাত্রা কমিয়ে আনতে প্রস্তুত।
স্পষ্টতই, তালেবানরা এখনও শান্তি-পরবর্তী সময়ের জন্য কোন কার্যকর কৌশলের পরিকল্পনা করে উঠতে পারেনি, যার মাধ্যমে তাদের সামরিক শক্তি রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তরিত হবে। এ পর্যন্ত তারা বিদেশী সেনা প্রত্যাহার ও আফগানিস্তানের অন্যান্য নিয়ন্ত্রক শক্তির সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করার ব্যাপারেই জোর দিয়েছে। সহজেই একটি চুক্তিতে আসা এবং ক্ষমতায় ভাগ বসানো নিয়ে তারা আত্মবিশ্বাসী ছিল। এটি হলে তারা গ্রামাঞ্চল থেকে তাদের যোদ্ধাদের শহরে আনতে পারত। কিন্তু রাজনৈতিক প্রক্রিয়াগুলো নিজস্ব গতিতেই চলে।
মোল্লা বরাদারের নেতৃত্বে তালেবান প্রতিনিধিদল সম্প্রতি ইসলামাবাদ সফর করেছিল। সেখানে তারা প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কুরেশির সাথে সাক্ষাতের পাশাপাশি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছে, যা তালেবানদের অবস্থান আরো নমনীয় হয়েছে বলে ইঙ্গিত দেয়। তবে আফগানিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জালময় খলিলজাদের সাথে বৈঠকটি আরো তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এই ঘটনাগুলো শান্তি প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করার ইঙ্গিত দেয় বলে মনে হলেও একজন মার্কিন কর্মকর্তা সরাসরি এই সম্ভাবনা বাতিল করেছেন। এটা স্পষ্ট যে, আমেরিকা নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে চায় যে, কখন আলোচনা আবার শুরু হবে।
তালেবানরা যেখানে এসে ব্যর্থ হয়েছিল সেখান থেকেই আবার শুরু করবে, নাকি উভয় পক্ষই নির্দিষ্ট শর্তাবলী পুনর্বিবেচনা করবে, তা নিশ্চিত নয়। আমেরিকা যুদ্ধবিরতিতে জোর দিতে এবং সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব পরবর্তী আফগান প্রশাসনের উপরে ছেড়ে দিতে পারে। তবে তালেবানরা দুই পক্ষের সম্মতিতে করা খসড়া চুক্তির যে কোনও পরিবর্তন প্রতিহত করবে। সেক্ষেত্রে, পাকিস্তান তাদেরকে পুনরায় আলোচনায় বসার জন্য অনুরোধ করবে কিনা সেটা নিশ্চিত নয়।
তালেবানকে চাপে ফেলার জন্য ট্রাম্প ইচ্ছাকৃতভাবেই বৈঠক বাতিল করে থাকতে পারেন। সে ক্ষেত্রে, আপাতত তার এই প্রচেষ্টা কার্যকর বলেই প্রমাণিত হয়েছে। তবে আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও সীমিত বিকল্প রয়েছে। একতরফাভাবে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে অভ্যন্তরীণ একাধিক গোষ্ঠীর মধ্যে দ্ব›দ্ব আরো তীব্র হবে এবং নিয়ন্ত্রণ নিতে বহিরাগত শক্তিগুলো উৎসাহিত হবে। যদিও স্থিতাবস্থাটি কাবুলের পক্ষে উপযুক্ত, তবে এটি যুদ্ধের অবসান ঘটাচ্ছে না। আফগানিস্তানের সরকারের একমাত্র বিকল্পটি হল, তালিবান সহ অন্যান্য শক্তিগুলোর সাথে সমঝোতা করা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তালেবানদের চাপে রাখতে চুক্তি বিলম্বিত করার কৌশল অব্যাহত রাখতে পারবে না। তবে ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে যা হচ্ছে তার কারণে পাকিস্তানের অবস্থান অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে। ফলে আফগান শান্তি প্রক্রিয়াতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই তারা সর্বাত্মক সমর্থন জানাতে ইচ্ছুক বলে মনে হয়। বিনিময়ে, পাকিস্তান চায় ভারতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সময় আমেরিকার সাথে তাদের ভ‚-অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সহায়তা একীভ‚ত করতে। বর্তমানে আর্ন্তজাতিক ক্ষেত্রে কাশ্মীর পরিস্থিতি তুলে ধরার প্রচেষ্টায় তাদের যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন প্রয়োজন। ট্রাম্প যদি মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেয়া অব্যাহত রাখেন, তবে তাদের উদ্দেশ্য পূরণ হবে এবং ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি হবে।
এদিকে, চীনও আফগানিস্তানের পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। একতরফা মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হলে চীনের জন্য তা দুঃসংবাদ হবে। এ কারণে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তালেবানদের মধ্যে শান্তি প্রক্রিয়াটিকে পুরোপুরি সমর্থন করে। আফগানিস্তানের সংঘাত নিরসনে চীন কোনও নেতৃত্বের ভ‚মিকা নিতে প্রস্তুত নয়। তাদের আশঙ্কা, শান্তি প্রক্রিয়াটি ভেঙে পড়লে তার প্রভাবে আফগান সীমান্ত সংলগ্ন চীনা প্রদেশ জিনজিয়াংয়ের সমস্যাগুলি আরো বেড়ে যাবে।
আফগানিস্তানের সংঘাত সমগ্র অঞ্চলটিকেই অস্থিতিশীল করতে পারে, একইভাবে চীনা বেল্ট এবং রোড ইনিশিয়েটিভেও প্রভাব ফেলতে পারে। তবে চীনা বিশেষজ্ঞরা সিপিসিইকে নিয়ে বেশি চিন্তিত। যে কোনও আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা এই উদ্যোগকে ক্ষতিগ্রস্থ করবে এবং উদীয়মান আঞ্চলিক ভ‚-অর্থনীতিতে পাকিস্তান তার ভ‚-কৌশলগত সুবিধা হারাবে।
পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সম্প্রতি চীন সফর করেছেন। সিপিসি-সম্পর্কিত বিষয়গুলি ছাড়াও তিনি চীনা নেতৃত্বের সাথে আফগানিস্তানের শান্তি প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন। আপাতত মনে হচ্ছে দু’পক্ষই তালেবানকে আফগানিস্তানের শান্তি প্রক্রিয়ার মধ্যে রাখতে আগ্রহী। যদি তালেবান এমনকি সাময়িক যুদ্ধবিরতিতেও সম্মত হয় তবে এটি সবার পক্ষে একটি দুর্দান্ত অর্জন হবে। তবে তালেবানদের আরো একটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে; শান্তি প্রক্রিয়ার প্রথম পর্যায়ের পরে তারা যে জয় দাবি করেছিল, তা অর্জিত হবে বলে তাদের যোদ্ধাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে। এখনো খুব বেশি কিছু না হারালেও, তালেবানদের ভাগ্য তাদের ভবিষ্যতের পরিকল্পনার উপরেই নির্ভর করছে। সূত্র : ডন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ