বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
বাতাস ভরা বেলুন বা রঙিন ফানুসের মতো মানুষ তার দুর্বলতা ও অসহায়ত্বের ব্যাপারে ধারণাও করতে পারে না। ক্ষমতা, শক্তিমত্তা, অর্থ-সম্পদ ও খুঁটির জোর তাকে বেহুঁশ করে ফেলে। সে আন্দাজ করতে পারে না যে, তার পায়ের নিচে মাটি আছে কি না। দম্ভ অহঙ্কার ও শক্তি তাকে মাটিতে পা ফেলতে দেয় না। সে তখন পারে তো আকাশে উড়ে। দুনিয়ার অন্যতম পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানকে বিশ্বের প্রথম বা দ্বিতীয় সুরক্ষিত ব্যক্তি বলে মনে করা হতো। তাকে আঘাত করা তো দূরের কথা, তার এলাকার আকাশ দিয়ে প্রতিরক্ষার অগোচরে কোনো কিছু উড়েও যেতে পারতো না। স্বাভাবিক অবস্থায়ও থাকতো চার পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা। সেই প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভকে একদিন তার নিরাপত্তারক্ষীরা আবিষ্কার করল, তিনি ক্রেমলিনের প্রেসিডেন্সিয়াল অফিসে নিজ আসনে বসে টেবিলে মাথা রেখে মরে পড়ে আছেন।
তিনি ছিলেন নাস্তিক। মালাকুল মাওত বা আত্মায় বিশ্বাস করতেন না। নিñিদ্র নিরাপত্তা ভেদ করে মৃত্যুর ফেরেশতা তাকে তুলে নেয়ার জন্য হাজারও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেদ করে যখন কর্মরত অবস্থায় তার রুহ কবজ করল, নিঃসন্দেহে তখন তিনি আস্তিকও হয়ে গিয়েছিলেন। শুধু তাই না, ফেরাউনের মতো পানিতে ডুবে মৃত্যু নিজ চোখে অবলোকন করে সে যেমন আল্লাহর ওপর ঈমান এনেছিল, ধারণা করা যায়, ব্রেজনেভও এমনই কিছু করে থাকবেন।
ঈমানদার শাসকরা এসব মিথ্যা ক্ষমতা আর পানির বুদবুদের মতো শক্তি সামর্থ শুরু থেকেই বুঝতে পারেন। তারা অহঙ্কার, দম্ভ, বড়াই তো করেনই না, বরং সবসময় আল্লাহর ভয়ে কম্পমান থাকেন। এজন্য তাদের দ্বারা হারাম কাজ, অন্যায়, দুর্নীতি, শোষণ ও সীমালঙ্ঘন হয় না। ভারতবিজয়ী প্রতাপান্বিত গজনীর সুলতান মাহমুদ সামরিক নিয়মে প্রচুর অর্থ সম্পদের মালিক হন। ভারতের নানা স্থান থেকে টন কে টন সোনা তার রাজকোষে জমা হয়। জীবনভর এসব তিনি তার সৈনিকদের বেতন, দেশের উন্নয়ন ও জনকল্যাণে ব্যয় করেন।
জীবনের শুরুতে তার পিতা সুবক্তগিন ছিলেন বেকারী মালিক। রুটি, বিস্কিট, কেক ইত্যাদি বিক্রি করতেন। একসময় তিনি গোষ্ঠির সরদার ও স্থানীয় শাসক হন। সুলতান মাহমুদ যখন ১৭ বার অভিযান চালিয়ে প্রায় আধা দুনিয়া জয় করে নেন, তখনও তিনি তার বিশ্বস্ত খাদেম আয়াজকে ভুলেননি। আয়াজ যদিও ভৃত্যের মতোই তার সাথে থাকতো, কিন্তু মূলত সে ছিল একজন দরবেশ প্রকৃতির লোক। এক হিসাবে সুলতানের সহকারী ও উপদেষ্টা।
আয়াজ বর্ণনা করেন, এ বিষয়টি আমি ছাড়া আর কেউ জানে না। আজ তোমাদের বলছি, প্রতিদিন ইশার পর সুলতান মাহমুদ তার প্রাসাদের এক নিভৃত কক্ষে চলে যান। এখানে ফজর পর্যন্ত ইবাদতে কাটান। তখন তিনি সুলতান হওয়ার আগে একজন অতি সাধারণ মানুষ হিসাবে যে জামাটি গায়ে দিতেন, ইবাদতখানায় ঢুকেই তিনি রাজকীয় সব পোষাক পরিবর্তন করে ওই ফকিরি জামাটি পরে নিতেন। আবার ফজরের জামাতে আসতেন, সুলতানের পোশাকে।
বিষয়টি সম্পর্কে আমি একবার জানতে চাইলে সুলতান আমাকে বলেন, মানুষ হিসাবে ক্ষমতা ও সম্পদ আমাকেও জালিম বা অহঙ্কারী করে তুলতে পারে। তাই, সারারাত আমি নিজের আত্মপরিচয় সন্ধান করি, আগের ফকিরি জামাটি পরে সর্বশক্তিমান আল্লাহর দরবারে বিনয় ও কাকুতি মিনতিসহ শোকরিয়া আদায় করি। ভাবি, যিনি আমাকে আগের অবস্থা থেকে বর্তমান অবস্থায় এনেছেন, তার পক্ষে আমাকে ধ্বংস ও অসহায়ত্বের অতলান্তে নিক্ষেপ করা কতই না সহজ। একটি পলকের মধ্যে তিনি আমাকে পাকড়াও করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারেন। সুলতান নিজে কোনো সভাসদ বা নতুন বন্ধু-বান্ধবকে এত কাছে টানতেন না, যতটা তিনি পুরনো কাজের লোক দরবেশ আয়াজকে টানতেন।
কবি ইকবাল এ কথাটি বলেছেন, যখন আল্লাহকে সেজদা করার সময় হয়ে যায়, তখন নিরহংকার সুশাসক মুসলিম বাদশাহরা এমন হয়ে যান, যার নজির অন্য কেউ দেখাতে পারে না। ‘এক হি সফ মে খাড়ে হো গায়ে মাহমুদ ও আয়াজ। না কোয়ি বান্দা রাহা, না কোয়ি বান্দা নাওয়াজ।’ এই মাহমুদ গজনবী সম্পর্কে দুশমনরা ইতিহাসের নাম দিয়ে যা ইচ্ছা তাই লিখে পাতার পর পাতা ভরে রেখেছে। সত্য ইতিহাস ও বাস্তব জীবনকথা খুব কম মানুষই জানে বা চর্চা করে।
সুলতান মাহমুদের যখন মৃত্যুর সময় এলো তিনি তার হাতে রয়ে যাওয়া সব অর্থ সম্পদ খাদেমদের বললেন, অভাবী মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দাও। আল্লাহকে খুশি করার জন্য তার পথে জিহাদ করেছি। ইসলামের সম্মান প্রতিষ্ঠিত করেছি। কুফুরীর অন্ধকার দূরীভ‚ত করেছি। রাজ্য পরিচালনার জন্য অর্থ সম্পদও প্রয়োজন ছিল, মানুষ ভাবতো এসবে বুঝি আমার খুব লোভ। এ ধারণা ঠিক ছিল না। আমি মৃত্যুর আগে আমার শেষ কপর্দকটি পর্যন্ত আল্লাহর বান্দাদের মাঝে বিলিয়ে যেতে চাই।
কারণ, সম্পদ, ক্ষমতা ও দাপট মানুষকে সম্মানিত করে না। শক্তি ও পরাক্রম মানুষকে মুক্তি দেয় না। শান্তি মুক্তি সম্মান ও সকল নেয়ামতের মালিক একমাত্র আল্লাহ। তিনি যেন, আমাকে ক্ষমা করেন। পরলোকে শান্তিতে রাখেন। আমি এখন আর সুলতান থাকব না। আমি সেই সুবক্তগিনের পুত্র বেচারা মাহমুদ। কবরের যাত্রী। মাটিই আমার ঠিকানা। মৃত্যুর ফেরেশতারা এসে দেখুক, বিশাল সাম্রাজ্যের বিখ্যাত ও বিত্তশালী সুলতান নিজেকে কতটুকু অসহায় বানিয়ে আল্লাহর রহমতের দিকে তাকিয়ে আছে। সে সবকিছু ঝেড়ে ফেলে দিয়ে একজন প্রকৃত ফকিরের বেশে বিশ্ব জাহানের মালিক মহান রাজাধিরাজ আল্লাহর কাছে হাজির হতে প্রস্তুত।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।