হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
কামরুল হাসান দর্পণ
রমজান এলেই বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আচার-আচরণে বেশ পরিবর্তন দেখা যায়। যতটা সম্ভব কথাবার্তা, চাল-চলনে তপ্তভাব পরিহার করে সংযমী হওয়ার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। বছরে নিয়মিত নামাজ না পড়লেও রোজার মাসটিতে মানুষকে রোজা রাখার পাশাপাশি নামাজ-কালামে নিয়মিত হতে দেখা যায়। আচরণেও এক ধরনের শুভ্রতা প্রকাশ পায়। মানুষের জীবনযাপনের এই পরিবর্তনের পাশাপাশি অর্থনীতি ও রাজনীতিতেও বিরাট পরিবর্তন ঘটে। ব্যবসায়ীরা সারা বছর এই একটি মাসের জন্য অপেক্ষা করেন। রোজা ও ঈদ উপলক্ষে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য গতি লাভ করবেÑ এ আশায় বুক বাঁধেন। সারা বছরের তুলনায় এ সময়টাতে ব্যবসা-বাণিজ্যও সবচেয়ে ভাল হয়। এমন অনেক ব্যবসায়ী আছেন যারা শুধু এই এক মাসেই সারা বছরের ব্যবসা করেন। বছরের বাকি সময়ে বিক্রি-বাট্টা তেমন না হলেও তাদের চলে। রাজনীতির ক্ষেত্রে দেখা যায়, উত্তপ্ত রাজনীতি রোজার শুরুতেই শীতল হতে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলো ইফতার পার্টিমুখী হয়। বিভিন্ন পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, আলেম-ওলামা, এতিম, প্রতিবন্ধীসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সাথে দলগুলো ইফতার পার্টির মাধ্যমে মিলিত হয়। পারস্পরিক দোষারোপের চলমান অপসংস্কৃতির ধারায় বিরোধী দল ও সরকারি দলের পক্ষ থেকে সংক্ষিপ্ত কিছু দোষারোপের বক্তব্য-বিবৃতি দেয়া হয়। বলতে গেলে অ্যাক্টিভ পলিটিক্স বলতে যা বোঝায় তা দেখা যায় না। রাজনীতি অনেকটা চার দেয়ালেই বন্দি হয়ে পড়ে। সামাজিকতার স্তরে নেমে আসে। এবারের রমজানে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। শীতল হয়ে থাকা রাজনীতি বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। শুধু রাজনীতি নয়, পুরো দেশটাই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ শঙ্কিত, আতঙ্কিত। তারা জীবনের নিরাপত্তা খুঁজছে। যার যতটুকু বোধ-বুদ্ধি আছে তা কাজে লাগিয়েই নিরাপদ থাকার চেষ্টা করছে। বলা বাহুল্য, যেভাবে একের পর এক মানুষকে কুপিয়ে মারা হচ্ছে তাতে কারো স্বস্তিতে থাকার কিছু নেই। চেতনসম্পন্ন মানুষ আতঙ্কিত ও চিন্তিত হবেনই। রোজার মাসে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী এমন টার্গেটেড হত্যাকা- এর আগে ঘটেছে কিনা, জানা নেই। পরিস্থিতিও এত উত্তপ্ত হয়েছে কিনা তাও জানা নেই। এ সময়ের স্বাভাবিক যে পরিবেশ ও বৈশিষ্ট্য সর্বত্র পরিলক্ষিত হয়, এবার যেন তার ব্যতিক্রম ঘটছে। খুন-খারাবি, পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান, গণগ্রেফতার, গ্রেফতার বাণিজ্য ইত্যাদি কারণে রোজার ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ এবং নির্মল ও অন্তর্গত শান্তির আমেজ উধাও হয়ে আতঙ্ক আর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মাসে এ কোন দুর্যোগ এসে হাজির হলো তা নিয়ে সর্বত্রই বিচলন দেখা যাচ্ছে। মানুষ স্বস্তি পাচ্ছে না। সবার মাঝেই চাপা প্রশ্ন, এসব কি হচ্ছে?
দুই.
অস্বীকারের উপায় নেই, সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি চিন্তিত ও অস্বস্তিতে আছে সরকার। এর কারণ বোঝাও কঠিন কিছু নয়। সরকারের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রেখে জনসাধারণকে নির্ভয় ও স্বস্তির পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়া। সরকার যে তা পারছে না, তা তার আচরণ থেকে বোঝা যায়। মুখে স্বীকার না করলেও সমস্যার সমাধান করতে না পেরে যখন প্রতিপক্ষের ওপর দোষ চাপাতে দেখা যায়, তখন বোঝা যায় সরকার পরিস্থিতি সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। অন্যদিকে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিপক্ষ থেকেও এর জবাব আসবে এবং এসেছেও। বর্তমান পরিস্থিতিকে সরকারের চরম ব্যর্থতা এবং এর জন্য সরকার দায়ী এ কথা অকপটে বলে দিয়েছে। পাল্টা জবাবে সরকার বলেছে, বিরোধী দল যে এসব আতঙ্ক সৃষ্টিকারী হত্যাকা-ের সাথে জড়িত তার তথ্য-প্রমাণ সরকারের কাছে রয়েছে। বিরোধী দলের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, তথ্য-প্রমাণ থাকলে দোষীদের ধরুন। এখানেই বিভিন্ন প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, গত দেড় বছরে ৪৭ জন মানুষকে কুপিয়ে মারা হয়েছে, এখনও মারা হচ্ছে, প্রকৃত হত্যাকারীদের কাউকেই গ্রেফতার করা যাচ্ছে না, এ প্রেক্ষিতে যদি সরকারের কাছে তথ্য-প্রমাণ থাকে তাহলে এর সাথে যারা জড়িত তাদের ধরা হচ্ছে না কেন? তথ্য-প্রমাণে যদি বিরোধী দল বা এর চেয়ে বড় কোনো শক্তি জড়িয়ে থাকে তবে তাদের গ্রেফতার করে শাস্তির মুখোমুখি করাই তো সরকারের কাজ। গ্রেফতার করা হলে তো জনগণ দেখতো কারা এসব হত্যাকা-ের সাথে জড়িত এবং এসব রাঘববোয়াল কারা? সরকার তা না করে কালক্ষেপণ করছে কেন? তথ্য-প্রমাণ থাকলে তো এক মুহূর্ত বিলম্ব করা উচিত নয়। অযথা আলস্য দেখিয়ে হত্যাকারীদের আরও হত্যার সুযোগ করে দেয়া তো লাশের মিছিল দীর্ঘ করা। এটা কি করা উচিত হচ্ছে? বিরোধী দলও একই কথা বলেছে, সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছে, অবিলম্বে হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে শাস্তির মুখোমুখি করতে। যে বিরোধী দলের প্রতি সরকার সরাসরি আঙ্গুল তুলে অভিযোগ তুলেছে, সেই বিরোধী দল যদি পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে বলে হত্যাকারী যেই হোক তাদের গ্রেফতার করুন, তখন সরকার কেন থমকে আছে তা বোধগম্য হচ্ছে না। তাহলে কি এটাই প্রতীয়মাণ হয় না, সরকার কেবল বিরোধী দলকে দোষারোপ করে ঘায়েল করার জন্য এসব অভিযোগ করছে? অথবা কোণঠাসা হয়ে থাকা বিরোধী দলকে চিঁড়ার মতো আরো চ্যাপ্টা করার কোনো প্লট তৈরি করছে? এটাও তো মানুষ মনে করতে পারে, সরকার ও তার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সক্ষমতার অভাবের বিষয়টি ঢাকতে বিরোধী দলের উপর দায় চাপানো হচ্ছে। বিরোধী দলের উপর যে কোন দায় চাপাতে চাপাতে এখন দলটিকে রবীন্দ্রনাথের কবিতার ‘কেষ্ট বেটা’য় পরিণত করা হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের ‘পুরাতন ভৃত্য’ কবিতার শুরুর দুটো লাইন এমন, ‘ভূতের মতন চেহারা যেমন, নির্বোধ অতি ঘোরÑ/ যা কিছু হারায়, গিন্নি বলেন, ‘কেষ্টা বেটাই চোর’। এখন সরকারের কর্মণ্যতা বা সক্ষমতার অভাবে যদি কেষ্টা বেটাকেই দোষারোপ করতে হয়, তবে জনগণের বুঝতে বাকি থাকে না যে, সরকারের মুরোদের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। কারণ জনগণ বুঝতে পারে, সরকার তার অক্ষমতা ঢাকতে কেষ্টা বেটাকেই যত দোষ দিয়ে শাসন করতে উঠে পড়ে লেগেছে। অন্যদিকে যারা নৃশংস হত্যাকা- ঘটিয়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যাচ্ছে তারা নিশ্চিতভাবে আনন্দে বগল বাজাচ্ছে। তারা জানে, তাদের কর্মের দায় কেষ্টা বেটাকেই নিতে হবে। আর কেষ্টা বেটাও ক্ষীণ কণ্ঠে কিছু বলে কি বলে না, এমন এক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে অস্পষ্ট হয়ে পড়ে থাকে। ঝেড়ে-কেঁশে কণ্ঠ পরিষ্কার করে যে কিছু বলবে, এমন হিম্মত দেখাতে পারছে না। এর কারণ পরিষ্কার, তাদেরকে সরকার এমন দাবড়ানি দিয়েছে যে দলটির বেশিরভাগ সুবিধাভোগী নেতা বা দলটিতে এলে সহজে মন্ত্রী-এমপি হওয়া যায় এ চিন্তা নিয়ে ভিড় করা নেতারা নিজেদের আখের সামলাতে সর্বদা ত্রস্ত থাকে। আর অকর্মণ্য হয়ে নামকাওয়াস্তে নেতায় পরিণত হয়েছেন এমন নেতারা সরকারের চাপে ভয়ে ধরি মাছ না ছুঁই পানি আচরণ করে চলেছেন। আরও বড় বিষয় হচ্ছে, সরকার তো দাবড়ানি দিচ্ছেই, তার উপর ইলেকট্রনিক ও প্রিণ্ট মিডিয়াও দলটিকে কেষ্টা বেটা বানিয়ে ছেড়েছে। কারণ তারা জানে, কেষ্টাকে লাথি-উষ্ঠা মারলেও তেমন কিছু হবে না। সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষকে যখন কেষ্টা বেটায় পরিণত এবং পরিগণিত করা হয়, তখন বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা দুষ্টু চক্র ফাঁকা মাঠে এসে গোল দেবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ জায়গা কখনো শূন্য থাকে না। সেখানে গাছ জন্মাবেই। রাজনীতিতে এই শূন্য জায়গায়ই দখল করে নিচ্ছে অজানা ভয়ংকর গোষ্ঠী বা সন্দেহভাজন বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠী। সিলেক্টিভ কিলিংয়ের ধারাবাহিকতায় যেসব ভয়ংকর হত্যাকা- ঘটছে, সেগুলোকে সরকার এক সময় বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে এড়িয়ে যেতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত আর বিচ্ছিন্ন বলতে পারেনি। তারা এগুলোকে এখন পরিকল্পিতই বলছে। তবে এক অর্থে এগুলো বিচ্ছিন্নই বটে। কারণ যারা এসব ঘটাচ্ছে, তারা সংগঠিত কোনো দল বা গোষ্ঠী নয়, তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার কারণেই ঘটনা ঘটিয়ে পার পেয়ে যেতে পারছে। তাদের ঠিকানা বা আস্তানা বলে কিছু নেই। পুলিশও অনুমাননির্ভর কথা বলে চলেছে। কমন একটি শব্দ ‘জঙ্গি’ বলে চালিয়ে দিচ্ছে। এ জঙ্গি কারা, তারা কিভাবে সংগঠিত, তাদের নেতা কে, তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি, এসবের আগা-মাথা এখন পর্যন্ত কেউ জানে না। কেবল বলে দেয়া হচ্ছে জঙ্গি এসব আকাম করছে। অন্যদিকে সরকার এর প্রায় পুরো দায় চাপাচ্ছে বিরোধী দলের উপর। বিরোধী দলই নাকি এদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। তাহলে ঘুরেফিরে প্রশ্ন এসে যায়, তথ্য-প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বিরোধী দল বা যারা প্রশ্রয় দিচ্ছে তাদের ধরা হচ্ছে না কেন? জনগণ তো দোষ দিয়ে বা দায় চাপিয়ে খালাস হয়ে যাওয়া দেখতে চায় না। তারা দেখতে চায়, যে দোষে বিরোধী দলকে দোষী করা হচ্ছে এবং এর সঠিক তথ্য-প্রমাণ রয়েছে বলে সরকার দাবি করছে, তার ভিত্তিতে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তা না হলে এ ধরনের একপেশে দোষারোপ করার অপসংস্কৃতির কারণে প্রকৃত অপরাধীরা যদি পার পেয়ে যায়, তবে এর পুরো দায় সরকারের উপরই বর্তাবে। তিন.
সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে একটি ভাল কথা বলা হয়েছে। গুপ্তহত্যা বন্ধে দেশবাসীকে আহ্বান জানিয়েছে। বলেছে, কেউ যখন আঘাত করবে, দয়া করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবেন না। সবাই একজোট হয়ে সেটাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করবেন। আমরা সাথে থাকব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সাথে থাকবে। সরকারের এমন আহ্বানে জনগণ সাড়া দিলে তো খুবই ভালো হতো। সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়। এ সরকারই তো কথায় কথায় তার প্রধান প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য প্রায়ই বলে, দশটা হুন্ডা বিশটা গু-া দিয়েই সে সময় নির্বাচন হয়ে যেত। অর্থাৎ প্রতিপক্ষ যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন নির্বাচনে দশটা হুন্ডা আর বিশটা গু-া হাজির হলেই তাদের ভয়ে লাখ লাখ ভোটার দৌড়ে পালাত। এ কথার সূত্র ধরে যদি বলা হয়, এ সময়ের হুন্ডাগুলো (মোটরসাইকেল) অতি আধুনিক তো বটেই, তার গু-ারাও অতি আধুনিক এবং চালাকও হয়েছে। তাদের হাতে হকিস্টিক, লাঠিসোঁটা ও ডেগারের পরিবর্তে এখন অটোমেটিক অস্ত্র থাকে। দশটা হুন্ডায় চড়ে এই অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে যদি বিশটা গু-া হামলা চালায় তখন কার বুকে এমন পাটা আছে যে জামার হাতা গুটিয়ে ‘সাহস থাকলে সামনে আয় বলে’ রুখে দাঁড়াবে? অত্যাধুনিক অস্ত্রধারীর অস্ত্রের মোকাবেলা কি জনগণ খালি হাতে করবে? এটা তো সকলেই জানেন, একটি পিস্তল হাতে একজন দুর্বৃত্ত খালি হাতে থাকা জনা বিশেক বা তারও বেশি মানুষের সামনে দাঁড়ালে কেউই এগিয়ে আসতে সাহস পাবে না। জানের মায়া সকলেরই আছে। সরকারের তরফ থেকে আহ্বান শুনে মনে হচ্ছে, দুর্বৃত্তদের রুখতে এখন জনগণকেও লাঠিসোঁটা বা অন্য কোন অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করতে হবে। অর্থাৎ জনগণকেই তাদের নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য রুখে দাঁড়াতে হবে। নিরীহ জনগণ যদি মিনমিন করে বলে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে এত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে রাখা হয়েছে কার জন্য? তখন এর জবাব সরকার দেবে কিনা তা তার মর্জির ওপর নির্ভর করবে। যাই হোক, সরকারের ভাষায় ‘গুপ্তহত্যা’ যারা চালায় তারা এত বেকুব নয় যে, হইহই করে জনগণের সামনে এসে টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে এসে হত্যা করে সুরসুর করে চলে যাবে। এটা এখন নির্বোধও বোঝে, গুপ্তহত্যা মানেই গোপনে কাজ করে গোপনে পগার পার হওয়া। যেখানে এই ‘গুপ্তহত্যার’ একটি ঘটনারও প্রকৃত আসামিদের পুলিশের মতো সুচতুর ইন্টেলিজেন্ট বাহিনী ধরতে পারছে না, সেখানে অতি সাধারণ মানুষের পক্ষে কী করে ধরা সম্ভব! বরং জনগণকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান অনেকটা হিতে বিপরীত পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ জনগণ এমনিতেই অতঙ্কিত, জীবন বাঁচাতে মরিয়া। সামাজিক শক্তিগুলোর মধ্যে কোনো ভারসাম্য নেই। সরকারি দলের একচেটিয়া আধিপত্য। এমন এক পরিস্থিতিতে জনগণ দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে তিনবার চিন্তা করবে। তারা জানে সর্বত্র শাসক দলের নিরঙ্কুশ আধিপত্য চলছে। এ আধিপত্যের শক্তির ধারে কাছে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, কোনো না কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়া। অধিপত্যের বলয়ে পড়ে ব্যক্তিগত অপছন্দ ও শত্রুতা কাজে লাগিয়ে বা কাউকে ফাঁসাতে নাটকীয় ঘটনা ঘটিয়ে ধরিয়ে দেয়ার ক্ষেত্র তৈরি করা। এ ধরনের নাটকীয়তার শিকার বা ঘটনা দেখার কম-বেশি অভিজ্ঞতা আমাদের প্রত্যেকেরই রয়েছে। আমরা জানি, পাড়া-মহল্লায় কিভাবে ক্ষমতাসীন দলের নাম ব্যবহার করে কিছু দুর্বৃত্ত নিরীহ সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে এবং ঘটনা সাজিয়ে ফাঁসিয়ে দেয় এবং তাদের দাবিয়ে রাখে। এখন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে জনগণকে প্রতিরোধ গড়ে তোলার যে আহ্বান জানানো হয়েছে, নিশ্চিতভাবেই দেখা যাবে, তাতে সাধারণ মানুষ নেই, আছে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী। কারণ ক্ষমতাসীন দল রাজনীতির অনেক কিছু পাল্টে দেয়ার পাশাপাশি জনগণের সংজ্ঞাও পাল্টে দিয়েছে। তার কাছে দলের নেতাকর্মীই জনগণ। এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে। এ নির্বাচনে ভোটের হার এতই কম ছিল যে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যেটুকু ভোট পড়েছে সেটুকুতেই আমরা সন্তুষ্ট। এর বেশি প্রয়োজন নেই। এর অর্থ হচ্ছে, জনগণ ভোট দিল কি দিল না, তাতে কিছু যায় আসে না। দলের নেতাকর্মীরা ভোটকেন্দ্র দখল করে ও অন্যের ভোট জালিয়াতি করে যেটুকু ভোট দিতে পারে তাই যথেষ্ট। সরকারি দলের কাছে তারাই জনগণ হিসেবে বিবেচিত।
চার.
রোজার মাসে সাধারণ মানুষকে এমন আতঙ্কে থাকতে আর কখনো দেখা যায়নি। যে মাসটিতে মানুষ পারস্পরিক শত্রুতা ভুলে সংযমের মাধ্যমে সহমর্মী হয়ে উঠে, সেখানে তাদের এক ধরনের ‘শত্রুসময়’-এর মধ্যে পড়তে হয়েছে। সিলেক্টিভ কিলিং, জঙ্গি ধরতে পুলিশের সাঁড়াশি অভিযান, গ্রেফতার বাণিজ্য ইত্যকার নানা ঘটনায় এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এমনিতেই রোজা ও ঈদকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসী ও দুর্বত্তদের তৎপরতা বেড়ে যায়, পাশাপাশি একশ্রেণীর পুলিশ সদস্যর গ্রেফতার বাণিজ্যও শুরু হয়, তার উপর সাঁড়াশি অভিযানের কথা শুনে মানুষের জানে পানি না থাকার মতো অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ভীতিকর পরিবেশ দূর করতে সরকার যেন সক্ষম হচ্ছে না। যদিও সে বারবার বলছে, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, এ কেবল সময়ের ব্যাপার। তবে জনগণ দেখছে এ সময় আর আসছে না। বরং একের পর এক ভয়ঙ্কর সব ঘটনা ঘটে চলেছে। গুপ্তহত্যা হোক আর সিলেক্টিভ কিলিং হোক, এসব ঘটনা যেভাবে ক্যান্সারের কোষের মতো গুণিতক হারে বেড়ে চলেছে তা যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে গোটা দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগবে না। তখন যতই থেরাপি দেয়া হোক না কেন এ ক্যান্সার থেকে উপশম হওয়ার আর কোনো উপায় থাকবে না। বিশ্লেষকরা বারবার বলছেন, দেশে যথাযথ গণতন্ত্র এবং কার্যকর বিরোধী দল না থাকলে বা তাদের কার্যক্রম সীমিত করলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, সেখানে চতুর্মুখী অশুভ শক্তির সূচনা হয়। সরকারের বিরোধী দল নির্মূলের নীতির সুযোগে এই শক্তি অবারিত হয় এবং শূন্য জায়গা শ্বাপদশংকুল হয়ে পড়ে। এই যে জঙ্গি উত্থান বা আইএস, আল-কায়দার অস্তিত্বের কথা বলা হচ্ছে, তারা আসল বা নকল যাই হোক, তাদের পেছনের সন্ত্রাসী একটি গোষ্ঠী নিজেদের সরকারের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠার চেষ্টা করছে। তারা ভাল করে জানে, সরকার বিরোধী দলকে দমন-পীড়ন করে কোণঠাসা করে রেখেছে। সরকার ঐদিকেই বেশি ব্যস্ত। এই ফাঁকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নিজেদের শক্তি সঞ্চয় করছে। এই শক্তি কোনো সাধারণ শক্তি নয়, ভয়ঙ্কর শক্তি। এ শক্তির বিরুদ্ধে আতঙ্কিত জনগণের পক্ষে রুখে দাঁড়ানো খুবই কঠিন। আবার এই দুর্বৃত্তদের মাঠছাড়া ও দমন করা একা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষেও সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন স্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিবেশ। যে পরিবেশে সরকার ও বিরোধী দলের নিয়ন্ত্রণ শক্তির ভারসাম্য বা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স থাকবে। বলা বাহুল্য, ক্যান্সার রূপী সিলেক্টিভ কিলিং প্রতিরোধের একমাত্র উপায় রাজনৈতিক শূন্যতা দূর করা, বিরোধী দলের স্বাভাবিক রাজনীতি করার সুযোগ দেয়া এবং তাদের সাথে রাজনৈতিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ও সহবস্থান সৃষ্টি করা। এই সঙ্গে জাতীয় সংলাপে বসা এবং রাজনৈতিক ঐক্য সৃষ্টি করা। সরকার যদি তা না করে একরোখা ও গোয়ার্তুমির পথেই হাঁটে, তবে যে বিপজ্জনক দিকে দেশ ধাবিত হচ্ছে, সেদিক থেকে তাকে ফিরিয়ে রাখার কোনো উপায় থাকবে না।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।