বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
আল্লাহ পাকের মনোনীত ও পছন্দনীয় দিন বা ধর্মের দিকে মানুষকে আহ্বান করা, দাওয়াত দেয়া পুণ্যময় কাজ। আরবি দাওয়াত শব্দটি ‘দায়া’ মূল ধাতু হতে উৎসারিত। এর আভিধানিক অর্থ হল আমন্ত্রণ জানানো, ডাকা, আহ্বান করা।
ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় ওই আহ্বানকে দাওয়াত বলা হয় যা মানব জাতিকে জাগতিক কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের করার জন্য করা হয়। বস্তুতঃ আল্লাহপাকের পথে আহ্বান করা প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের অপরিহার্য দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ পাক আল-কোরআনে এরশাদ করেছেন, ‘(হে প্রিয় হাবিব) আপনি আপনার প্রতিপালকের পথের দিকে হিকমত ও সুন্দর সদুপদেশ এর মাধ্যমে মানুষকে আহ্বান করুন এবং সুন্দর তোমার পন্থায় তাদের সাথে আলোচনা ও বিতর্ক করুন। নিশ্চয়ই একমাত্র আপনার প্রতিপালকই জানেন কে তার পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং তিনি হেদায়েত প্রাপ্তদের ভালোভাবেই জানেন।’ (সূরা নাহল : আয়াত ১২৫)।
আল্লাহর পথে দাওয়াত দেয়া অতি উত্তম কাজ। এ প্রসঙ্গে আল-কোরআন এরশাদ হয়েছে, ‘আর তার চেয়ে কার কথা অধিক উত্তম, যে আল্লাহর দিকে আহ্বান করে, পুণ্যকর্ম সম্পাদন করে এবং বলে, নিশ্চয়ই আমি আত্মসমর্পণকারী মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সূরা হা-মীম সেজদা : আয়াত ৩৩)।
মহান রাব্বুল আলামিন প্রিয় নবী মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.) কে খেতাব করে আরো ইরশাদ করেছেন, ‘(হে প্রিয় হাবিব) আপনি বলে দিন যে, এটা আমার পথ। আমি জেনে বুঝে আল্লাহর পথে আহ্বান জানাই এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও। আর আল্লাহ পবিত্র মহান এবং আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই।’ (স‚রা ইউসুফ : আয়াত ১০৮)
আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত রাস‚লুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কে রিসালাতের দায়িত্ব পালন করার পথের দিশা দেখিয়ে দিয়েছেন। আল-কুরআন ইরশাদ হয়েছে, ‘হে রাসুল, আপনার প্রতিপালকের পক্ষ হতে আপনার নিকট যা নাযিল করা হয়েছে, তা (মানুষের নিকট) পৌঁছে দিন। আর যদি আপনি না করেন, তবে আপনি রিসালাত পৌঁছালেন না। আর আল্লাহ পাকই আপনাকে মানুষ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ অবিশ্বাসী কাফের স¤প্রদায়কে হেদায়েত করেন না।’ (স‚রা মায়েদা : আয়াত ৬৭)।
প্রিয় নবী মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ সা. ছিলেন আল্লাহর অনুমতিক্রমে তার দিকে আহবানকারী বা দায়ী। কোরআনুল কারীমে এই বিশেষত্বটি এভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘হে নবী আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষ্যদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে আর আল্লাহ পাকের অনুমতিক্রমে তাদেরকে আহ্বানকারী ও আলোকদীপ্ত প্রদীপ রূপে।’ (স‚রা আহযাব : আয়াত ৪৫-৪৬)।
একথা অত্যন্ত সুবিদিত যে, শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)’র পর কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত আর কোনো নবী রাস‚ল আগমন করবেন না। তবে, যারা তার খাটি অনুসারী, প্রকৃত মুমিন মুসলমান তারা কুরআন এবং সুন্নাহর ভিত্তিতে মানুষকে আল্লাহর খালেস বান্দা হওয়ার জন্য দাওয়াতের কাজটি চালিয়ে যাবেন। এভাবে দাওয়াতের কাজ কেয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে।
এতদপ্রসঙ্গে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাস‚লুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা আমার পক্ষ হতে একটি আয়াত হলেও তা প্রচার কর। আর বনী-ইসরাঈলের বিষয়াদি শিক্ষা গ্রহণের নিমিত্ত আলোচনা কর। তাতে দোষ বা অসুবিধার কিছুই নেই। আর যে ব্যক্তি আমার প্রতি ইচ্ছাপ‚র্বক মিথ্যা আরোপ করে তার উচিত স্বীয় চিরস্থায়ী ঠিকানা জাহান্নামের সন্ধান করা। (সহীহ বুখারি : ৪/৩৪৬১)। সুতরাং সৎ কাজের আদেশ অসৎ কাজের নিষেধ করা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব। এ সম্পর্কে হাদিস শরীফে সুস্পষ্ট নির্দেশ এসেছে। হযরত আবু সাঈদ খুদরী রা. হতে বর্ণিত। রাস‚লুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যদি কোন অন্যায় কাজ অনুষ্ঠিত হতে দেখে, তাহলে সে যেন তার হাত দিয়ে তা প্রতিহত করে। আর যদি তার সে শক্তি ও সামর্থ্য না থাকে, তাহলে সে যেন মৌখিকভাবে নিষেধ করে। আর যদি সে মৌখিকভাবে বারণ করতেও অপারগ হয়, তাহলে অন্তরে উক্ত কাজের প্রতিরোধের চিন্তা করবে। আর অন্তরে চিন্তা করাটা হলো ঈমানী দুর্বলতার লক্ষণ। (সহীহ মুসলিম : ১/৪৯)।
এ হাদিসের ব্যাখ্যায় রইস‚ল মুহাদ্দিসীন ওস্তাদুনা হযরত মাওলানা মুফতি আমীমুল ইহসান নকশবন্দী-মোজাদ্দেদী, বরকতী রহ. বলেছেন, হাত দ্বারা প্রতিহত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রশক্তির। কেননা অন্যায় প্রতিরোধ শক্তির ব্যবহার করার এখতিয়ার একটি রাষ্ট্রের আছে। আর মৌখিকভাবে নিষেধ করার দায়িত্ব হলো রাজকর্মচারী ও সমাজের দায়িত্ব প্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের। তারা সমাজের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার লক্ষ্যে মৌখিকভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। আর সাধারণ মানুষের কাজ হল অন্যায় কাজকে অন্তরে ঘৃণা করা ও তা প্রতিরোধ করার চিন্তা পোষণ করা। যাতে করে অন্যায় কাজ ও পদক্ষেপ সাধারণ মানুষের ঘৃণার বস্তুতে পরিণত হয়।
মোটকথা দাওয়াতও আহ্বান করার সাথে সাথে আমল করতে হবে। এ প্রসঙ্গে হযরত আনাস রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাস‚লুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘মেরাজের রাতে আমি দেখতে পেলাম, কতকগুলো লোকের ঠোঁট আগুনের কাঁটি দ্বারা কাটা হচ্ছে। আমি জিব্রাইল আ. কে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তিনি বলেন, এরা হলো- আপনার উম্মতের মুবাল্লিগ (প্রচারক) শ্রেণির লোক। যারা অপরকে ভালো কাজে ভালো কাজ করার নসিহত করত, কিন্তু নিজেরা আমল করত না। (মুসনাদে আহমদ : ২১/১৩৫১৪)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।