Inqilab Logo

বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ফেনী নদীর পানি চুক্তিতে বেড়েছে উৎকন্ঠা, হুমকির মুখে পড়বে জীববৈচিত্র

চট্টগ্রাম, ফেনী, খাগড়াছড়ি ও কুমিল্লার একাংশে সেচ যোগান অনিশ্চিত হয়ে পড়বে

ছাগলনাইয়া থেকে মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন | প্রকাশের সময় : ৫ অক্টোবর, ২০১৯, ৭:৩৫ পিএম

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে বৈঠক হয়েছে। স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের আওতায় বাংলাদেশের ফেনী নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করে ত্রিপুরায় নিতে পারবে ভারত। শনিবার দুপুরে নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে বৈঠকে বসেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী। ইউএনবির খবরে বলা হয়, স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকের আওতায় ফেনী নদীর ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করতে পারবে ভারত। এই পানি তারা ত্রিপুরা সাব্রুম শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ প্রকল্পে ব্যবহার করবে। ফেনী নদী,অভিন্ন নয়-শুধুই বাংলাদেশের সম্পদ। এর উৎপত্তি, প্রবাহ এবং ভৌগলিক অবস্থান নিশ্চিত করে ফেনী নদী কোনভাবেই আন্তর্জাতিক নদী প্রবাহের সীমা রেখায় প্রবাহিত নয়। দেশি-বিদেশি যারাই ফেনী নদীকে অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদী প্রমাণের চেষ্টা করছেন বহু বছর ধরে,তারা কখনই মাঠ পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করে এর পক্ষে যুক্তি দেখাতে পারেননি। লেখালেখি বা বক্তব্য-বিবৃতিতেই সীমাবদ্ধ তাদের অপচেষ্টা। সেখানেও তারা কোনভাবেই দু’দেশের অমিমাংসিত ভূমি নিয়ে কথা বলেন না। খাগড়াছড়ির ১৭শ একর অমিমাংসিত বাংলাদেশের যে ভূমির উপর দিয়ে এ নদী প্রবাহিত,তা ভারতের বলেই চালিয়ে দিতে চেষ্টা করেন অনেকে। শুধু তাই নয়,পার্শ্ববর্তী বন্ধু প্রতিম দেশ ভারতও নিজেদের উত্তর-পূর্ব অংশের বেশ কটি রাজ্যের পানির অভাব মেটাতে দীর্ঘ বছর ধরে নানা কৌশলে ফেনী নদীকে আন্তর্জাতিক নদী প্রমাণের চেষ্টা করে যাচ্ছে। উৎপত্তি এবং পথচলা: এক পাশে পার্বত্য রামগড় ও চট্টগ্রামের মিরসরাই, আরেক পাশে ফেনীর ছাগলনাইয়া। মাঝে কল কল ধ্বনিতে ধেয়ে চলছে ছাগলনাইয়ার গর্বের সন্তান, ফেনী নদী। খাগড়াছড়ি’র পার্বত্য মাটিরাঙ্গা ও পানছড়ির মধ্যবর্তী “ভগবান” টিলা থেকে ছড়া নেমে আসে ভাটির দিকে। আর আসালং-তাইন্দং দ্বীপ থেকে রূপ নেয় ফেনী নদী নামে। ভগবানটিলার পর আসালং তাইন্দং এসে প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত ছড়াকে কেটে ভারতের ভেতরে প্রবেশ করানো হয়েছে। কোথাও কোথাও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আমলীঘাট সীমান্ত থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের লুসাই পাহাড় থেকে ছড়া নেমে এসে, ইজেরা গ্রামের সীমান্ত ছুঁয়ে বা ঘেঁষে ফেনী নদী নামে ভাটির দিকে ধেয়ে গেছে। প্রকৃত অর্থে এই তথ্যটি সর্ম্পূণ মিথ্যা ও বানোয়াট। কারণ ইজেরা গ্রামের সাথে আসালং-তাইন্দং এ বাংলাদেশের প্রায় ১৭শ একর জায়গার সম্পর্ক রয়েছে। যা ভারত গায়ের জোরে দখল করে রেখেছে। আসালং তাইন্দং থেকে নেমে আসা ছড়া আমলীঘাটের এখানটাতেই ছাগলনাইয়া ছুয়ে ফেনী নদী নামে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিলেছে। ফেনী নদী নিয়ে বিতর্কের শুরু : দেশ বিভাগের আগে ১৯৩৪ সালে ভারত, ফেনী নদীর পানি নেয়ার দাবি ওঠায় বলে কেউ কেউ মন্তব্য করলেও মূলত: ১৯৫৮ থেকে ১৯৬০ সাল পযর্ন্ত নানা কৌশলে “নো ম্যানস ল্যান্ড” ও “ট্রান্সবাউন্ডারির” অজুহাতে আর্ন্তজাতিক নদী প্রবাহের অংশ দেখানোর চেষ্টা করে তারা। ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহারে ক্ষয়ক্ষতি: এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পানি প্রত্যাহার করে নেয়া হলে শুষ্ক মৌসুমে নদী তীরবর্তী চট্টগ্রামের মিরসরাই,খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলা, ফেনীর ছাগলনাইয়া, পরশুরাম, সোনাগাজী, মুহুরী সেচ প্রকল্প, ফুলগাজী, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের দক্ষিণাংশ এবং নোয়াখালী-লক্ষীপুরের কিছু অংশের বিভিন্ন সেচ প্রকল্পে পানির জোগান অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। এতে করে লাখ লাখ হেক্টর জমি চাষাবাদের অনাবাদি হয়ে পড়বে। অকার্যকর হয়ে পড়বে ১৯৮৪ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের হাত ধরে তৎকালীন ১৫৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প “মুহুরী”। যার আওতায় এ অঞ্চলের প্রায় ১৪ থেকে ১৫টি উপজেলার ৮/৯ লাখ হেক্টর জমিতে লোনামুক্ত পানির সরবরাহ করা হয়। যার মাধ্যমে শুধুমাত্র ফেনীর ৬টি উপজেলায় বছরে অতিরিক্ত প্রায় ৮৬ হাজার মেট্টিকটন ফসল উৎপাদন হয়। এ প্রকল্পের আওতায় যেখানে ফেনী, মুহুরী ও কালিদাস পাহালিয়া- এ তিনটি নদীর পানি দিয়ে ৮/৯ লাখ হেক্টর জমির সেচকাজ করার কথা, সেখানে এখনই শুকনো মৌসুমে পানির অভাবে ২৩ হাজার হেক্টর জমিতেও সেচ দেয়া সম্ভব হয় না। মুহুরী সেচ প্রকল্পের প্রায় ৮০ ভাগ পানির মূল উৎস “ফেনী নদী”। ফেনী থেকে ২৫ কিলোমিটার ও চট্টগ্রাম থেকে ৭০ কিলোমিটার এবং সমুদ্র সৈকত থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম-ফেনী জেলার সীমানায় মুহুরী সেচ প্রকল্পটির অবস্থান। এখানে গড়ে ওঠা দিগন্ত বিস্তৃত চিংড়ি ঘেরগুলো ধংস হবে। মুহুরী, সিলোনিয়া, পিলাকসহ প্রায় শতাধিক ছোট-বড় নদী, খাল ও ছরায় পানি শূন্যতা দেখা দেবে। এক দশক আগ থেকেই ছাগলনাইয়া উপজেলার যশপুর খাল, ছাগলনাইয়া ছড়া, ফুলছড়ি খাল, হিছাছড়া,মন্দিয়া খাল,জংগলমিয়া খাল,পান্নাঘাট খালসহ অসংখ্য খালের তলা শুকনো মওসুমে পানির অভাবে ফেটে চৌচির হয়ে যায়। এছাড়া মুহুরী প্রকল্পের নয়নাভিরাম পর্যটন সম্ভাবনা হারিয়ে যাবে নিমিষেই। হুমিকর মুখে পড়বে কয়েক লক্ষ হেক্টর জমির গাছপালা। ফেনী নদী, মুহুরী ও কালিদাশ পাহাড়িয়া নদীকে ঘিরে গড়ে ওঠা প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মৎস্য খামার বন্ধ হয়ে যাবে। যা থেকে উৎপাদিত মাছ দিয়ে পুরো চট্টগ্রামের ৭০ ভাগ মৎস্য চাহিদা পুরন করা যায়। বছরে প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার মৎস্য উৎপাদন হয় এ প্রকল্পের পানি দিয়ে। নদীর তীরবর্তী ২০-২২ হাজার জেলে পরিবারের জীবন-জীবিকা অন্ধকারের মুখে পড়বে। বিলিন হয়ে যাবে বিরল প্রজাতির মাছ ও পশু-পাখি। সামুদ্রিক লবনাক্ততা বৃদ্ধি পেয়ে ধংস হবে, সবুজ বনায়ন। দেখা দেবে পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্যহীনতা। বেকার হয়ে যাবে লক্ষাধিক কর্মজীবী মানুষ। সব কিছু হারিয়ে ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়ে পথে বসবে প্রায় ২০ লাখ পরিবার। সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ অঞ্চলের প্রায় অর্ধকোটিরও বেশী মানুষ। ফেনী নদীর বালু মহাল ইজারার মাধ্যমে প্রতি বছর সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে। ভারতের সঙ্গে চুক্তি হওয়ায় এ নদীতে পানি সঙ্কটের কারণে বালি উত্তোলন প্রক্রিয়াও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। হুমকির মুখে পড়বে ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলার হাজার হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। ফেনীর মানুষের অনুভূতি : দলমত নির্বিশেষে ছাগলনাইয়া, পরশুরাম ও সোনাগজীসহ ফেনীর মানুষ ফুঁসে উঠছে। ফেনী নদীর পানি বন্টন চুক্তি নিয়ে চট্টগ্রামের মিরসরাই ও ফেনীর ছাগলনাইয়ার মানুষের মধ্যে বেড়েছে উৎকন্ঠা। পানি আগ্রাসনে ফেনী নদী শুকিয়ে যাওয়ার এবং মুহুরী সেচ প্রকল্প অকার্যকর হওয়ার আতঙ্কে রয়েছে নদীর তীরবর্তী ছাগলনাইয়ার জনগণ। ফেনী নদীর পানি রক্ষা আন্দোলনে সর্বশেষ ২০১২ সালের ৫ মার্চ লংমার্চ করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি,জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মরহুম হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তাতেও বরফ গলেনি ভারতের তাই ছাগলনাইয়াসহ ফেনীর মানুষের বক্তব্য একটাইৃ‘জীবন দিয়ালামু, হেনী নদীর হানি ভারতেরে দিতাম ন’।

 



 

Show all comments
  • দীনমজুর কহে ৫ অক্টোবর, ২০১৯, ৯:৪৮ পিএম says : 0
    ফেনী নদীর পানি দিতে নারাজ ফেনীবাসী।তাদের কথা- জান দেবো জীবন দেবো , ফেনি নদীর পানি দেবোনা।
    Total Reply(0) Reply
  • লায়েক ৬ অক্টোবর, ২০১৯, ১২:১২ এএম says : 0
    কি যে বলেন ভারতের সাথে আমাদের সম্পক স্বামী স্ত্রীর মত, ফেনি নদীর পানি কেন যৌতুক হিসাবে পুরো বাংলাদেশ টা দিয়ে দিবও একটু অপেক্ষা করুন
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ