বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
আল কোরআন খোদ মোজেযা বা অলৌকিক ব্যাপার। বিষয়বস্তুর দিক থেকেও কোরআন মোজেযাপূর্ণ। কেননা এযাবৎ কোরআনের বিষয়বস্তুগুলো নির্ধারণ করা কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। যুগে যুগে অনেকে গবেষণা ও চিন্তা-সাধনা করেছেন কোরআনের বিষয়বস্তুগুলো নির্ধারণ ও নির্দিষ্ট করার, কিন্তু কেউই তাতে সফলতার দাবি করতে পারেননি। কারণ, এযাবৎ দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে অসংখ্য ভাষায় কোরআনের ব্যাখ্যাভিত্তিক বহু গ্রন্থ-পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে।
কিন্তু প্রত্যেকটি গ্রন্থ-পুস্তকেই কোরআনের নতুন নতুন বিষয়বস্তু স্থান লাভ করেছে। কোরআনের ওপর এবং কোরআন সম্পর্কে যতই চিন্তা-ভাবনা ও গবেষণা করা হচ্ছে, ততই নতুন নতুন অভিনব বিষয়বস্তু উঠে আসছে এবং উদ্ভব হচ্ছে নানা বিষয়ের। এ জন্য বলা হয়, কোরআনের বিষয়বস্তুগুলোর ক্ষেত্রে অবশ্যই রাসূলুল্লাহ (সা:)-এর সতর্কবাণী মনে রাখতে হবে যাতে তিনি বলেছেন; ‘মানক্বালা ফিল কোরআনে বিগায়রি ইলমিন, ফাল ইতাবাওয়ায়ু মাকআদাহু মিনাননার।’ অর্থাৎ ‘যে ব্যক্তি না জেনে কোরআন সম্পর্কে বলে, সে নিজের আসন জাহান্নামে স্থির করে।’ ভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী, ‘মানক্বালা ফিল কোরআনে বিরায়িহি’। অর্থাৎ ‘যে ব্যক্তি কোরআন সম্পর্কে নিজের রায়ে বলে।’
তবে কোরআনের তরজমা তাফসির করা এবং কোরআনের বিষয় নির্বাচন করা এক কথা নয়। বিষয় নির্বাচন যারা করবে, তারা কোরআন পড়তে জানে এবং কোরআনের অর্থ বোঝে এমন যোগ্যতাসম্পন্ন লোক হবে। অন্যের লেখা বিষয়বস্তুর নকলকারীও হতে পারে, তবে এমন লোকের সংখ্যাই অধিক। কোরআনের তাফসির করা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। কেবল তারাই করতে পারেন, যারা আলেমে দ্বীন এবং যাদের দ্বীনি শাস্ত্রসমূহের দক্ষতা ও পারদর্শিতা আছে।
এ বিষয়ে উলামায়ে ইসলাম লিখেছেন, ১৫টি ইসলামী শাস্ত্রের ওপর গভীর জ্ঞান ও দখল আছে, এমন যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিরাই কোরআনের তাফসির লিখতে পারেন। লোগাত, নাহু, ছরফ, কেরাত, ফিকাহ, উসূলে ফিকাহ, হাদিসে ফিকাহ ইত্যাদি ছাড়াও কারো মতে তাসাওফও জানতে হবে।
উল্লেখ্য, রাসূলুল্লাহ (সা:)-কে পরীক্ষা করার জন্য মদিনার ইহুদিগণ ‘রূহ’ সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল বলে বোখারি ও মুসলিমের রেওয়াতে বলা হয়েছে, এবং সিরাতের বর্ণনা অনুযায়ী মক্কার কোরেশগণ ইহুদিদের পরামর্শে উক্ত প্রশ্ন করেছিল। ফলে আয়াতটির শানে নজুল নিয়ে মতভেদ দেখা দেয়, আয়াতটি মাদানী নাকি মাক্কি। যা হোক, আয়াতটির পরবর্তী অংশ হচ্ছে, ‘অমা ওতিতুম মিনাল ইলমে ইল্লা কালীলান।’ অর্থাৎ তোমাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছে সামান্যই। (সূরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ৮৫)।
আল্লাহর ইলমে ছিল যে, ইহুদি বা কাফেররা ‘রূহ’ সম্পর্কে প্রশ্ন করবে, কিন্তু সে সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই। কেননা ‘রূহ’-এর সূ² বিষয় ও রহস্যাবলির সঠিক ব্যাখ্যা পূর্বের বড় বড় পন্ডিত, দার্শনিকগণ পর্যন্তও উদ্ধারে ব্যর্থ হয়েছে। ইহুদি কাফেররা যে সীমিত জ্ঞানের অধিকারী, ‘রূহ’ শব্দটি তাদের জ্ঞানের অনেক ঊর্ধ্বে, তারা উহার মর্ম অনুধাবন করতে সক্ষম নয়। তাদের সীমিত জ্ঞানে বোঝার মতো করে রাসূলুল্লাহ বলে দিয়েছেন, ‘এটি আল্লাহর নির্দেশ হতে’। এতটুকু বুঝলেই চলবে, তার বেশি জ্ঞান তাদেরকে দেয়া হয়নি।
কোরআন শরীফে আল্লাহর ইলম সম্পর্কে এমন দু’টি আয়াত আছে যেখানে আল্লাহ তায়ালা খোদ ঘোষণা করেছেন, ‘দুনিয়ার সমস্ত গাছ যদি কলম হয়ে যায় এবং সাত সমুদ্রের পানি কালি হয়ে যায় এবং সেগুলো দ্বারা আল্লাহর বাক্যগুলো লেখা শুরু করা হয়, তাহলে কালি তো শেষ হয়ে যাবেই এবং কলমগুলো ভোঁতা হয়ে যাবে, ভেঙে যাবে কিন্তু আল্লাহর কথাগুলো শেষ হবে না।’ প্রথমটি সূরা ক্বাফ-এর শেষ আয়াত।
পরবর্তী আয়াতের অনুবাদ এই- ‘বল, আমার প্রতিপালকের কথা লিপিবদ্ধ করবার জন্য সমুদ্র যদি কালি হয়। তবে আমার প্রতিপালকের কথা শেষ হবার পূর্বেই সমুদ্র নিঃশেষ হয়ে যাবে, আমার সাহায্যার্থে এর অনুরূপ আরও সমুদ্র আনলেও।’ (সূরা ক্বাফ, আয়াত : ১০৯)।
কাশশাফ ও জাললাইন ইত্যাদি অনুযায়ী, লিপিবদ্ধ করবার এবং আরও সমুদ্র বাক্যগুলো মূল আরবীতে উহ্য রয়েছে।
দ্বিতীয় আয়াতটি সূরা লুকমানে যার অর্থ হচ্ছে; আল্লাহ অন্যত্র বলেন, ‘পৃথিবীর সমস্ত বৃক্ষ যদি কলম হয়, আর সমুদ্র হয় কালি এবং এর সাথে আরও সাত সমুদ্র যুক্ত হয় তবুও আল্লাহর বাণী নিঃশেষ হবে না। আল্লাহ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়। (আয়াত : ২৭)।
আয়াতদ্বয়ের অর্থ এতই স্পষ্ট যে, আলাদা ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। কোরআনের প্রতিপাদ্য বিষয়বস্তু ইত্যাদির নতুনত্ব, অভিনব চিরন্তন ও জীবন্ত হয়ে থাকবে। আল্লাহর বাণী ও কথামালার বিশালতা ও ব্যাপৃতিকে সীমাবদ্ধ করা মুনষের পক্ষে সম্ভব নয়। আর মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কোরআনের অসংখ্য ব্যাখ্যা তাফসির গ্রন্থ দুনিয়ার বহু ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত হতে থাকবে।
তবে এ বক্তব্যের উদ্দেশ্য এই নয় যে, যার যা খুশি অর্থ করবে, মনগড়া বিকৃত অর্থ করবে, যা ইহুদি, খ্রিষ্টান ও এক শ্রেণীর মুসলমানের ভ্রান্ত গোমরাহ সম্প্রদায়গুলো করে থাকে। তাফসির শাস্ত্রের নীতিমালা ও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের এবং আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে উদ্দেশ করে বলেন, ‘বল, আমি তোমাদের মতো একজন মানুষই, আমার প্রতি (ওহি) প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমদের ইলাহ একমাত্র। (সূরা : ১৮ কাফের, আয়াত : ১১০)।
এই আয়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, নাবীর ইলমও সীমিত এবং প্রদত্ত। আল্লাহ তায়ালার ইলম-এর ন্যায় জাতিও অসীম, ব্যাপক নয়। আল্লাহর জাত, সত্তা এমন যে সর্বপ্রকারের ইলম ও পরিপূর্ণতায় বেষ্টিত, তার পক্ষ হতে যা তাকে ওহি করা হয়, যার মূল হচ্ছে তাওহীদের ইলম, সে দিকেই তিনি সকলকে আহ্বান জানান।
এ তাওহীদের আসল হচ্ছে আল্লাহর অস্তিত্ব একত্ববাদ- অর্থাৎ আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং তার কোনো শরিক বা অংশীদার নেই। তিনি ইতিবাচক গুণাবলির দ্বারা সুপ্রতিষ্ঠিত ইত্যাদি অসীম ক্ষমতার অধিকারী। তাঁর হামদ ও নাত প্রশংসা করে শেষ করা যাবে না। তাঁর সঠিক পূর্ণ পরিচয় তুলে ধরার ক্ষমতা মানুষের নেই। হাক্কানি উলামা মোফাসসিরিনের ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।