Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দিচ্ছেন কর্মকর্তারাই!

সরিষায় ভূত

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

পাসপোর্ট অধিদফতরের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা দালাল চক্রই ‘গ্রিন চ্যানেলের’ মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নামে পাসপোর্ট ইস্যু করছে। ৮০ থেকে ১ লাখ টাকার বিনিময়ে এসব পাসপোর্ট ইস্যু হয়। এজন্য কোনো রোহিঙ্গা আবেদনকারীকেই পাসপোর্ট প্রাপ্তির জন্য সশরীরে অফিসে হাজির হতে হয় না। এ তথ্য উঠে এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এনফোর্সমেন্ট টিমের প্রাথমিক অনুসন্ধানে। সংস্থার সহকারী পরিচালক রতন কুমার দাশের নেতৃত্বে এনফোর্সমেন্ট টিম গত ১২ সেপ্টেম্বর জেলা নির্বাচন কার্যালয় এবং চট্টগ্রাম নগরীর মনসুরাবাদ পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস পরিদর্শন করে। এ বিষয়ে দুদকের চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মাহমুদ হাসান ইনকিলাব’কে বলেন, এনফোর্সমেন্ট টিম কিছু প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করেছে। কমিশনের সিদ্ধান্ত পেলেই রোহিঙ্গা এনআইডি ও পাসপোর্টের বিষয়ে আমরা ব্যাপকভিত্তিক অনুসন্ধানে নামতে পারব।

দুদক টিমের প্রাপ্ত তথ্য মতে, পাসপোর্ট অফিসের কাউন্টারে থাকা পাসপোর্ট কর্মকর্তারা বিনা আপত্তিতে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে ফিঙ্গার প্রিন্ট নিচ্ছেন। রোহিঙ্গা আবেদনকারীর ইমেজ (ফটো) গ্রহণ করছেন। আবেদনটি অনুমোদন শেষে ভেরিফিকেশনের জন্য পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) পাঠাচ্ছেন। এ কারণে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট ইস্যুর প্রথম দায় সংশ্লিষ্ট পাসপোর্ট কর্মকর্তার।

দুদক সূত্র জানায়, সংস্থার এনফোর্সমেন্ট টিমের সদস্যরা এ পর্যন্ত ৪৬ জন রোহিঙ্গার তথ্য পেয়েছেন, যারা জাতীয় পরিচয়পত্র এবং পাসপোর্ট পেয়েছেন। এর মধ্যে কয়েকজন সন্ত্রাসী এবং ডাকাত সরদারও রয়েছে। রোহিঙ্গাদের এসব তথ্য ঢাকা থেকে সার্ভারে যুক্ত করা হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, লাকী নামের এক রোহিঙ্গা নারী গত ১৮ আগস্ট স্মার্টকার্ড তুলতে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয়ে গেলে তার হাতের পুরনো এনআইডিতে ১৭ ডিজিটের নম্বর দেখে কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়। জেরার মুখে লাকী নিজের আসল নাম রমজান বিবি এবং ২০১৪ সালে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসার পর টেকনাফের মুচনী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছিলেন বলে স্বীকার করেন। ওই রোহিঙ্গা নারী ভুয়া ঠিকানা দিয়ে তৈরি করিয়েছেন ওই জাল এনআইডি। অথচ ওই ভুয়া পরিচয়পত্রের তথ্যও নির্বাচন কমিশনের তথ্যভান্ডারে সংরক্ষিত রয়েছে। গত ১ সেপ্টেম্বর বন্দুকযুদ্ধে নিহত রোহিঙ্গা ডাকাত নূর মোহাম্মদের এনআইডি ও পাসপোর্ট পাওয়ার পর পাসপোর্টের বিষয়টি আলোচনায় আসে। পরে বাংলাদেশী পাসপোর্টধারী তিন রোহিঙ্গা যুবক গ্রেফতার হয়। এখন একের পর এক বেরিয়ে আসছে রোহিঙ্গা পাসপোর্ট ইস্যুর নানা কাহিনী ও চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।

দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিমের হাতে ইতোমধ্যে বেশ কিছু তথ্য এসেছে। পাসপোর্ট অফিসের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে গড়ে ওঠা শক্তিশালী সিন্ডিকেট দালাল চক্র ৮০ থেকে ১ লাখ টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দিচ্ছেন। অফিসে হাজির হওয়া ছাড়াই দালাল চক্রের মাধ্যমে বিনা ঝক্কিতে পাসপোর্ট হাতে পাচ্ছেন রোহিঙ্গারা। তবে রোহিঙ্গা পাসপোর্ট ইস্যুর সঙ্গে জড়িত কয়েকজন পাসপোর্ট কর্মকর্তার নাম ইতোমধ্যেই টিমের হস্তগত হয়। প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাদেশী পাসপোর্টসহ ধরা পড়া তিন রোহিঙ্গা যুবকের দু’জন মিয়ানমারে মংডু জেলার অংচি গ্রামের আলী আহমদের ছেলে মো. ইউসুফ ও মো. মুসা। অপরজন মিয়ানমারের একই এলাকার মো. আজিজ। তারা গত বছর ডিসেম্বর নোয়াখালীর সেনবাগের ঠিকানা ব্যবহার করে এনআইডি সংগ্রহ করেন এবং সেটি ব্যবহার করে নোয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে পাসপোর্ট নেন। তাদের এই পাসপোর্ট প্রাপ্তির সময় নোয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে পর্যায়ক্রমে দায়িত্বে ছিলেন উপ-পরিচালক নূরুল হুদা (বর্তমানে রংপুর কার্যালয়ে কর্মরত) এবং শাহাদাৎ হোসেন। তাদের কর্মকালে নোয়াখালীতে সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা পাসপোর্ট ইস্যু হয়। কথিত রয়েছে, শুধু নোয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়েই ১১ হাজার ৭শ’ রোহিঙ্গা পাসপোর্ট ইস্যু হয়েছে। যদিও পাসপোর্ট কর্মকর্তারা বিষয়টি বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন। মূলত বিচ্ছিন্নভাবে যখনই একেকজন রোহিঙ্গা বাংলাদেশী পাসপোর্টসহ ধরা পড়েন- তখনই বিষয়টি আলোচনায় আসে। কিন্তু গণহারে রোহিঙ্গা পাসপোর্ট ইস্যুর তথ্যটি তারা অস্বীকার করেন।

পাসপোর্ট অধিদফতরের একটি সূত্র জানায়, দেশে সর্বাধিক সংখ্যক রোহিঙ্গা পাসপোর্ট ইস্যু হয় কুমিল্লা আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ে। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এই কার্যালয়ে দায়িত্বে ছিলেন উপ-পরিচালক মহেরউদ্দিন শেখ (বর্তমানে প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত)। তার কার্যকালে ইস্যুকৃত ১১টি রোহিঙ্গা পাসপোর্ট শনাক্ত হয় সম্প্রতি। ঢাকা বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বিষয়টি তদন্ত করছেন।

সূত্র মতে, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট ইস্যুর পাসপোর্ট অধিদফতরে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। সিন্ডিকেটের সদস্যরা রোহিঙ্গা পাসপোর্ট ইস্যুর অপরাধে যখনই শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সম্মুখীন হন- তখনই তাদের রক্ষায় এগিয়ে আসেন প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত একজন শীর্ষ কর্মকর্তা। তবে এ ছুতোয় তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা।

রোহিঙ্গাদের নামে পাসপোর্ট ইস্যুর বিষয়ে কথা বলতে গতকাল রোববার শেরেবাংলা নগরস্থ বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদফতরে যান এ প্রতিবেদক। পাসপোর্ট মহাপরিচালকের অনুপস্থিতিতে কথা হয় অতিরিক্ত মহাপরিচালক (মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও অর্থ) এ টি এম আবুল আসাদের সঙ্গে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের নামে জ্ঞাতসারে কোনো পাসপোর্ট ইস্যু হয় না। ইস্যু হলেও এটির দায় পাসপোর্ট কর্মকর্তার নয়। পাসপোর্ট কর্মকর্তারা আবেদনপত্র গ্রহণের দায়িত্বে থাকলেও এত বিপুলসংখ্যক আবেদনকারীর যাচাই করা সম্ভব নয়। আবেদনপত্রে দেয়া জন্মনিবন্ধন এবং জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলে পাসপোর্ট কর্মকর্তাদের সাধ্য নেই কোনো আবেদনকারীকে পাসপোর্ট না দেয়ার। তাছাড়া রোহিঙ্গা আবেদনকারীরা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা এবং প্রাসঙ্গিক তথ্যের বিষয়ে এতটাই প্রশিক্ষণ নিয়ে আসে যে, তাদের রোহিঙ্গা হিসেবে শনাক্ত করা কঠিন। আমার প্রশ্ন- নির্বাচন কমিশন কী করে রোহিঙ্গাদের নামে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) ইস্যু করে? স্থানীয় সরকার কী করে জন্মনিবন্ধন ইস্যু করছে? আগে তাদের ধরুন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ