পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
দেশে কার্যত রাজনীতি নেই। তবে খবরের শিরোনাম এখন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ও বিএনপির অঙ্গ সংগঠন ছাত্রদল। দু’টি সংগঠন কার্যত টক অব দ্য কান্ট্রি। ছাত্রদলের কাউন্সিল স্থগিত করেছে আদালত। আর ছাত্রলীগের কমিটি ভেঙে দেয়া হচ্ছে এমন খবর মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচার হচ্ছে। এমনকি সংগঠনটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের গণভবনে প্রবেশের ‘পাস’ বাতিল করা হয়েছে বলেও খবর রটেছে। এরই মধ্যে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অভিযোগ করেছেন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির উন্নয়নমূলক কাজ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ চাঁদা দাবি করেছেন। প্রশ্ন হলো- মেধা ও মননের সংগঠন ঐতিহ্যবাহী ছাত্রলীগের কেন এই পরিণতি?
‘ছাত্রলীগের ইতিহাস স্বাধীনতার ইতিহাস, ছাত্রলীগের ইতিহাস বাঙালির ইতিহাস’ (শেখ মুজিবুর রহমান)। ছাত্রলীগ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর এই উক্তি যথার্থ। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ইতিহাসর গৌরব এবং অহঙ্কারের। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠার পর সংগঠনটি বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের আন্দোলন শুরু করে। অতঃপর ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট আন্দোলন-নির্বাচন, ’৫৮-এর আইয়ুবের মার্শাল ল’ বিরোধী আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৮ সালের কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাবিরোধী আন্দোলন, ঊনসত্তরের ছাত্র গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে গৌরবদীপ্ত ও অবিস্মরণীয় ভূমিকা ’৭১-এর মার্চ মাসের দুনিয়া কাঁপানো অসহযোগ আন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রলীগের অংশগ্রহণ সর্বজনস্বীকৃত। সেদিনের ছাত্রলীগের আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমদ, ওবায়দুল কাদেরসহ অনেকেই এখন আওয়ামী লীগে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। গৌরবময় ইতিহাসের সেই ছাত্রলীগে এখন চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির কালো মেঘ কেন? ছাত্রলীগে কেন এই পচন? ছাত্রলীগের রাজনীতি করার জন্য যারা গৌরববোধ করেন; তারা এখন সংগঠনটির কার্যক্রমে বিব্রতবোধ করছেন কেন?
বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া ছাত্রলীগের প্রথম আহ্বায়ক নির্বাচিত হন নাঈমুদ্দিন আহমদ। অতপর সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু হলে সভাপতি মনোনীত হন দবিরুল ইসলাম এবং সাধারণ সম্পাদক হন খালেক নেওয়াজ খান। বর্তমানে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রব্বানী। এর মাঝে অনেকেই ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়ে পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। দেশ-বিদেশে খ্যাতির শিখরে উঠেছেন। কিন্তু ছাত্রলীগের বর্তমান নেতৃত্বের মতো এতো সমালোচনা-বিতর্কের মুখে পড়তে হয়নি কোনো নেতাকে। প্রশ্ন হলো- ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ছাত্রলীগের কেন এই বেহাল দশা?
বঙ্গবন্ধু অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ছাত্র রাজনীতি করার সময় সিনিয়র নেতার চিঠি নিয়ে ট্রেনে রংপুর গিয়েছিলেন; পকেটে পয়সা না থাকায় সারাদিন কিছুই খাননি। ওই অবস্থায় রংপুর থেকে ফিরে ঢাকায় এসেছেন। ছাত্র ও যুব রাজনীতি করার সময় মাঝে মাঝে পুরান ঢাকার পার্টি অফিসের বেঞ্চেই ঘুমাতেন; সহকর্মীর মেসে থাকতেন। আর এখন ছাত্রলীগের নেতারা হেলিকপ্টার ভাড়া করে দাওয়াত খেতে যান। দামী গাড়ীতে চলাফেরা করেন। প্লট ফ্ল্যাটের মালিক। কর্মজীবন শুরুর আগের অঢেল বিত্তবৈভবের মালিক! ছাত্রলীগের নেতারা সভাপতির গাড়িতে উঠা নিয়ে নিজেদের মধ্যে রক্তারক্তি করেন, মাথা ফাটান। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের বদলে শিক্ষার্থীদের হলে উঠানোর নামে বাণিজ্য করেন। গণরুমে ছাত্রদের রেখে মিছিলে যেতে বাধ্য করেন। মিছিলে না গেলে রাতে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড হলেই ছাত্রলীগের ভাগ দিতে হয়। গতকালও পত্রিকায় খবরের শিরোনাম হয়েছে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে চাঁদা দাবির অভিযোগ তুলেছেন। তার অভিযোগ বর্তমানের ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বিপুল পরিমাণ চাঁদা দাবি করেছেন। ক্ষমতার শীর্ষ ব্যক্তিত্বের কাছে এই অভিযোগ দেয়ার পর ‘ছাত্রলীগ কমিটির’ এই বিতর্ক শুরু হয়।
এক সময় ছাত্রলীগকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী এমনকি সাধারণ মানুষও ভরসাস্থল মনে করতেন। বিপদগ্রস্ত মানুষ ছাত্রলীগের কোনো নেতাকে দেখলে ভরসা পেতেন। সেই ছাত্রলীগের নেতাদের দেখলে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। এই বুঝি বিপদ আসলো! বর্তমান পরিস্থিতি এমন যে চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলদারিত্ব, হুমকি-ধমকি, ঘুষ, দুর্নীতি, চোরাচালান, হত্যা-সন্ত্রাস, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, এমন কোনো অপকর্ম নেই যে ছাত্রলীগের নেতাদের নাম নেই। এমনকি চুরি-ডাকাতি, এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, মাদক ব্যবসা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের গায়ে হাত তোলা, শিক্ষকদের মারপিট সব খবরের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাদের নাম জড়িয়ে যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে তৃর্ণমূল পর্যন্ত একই চিত্র। যেখানে ছাত্রলীগ সেখানে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি আতঙ্ক। অপ্রিয় হলেও সত্য এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটির নাম শুনলেই মানুষ আতঙ্কিত হয়, ভয়ে কুকড়ে যায়। গ্রামগঞ্জের দাদি-মা-খালারা এক সময় ‘বর্গী এলো’ ভয় দেখিয়ে ছেলেমেয়েদের ঘুম পাড়াতেন। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে দর্জি বিশ্বজিৎকে ছাত্রলীগ নেতাদের কুপিয়ে হত্যার পর দাদি-মা-খালারা ‘ছাত্রলীগ এলো’ ভয় দেখিয়ে শিশুদের খুম পাড়ান।
ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টালে দেখা যায় ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা গ্রহণের পর ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ ও প্রতিপক্ষের সাথে সংঘর্ষে ১২৫ জন নিহত হয়েছে। সংগঠনটির নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হয়েছে অন্তত ৬০ জন। ছাত্রলীগের হাতে নিহত হয়েছে প্রতিপক্ষের ১১ জন এবং সাধারণ শিশু ও মানুষ নিহত হয়েছে ৫৪ জন। ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রতিপক্ষ্যের ওপর হামলা, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তারের জন্য সংঘর্ষ, গোলাগুলি, টেন্ডারবাজি, দখল বাণিজ্য, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, হলের সিট নিয়ন্ত্রণসহ নানা ইস্যুতে আলোচনায় আসছে সংগঠনটির নাম। পুরান ঢাকায় প্রকাশে দর্জি বিশ্বজিত হত্যাকান্ডের লোমহর্ষক দৃশ্যই শুধু টিভি পর্দায় দেশের মানুষ শুধু দেখেনি; বরিশালে কলেজের অধ্যক্ষকে চ্যাংদোলা করে পানিতে ফেলে দেয়া, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গায়ে এসিড নিক্ষেপ, জাহাঙ্গীর নগরে ছাত্রী ধর্ষণে সেঞ্চুরি, সিলেটের এমসি কলেজের হোস্টেলে অগ্নিসংযোগ, সারা দেশে ছাত্রলীগের নেতা নামধারীদের নারী ধর্ষণ এবং ধর্ষণের দৃশ্য ধারণ করে ভিডিও প্রচার কাহিনী ফেসবুকে প্রকাশ পেয়েছে। কোথাও কোনো অঘটন ঘটলে ছাত্রলীগের ওই শাখা কমিটি ভেঙে দেয়া হয়; অভিযুক্তকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এটাই যেন অপরাধের শক্তি!
সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ শক্তিশালী হয় কার্যত গণমানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের মাধ্যমে। বাংলাদেশ তো বটেই, এই উপমহাদেশেও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ পরবর্তীতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগই একমাত্র সংগঠন যে বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করে দেশের সর্ববৃহৎ সংগঠনে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রকাশ্য রাজনীতি আওয়ামী লীগের পাশাপাশি গোপন সংগঠন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ গঠন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন ছাত্রদের ছাড়া মুক্তির আন্দোলন সম্ভব নয়। এই সংগঠনই ’৭১-এর যুদ্ধে বিএলএফ বা মুজিব বাহিনী গঠন করে দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় ছাত্রলীগের গণমুখী অবদান ছাত্রলীগের ইতিহাসে উঠিয়েছে অন্যন্য উচ্চাতায়। মানুষের মুক্তির আন্দোলন করতে গিয়ে সংগঠনটির অসংখ্য নেতাকর্মী প্রাণ দিয়েছেন; জেল-জুলুম-কারাবরণ, নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।
যে ছাত্রলীগে এক সময় মেধার চর্চা হতো; মানুষ আশ্রয়স্থল মনে করতেন; সেই ছাত্রলীগের পচন শুরু হয় কার্যত ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে দ্বিতীয়বার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর। এখন সেই পচন ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেছে। সংগঠনটি কার্যত আওয়ামী লীগের কিছু নেতা লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সে সুযোগে সংগঠনটির নেতার অস্ত্রবাজি-চাঁদাবাজির মাধ্যমে বিত্তবৈভবের দিকে ঝুকে পড়েছেন। যার জন্য ছাত্রলীগে মেধা ও মননের জায়গা দখল করে নিয়েছে দুর্বৃত্তায়ন ও লোলুপতা। টেন্ডারবাজি, দখলদারিত্ব আর সন্ত্রাস যেন ছাত্রলীগের নামের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। মেধাশূন্য হয়ে পড়ছে সংগঠনটির নেতৃত্ব; অথচ সেখান থেকে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক নেতৃত্ব বের হয়ে আসার কথা।
প্রশ্ন হচ্ছে কেন সংগঠনটির নেতৃত্বের মধ্যে পচন ধরলো? সততা, আদর্শ, নির্লোভ ও ত্যাগের গণবান্ধব নেতৃত্ব নির্বাসিত হলো? আগেই উল্লেখ করেছি ছাত্রলীগের ইতিহাস গৌরবের অহঙ্কারের। সেই গৌরব যেন অতীত হয়ে গেছে কণ্ঠশিল্পী পথিক নবীর গানের মতোই। এরশাদের শামনামলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পথিক নবী গাইতেন ‘নদীর জল ছিল না, কূল ছিল না, ছিল শুধু ঢেঊ/ আমার একটা নদী ছিল জানলো না তো কেউ/ এই খানে এক নদী ছিল জানলো না তো কেউ’। ওই গানের মতোই বলতে হয় ছাত্রলীগের পরতে পরতে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ছিল; বর্তমান নেতাদের সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি-খুনাখুনি সংগঠনটির সেকালের উজ্জ্বল্যতার খবর এখন নতুন প্রজন্ম জানছে না। সেকালের ছাত্রলীগ আর এখনকার ছাত্রলীগের মধ্যেকার এই ফরাকের দায় কার?
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।