Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

সমাধান কোন পথে

রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ৩১ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:০৪ এএম, ৩১ আগস্ট, ২০১৯

দেশ-বিদেশ সর্বত্রই এখন আলোচনা রোহিঙ্গা ফেরত ইস্যু। রোহিঙ্গা ফেরত ইস্যুতে ভারত নীরব থাকলেও চীন বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব না দেয়ায় রোহিঙ্গারা ফেরত যেতে রাজি নয়। আবার কিছু এনজিও রোহিঙ্গাদের নিয়ে ব্যবসা করায় তারাও রোহিঙ্গাদের না যাওয়ার ব্যাপারে প্ররোচিত করছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দুই দফা ফেরতের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর চীনও রোহিঙ্গা ফেরত ইস্যু নিয়ে নতুন করে প্রস্তাব দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কোন পথে হবে রোহিঙ্গা ফেরত ইস্যুর সফল সমাধান?

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হামলা-নির্যাতন-ধর্ষণের মুখে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলিমদের তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক চুক্তি সই হয়েছে। ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে করা সেই চুক্তি অনুযায়ী দীর্ঘ আলোচনার পর দুই দফায় রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। গত ২২ আগস্ট ৩৪৫০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতি নেয়া হয়। কিন্তু নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, জমি ফেরতের গ্যারান্টি না পাওয়ায় রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীরা ফেরত যেতে আপত্তি জানায়। তাদের বক্তব্য এভাবে ফেরত যাওয়া মানেই স্বেচ্ছায় মিয়ানমারের বন্দিত্ব জীবন গ্রহণ করা। তবে বাংলাদেশের জন্য এত বিপুলসংখ্যক শরণার্থীকে দীর্ঘদিন ধারণ করা কঠিন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন জানিয়েছেন এই বিপুল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য গত দুই বছরে বাংলাদেশ সরকারের খরচ হয়েছে ৭২ হাজার কোটি টাকা। রোহিঙ্গাদের পেছনে প্রতি মাসে সরকারের খরচের পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি টাকা। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, রোহিঙ্গাদের বসতবাড়ির করতে অনেকগুলো পাহাড় ধ্বংস হয়েছে। তাদের দেখভাল করতে পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবিসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগ দিতে হয়েছে। রোহিঙ্গা না থাকলে রাষ্ট্রের এই খরচ দেশের মানুষের সুবিধায় অন্য কাজে লাগানো যেত।

জাতিসংঘ বলছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ৭ লাখ ৪৫ হাজার। এর আগে একই কারণে ১৯৭৮-৭৯, ১৯৯১-৯২ ও ১৯৯৬ সালেও মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা মুসলিমরা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয় নেয়ার পর রোহিঙ্গাদের জন্য তৈরি করা আশ্রয় ক্যাম্পে নতুন করে জন্ম নিয়েছে আরও ৬০ থেকে ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা শিশু। সব মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ১৮ হাজারের কিছু বেশি। এ তথ্য জানা গেছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সূত্রে। এদিকে ২০১৮ সালের জুন মাসে জাতিসংঘের তৈরি করা এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই ১০ লাখ রোহিঙ্গার পেছনে সরকারের বছরে ব্যয় হতে পারে কমপক্ষে ৬০ কোটি ডলার। দুই বছরে এর পরিমাণ ১২০ কোটি ডলার, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা। এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য। কোন প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়। এ অবস্থায় চীনের পাশাপাশি মালয়েশিয়াও রোহিঙ্গা ফেরত ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর চেষ্টায় ঢাকায় নিযুক্ত চীনের নতুন রাষ্ট্রদূত লি জিমিং দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন।

চীনের নতুন প্রস্তাব
দ্বিতীয় দফায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ফের আলোচনা শুরু করতে ‘নতুন প্রস্তাব’ দিয়েছে চীন। নোট ভারবালের মাধ্যমে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের বিবেচনায় ওই প্রস্তাব পাঠিয়েছে বেইজিং। ওই প্রস্তাবের অন্যতম হচ্ছে চীনের মধ্যস্থতায় দেশটির উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক আয়োজন। বাংলাদেশ যেখানে চাইবে চীন সেখানেই ত্রিপক্ষীয় ওই বৈঠক আয়োজনে আগ্রহী।

ঢাকায় নবনিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং ২৯ আগস্ট প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের কাছে পরিচয়পত্র পেশ করে বঙ্গভবন থেকে ফেরার পথে তিনি পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের সঙ্গে বেঠক করেন। সূত্র এ-ও বলছে, চীনের তরফে যে প্রস্তাব নোট আকারে দেয়া হয়েছে সেখানে বেইজিংয়ের মধ্যস্থতা সত্তে¡ও প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়াকে ‘দুঃখজনক’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে- রোহিঙ্গা সঙ্কটকে এভাবে চলতে দেয়া যায় না। চীন বরাবরই প্রত্যাবাসনের পক্ষে। এ নিয়ে তারা মিয়ানমারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে আলোচনায় যুক্ত রয়েছে। বাংলাদেশ সময় দিলে তারা ত্রিপক্ষীয় বৈঠক আয়োজনের চেষ্টা করবে বলেও এতে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়।

স্মরণ করা যায়, মিয়ানমার সরকারের নির্যাতন থেকে জীবন বাঁচাতে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশের পর দু’বছরে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ পর্যন্ত ৩ দফা বৈঠক হয়েছে। নিউইয়র্কসহ বিভিন্ন স্থানে ওইসব বৈঠক হয়। যার মধ্য দিয়েই দ্বিতীয় দফায় ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসনের চেষ্টা হয়েছিল। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থী আগমনের ঢল নেমেছিল। এদিন থেকে পরবর্তী এক মাসে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এখানে আগে থেকে ছিল প্রায় ৪ লাখ। বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার উখিয়া টেকনাফের বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া এসব শরণার্থীদের ৯২ হাজার শিশু জন্ম নিয়েছে। সব মিলে কক্সবাজারে এখন প্রায় সাড়ে ১১ লাখ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুর বসবাস করছে।

আবারও বৈঠকের আয়োজন
চলমান রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে আবারও মিয়ানমারের সঙ্গে বৈঠকে বসছে বাংলাদেশ। এ বৈঠকের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে থাকবে চীন। গত বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা ইস্যুর সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে ঢাকায় নিযুক্ত কূটনীতিকদের ব্রিফ করার পর সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় ব্রিফিং করেন। এর আগে ঢাকায় নবনিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে চীন গঠনমূলক ভূমিকা রাখবে বলে জানিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে লি জিমিং বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথম বৈঠকে রোহিঙ্গা সঙ্কটের টেকসই সমাধানের উপায়সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

প্রেস ব্রিফিংয়ে ড. মোমেন বলেন, চীনের মধ্যস্থতায় দুই দেশের বৈঠকের দিন-তারিখ ঠিক হয়নি। চীনের রাষ্ট্রদূত আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। তারা মিয়ানমারের সঙ্গে আলাপ করে আমাদের জানাবেন। চীন বলেছে, রোহিঙ্গা সঙ্কট নিরসনে বাংলাদেশের পাশে আছে। মিয়ানমার এবং বাংলাদেশ উভয় দেশই আমাদের বন্ধু। এ সমস্যা দূর করতে একযোগে কাজ করব। চীনের রাষ্ট্রদূত আমার সঙ্গে বৈঠকে বলেছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনায় প্রয়োজন হলে চীনকে সঙ্গে রাখেন। বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা যা যা করার করে যাব, করছি। কিন্তু আপনারা যারা গ্লোবাল লিডার আছেন, আপনাদেরও দায়-দায়িত্ব আছে। আমরা আপিল করেছি, আপনারা (আন্তর্জাতিক বিশ্ব) এই সমস্যা সমাধানে আরও অ্যাগ্রেসিভ, আরও বেশি করে উদ্যোগ নেবেন। কেননা, এটা শুধু আমাদের সমস্যা না, এটা সবার সমস্যা। রাষ্ট্রদূতদের উদ্দেশে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আপনারা আরও সক্রিয় উদ্যোগ নেবেন, যেন মিয়ানমারকে তাদের স্বজাতিকে নিজেদের দেশে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করা হয়। আমরা এখনো প্রত্যাবাসনের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু লোকগুলোকে সেখানে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে হবে মিয়ানমারকে। এছাড়া সেখানে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও চলাফেরার স্বাধীনতা বিষয়েও মিয়ানমারকে নিশ্চয়তা দিতে হবে।

কূটনীতিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, ঢাকায় যত কূটনীতিক আছেন এবং জাতিসংঘের এজেন্সিতে যারা কাজ করেন তাদেরকে জানিয়েছি, মিয়ানমার গত ২২ আগস্ট একটি প্রেস রিলিজ দিয়ে আমাদের ওপর ব্লেইম করেছে। বলেছে, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে ফেইল করেছে। সে প্রেক্ষিতে আজকে আমরা আন্তর্জাতিক বিশ্বকে বললাম, আমাদের (বাংলাদেশের) যা যা করার আমরা সব করেছি। দুই দেশের মধ্যে হওয়া চুক্তি মতে, মিয়ানমারের দায়িত্ব ছিল রোহিঙ্গাদের মাঝে আস্থা বা বিশ্বাসের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা, যাতে রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ফিরে যায়। কিন্তু মিয়ানমার সেই আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এখানে আমাদের দায়িত্ব ছিল লজিস্টিক সাপোর্ট জোগাড় করা, যা আমরা শতভাগ করেছি। মিয়ানমার প্রত্যাবাসনের জন্য ৩ হাজার ৪৫০ জনের তালিকা আমাদের দিয়েছিল।

‘রোহিঙ্গা তহবিলে’ গাইডলাইন
২০১৭ সালে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল শুরু হওয়ার পর থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা সহায়তা দিয়ে আসছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা- ইউএনএইচসিআর, আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা- আইওএম, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি- ইউএনডিপিসহ বিভিন্ন সংস্থা রোহিঙ্গাদের সহায়তায় কাজ করছে। এর মধ্যে সরকার ও ইউএনএইচসিআরের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সঙ্গেও জড়িত। গত বছরের ১৫ নভেম্বর এবং এ বছরের ২২ আগস্ট দুই দফা প্রত্যাবাসন চেষ্টায় রোহিঙ্গারা নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত যেতে রাজি কিনা তা দেখার দয়িত্ব ছিল ইউএনএইচসিআরের।
রোহিঙ্গাদের সহায়তা করার জন্য ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে দুই দফা জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান (জেআরপি) তৈরি করেছিল জাতিসংঘ। এটি বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বের কাছ থেকে তহবিলও সংগ্রহ করা হয়েছে। ২০১৮ সালে প্রথম জেআরপিতে সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শামীম আহসান এবং দ্বিতীয় জেআরপিতে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মাদ শাহরিয়ার আলম তহবিল সংগ্রহের জন্য বিশ্বের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। ২০২০ সালের জন্য জেআরপি তৈরির প্রস্তুতি চলছে। এবার ওই পরিকল্পনা তৈরির জন্য বাংলাদেশ নির্দিষ্ট একটি গাইডলাইন দিয়েছে। সরকার জাতিসংঘকে বলেছে- ওই গাইডলাইন অনুযায়ী জেআরপি তৈরি না হলে তহবিল সংগ্রহে বাংলাদেশ আর অংশ নেবে না।

জাতিসংঘের যেসব সংস্থা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কাজ করছে তাদের নিয়ে সরকার গত মাসে একটি বৈঠক করেছে। বৈঠকে ওই গাইডলাইনের বিষয়ে জাতিসংঘকে জানানো হয়। এ বিষয়ে সরকারের একজন কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ও জাতিসংঘসহ সবাই কাজ করছে। এই কাজগুলোর মধ্যে একটি সমন্বয় থাকতে হবে। তা না হলে বাড়তি সমস্যা তৈরি হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, কক্সবাজারে ছোট একটি জায়গায় প্রচুর রোহিঙ্গা থাকছে যা তাদের জন্য ভালো না। রোহিঙ্গাদের সুবিধার জন্য আমরা আড়াই হাজার কোটি টাকা খরচ করে ভাষানচরে তাদের জন্য আবাসস্থল বানিয়েছি। এটি আমাদের কর্মপরিকল্পনা কিন্তু জাতিসংঘ সেখানে যেতে আপত্তি করছে। এটি গ্রহণযোগ্য নয়।

রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে এবং গোটা বিষয়ে সরকারের মতামতের একটি গুরুত্ব থাকতে হবে বলে তিনি জানান। এ বিষয়ে তিনি বলেন, জাতিসংঘ যদি মনে করে তারা নিজেদের মতো করে সবকিছু ঠিক করবে তবে আমরা তাদের তহবিল সংগ্রহে আর সহায়তা করব না।
উল্লেখ্য, জেআরপি থেকে তহবিল সংগ্রহে বাংলাদেশ সহায়তা করে কিন্তু এর পুরো অর্থই জাতিসংঘের মাধ্যমে ব্যয় করা হয়।

গাইডলাইনের বিষয়ে তিনি বলেন, এবার জেআরপিতে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরে অর্থ বরাদ্দের জন্য তাদের আমরা বলেছি। এছাড়া কক্সবাজারে নিরাপত্তার জন্য বরাদ্দ রাখার বিষয়েও আমরা তাদের জানিয়েছি। জেআরপি থেকে তহবিল সংগ্রহে আমরা সহায়তা করি; কিন্তু এর কোনো হিসাব আমাদের জানায় না জাতিসংঘ। সেজন্য আমরা বলেছি- তারা এই তহবিল কোথায়, কোন খাতে, কত টাকা ব্যয় করছে সেটি যেন বিস্তারিত আমাদের জানায়। এছাড়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী খুব দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বিষয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা আগামী জেআরপিতে রাখার জন্য আমরা তাদের বলেছি।

বাংলাদেশের পাশে আছে মালয়েশিয়া
রোহিঙ্গা সঙ্কটের শুরু থেকেই বাংলাদেশের পাশে রয়েছে মালয়েশিয়া। এই সঙ্কটে মালয়েশিয়া সব সময় ইতিবাচক সাড়া দিয়ে আসছে। গতকাল শুক্রবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে ঢাকায় কর্মরত মালয়েশিয়ার ভারপ্রাপ্ত হাইকিমশনার আমির ফরিদ বিন আবু হাসান এ কথা বলেন।

মালয়েশিয়ার ৬২তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে দেশটির দুতাবাস। মালয়েশিয়ার হাইকমিশনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন দেশটির ভারপ্রাপ্ত হাইকিমশনার আমির ফরিদ বিন আবু হাসান।

মতবিনিময় অনুষ্ঠানে মালয়েশিয়ার ভারপ্রাপ্ত হাইকিমশনার বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটের শুরু থেকেই মালয়েশিয়া বাংলাদেশের পাশে আছে। এই সঙ্কট সমাধানে মালয়েশিয়া আসিয়ান ও আহা সেন্টারের সঙ্গে কাজ করছে। মালয়েশিয়ার সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে রোহিঙ্গাদের খাদ্য, অর্থ, বস্ত্র ও আশ্রয় সহায়তা দিয়ে আসছে। বাংলাদেশের টেকনাফের কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গাদের চিকিৎসার জন্য মালয়েশিয়ার সহায়তায় হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই হাসপাতাল থেকে এরই মধ্যে ৮০ হাজারের বেশি রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের ফেরত ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল বিতর্ক চলছে। গত ২২ আগস্ট দ্বিতীয়বারের মতো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দিন বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ঘুমধুম সীমান্তে রোহিঙ্গাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য বাস প্রস্তুত ছিল। ছিল প্রস্তুত বাস, ট্রাক ও নিরাপত্তা বাহিনী। কিন্তু আসলেই কি রোহিঙ্গা ফেরত শুরু হওয়ার কথা ছিল? রোহিঙ্গারা যে আবার মিয়ানমার নামে কারাগারে বন্দি হতে স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে চাইবে না, তা কি কারও অজানা ছিল? নাকি সবটাই কোনো পক্ষের সাজানো নাটক ছিল!

রাজনৈতিক চাপান-উতোর
বিএনপি রোহিঙ্গাদের এখনো মিয়ানমার ফেরত না নেয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করছে। তারা বলছে, বিএনপি ১৯৭৭ সালে ও ১৯৯১ সালে সফল ভাবে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধান করেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ব্যর্থ হয়েছে। তারা আন্তর্জাতিক মহলকে সংযুক্ত না করে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করে মিয়ানমারের ফাঁদে পা দিয়েছে। জবাব দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মানবতাবাদী শেখ হাসিনার রিফিউজি আলিঙ্গন করেছিলেন সীমান্ত খুলে দিয়ে, বিশ্বের কোনো দেশ কোনো রিফিউজি সমস্যা যখন এ ভাবে আশ্রয় দিয়েছে, বিশ্বের কোথাও পাবেন না। সারা বিশ্বে সমাদৃত শেখ হাসিনার রোহিঙ্গানীতি। এখন রোহিঙ্গাদের নিয়ে নানান খেলা খেলছে। পরোক্ষভাবে বিদেশি কিছু এনজিও ষড়যন্ত্র করছে। মিয়ানমারকে সহযোগিতা করছে। গতকালও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছেন, অচিরেই রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান হবে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছিল মানবিক কারণে। আন্তর্জাতিক মহল মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করলেই রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বাধ্য হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা

১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ