দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
মশা বর্তমান সময়ে একটি আলোচিত প্রসঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। হঠাৎ করে এডিস মশার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গু জ্বরে ভুগছে এমনকি বেশ কিছু মানুষের মৃত্যুও হয়েছে এ কারণে। সাধারণত মশার বাড়াবাড়ি আমরা শীত কালে লক্ষ্য করি। কিন্তু এ সময়ে কীভাবে এডিস মশার প্রকোপ বেড়ে গেল তা সংশ্লিষ্ট সকলকে সত্যিই চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। একটি ছোট্ট জীব কীভাবে মহা শক্তিশালী মানুষের মৃত্যুর কারণে পরিণত হতে পারে তা কি ভাবনার বিষয় নয়? এখানে কি আমাদের জন্যে কোন শিক্ষা আছে?
আল-কুরআনে মশা সম্পর্কে বিশেষ কিছু তথ্য দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, আল্লাহ নিঃসন্দেহে মশা বা তদুর্ধ¦ বস্তু দ্বারা উপমা পেশ করতে লজ্জাবোধ করেন না। বস্তুতঃ যারা মু’মিন তারা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করে যে, তাদের পালনকর্তা কর্তৃক উপস্থাপিত এ উপমা সম্পূর্ণ নির্ভুল ও সঠিক। আর যারা কাফের তারা বলে, এরূপ উপমা উপস্থাপনে আল্লাহর মতলবই বা কী ছিল? এ দ্বারা আল্লাহ তা’আলা অনেককে বিপথগামী করেন, আবার অনেককে সঠিক পথও প্রদর্শন করেন। তিনি অনুরূপ উপমা দ্বারা অসৎ ব্যক্তিবর্গ ভিন্ন কাউকেও বিপথগামী করেন না।” (সূরা আল-বাকারাহ, ২: ২৬)
এ আয়াতে সাতটি বিষয়ের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যেমন: (১) মশা সৃষ্টির মধ্যেও মানুষের জন্যে আল্লাহর নিদর্শন রয়েছে, (২) মশার চেয়েও ক্ষুদ্র সৃষ্টি রয়েছে, (৩) বিশ্বাসীরাই কুরআনে বর্ণিত বিষয়সমুয়ে সত্য সঠিক হিসেবে বিশ্বাস স্থাপন করে, (৪) অবিশ্বাসীরা কোন কিছুতেই আল্লাহর নিদর্শন বুঝতে পারে না, (৫) এরকম নিদর্শনও মানুষের জন্যে সঠিক পথের দিশা হতে পারে, (৬) আবার অনেককে বিপথগামী করতে পাওে, (৭) অসৎ ব্যক্তিদেরকে আল্লাহ কখনও সঠিক পথে নেন না।
বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লক্ষ্য করলেও আমরা আশ্চর্য্য হবো এটা জেনে যে, কুরআন যে তথ্য প্রায় চৌদ্দ শত বছর পূর্বে মানব জাতিকে দিয়েছিল তা আধুনিক বিজ্ঞান দ্বারা প্রমাণিত হওয়ায় শুধু কুরআনের বিশুদ্ধতা নয় বরং কুরআন যে একটি জীবন্ত মু’জেজা তাও বিবেচিত হচ্ছে। এ আয়াতে তিনটি বৈজ্ঞানিক বিষয়কে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে বলে ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। যথা:
১. প্রথমত: গঠনগত কারণে মশার সৃষ্টি অন্য যে কোন প্রাণি থেকে অনন্য এমনকি অন্যান্য উড়ান্ত পতঙ্গ থেকেও অনেকগুলো কারণে ভিন্ন।
২. দ্বিতীয়ত: কুরআনে ব্যবহৃত শব্দ ‘বাউদাহ’ মূলতঃ স্ত্রীবাচক শব্দ। যা নারী মশাকে বুঝায়। এবং আধুনিক বিজ্ঞান ইতিমধ্যে এটি প্রমাণ করেছে যে, শুধুমাত্র স্ত্রী মশাই মানুষের রক্ত খায়। রক্ত খায় তারা তাদের ডিমে নিউট্রিশনের প্রয়োজন পুরুণ করার জন্যে। এবং
৩. তৃতীয়ত: মশার চেয়েও ভিন্ন পতঙ্গ রয়েছে যারা তাদের উপরে প্রভাব বিস্তার করে বা তাদের থেকে রক্ত খায়। অত্যন্ত আশ্চর্য্যরে যে, ১৯২২ সালে প্রথম বিজ্ঞানী এফ.ডবিøউ এডওয়ার্ডস তার গবেষণা পত্রে দাবি করেন যে, দক্ষিণ এশিয়ার মালয় অঞ্চলে এমন এক ধরণের পতঙ্গ পাওয়া গেছে যা মশা থেকেই রক্ত খায়। এ প্রাণিটির নাম দিয়েছেন, কুলিকোইডস এনোফেলিস। (দেখুন: সায়েন্টিফিক আমেরিকা, মস্কিউটস হেভ ফ্লাইং, ব্লাড সাকিং প্যারাসাইট অব দিয়ার ওন, ২০১৪)
উল্লেখ্য, মশা সম্পর্কে আমাদের কিছু ভুল ধারণা আছে। তন্মধ্যে অন্যতম হলো, মশা বেঁচে থাকার জন্যে আমাদের রক্ত খায়। আসলে রক্ত মশার খাবার নয়। তারা বিভিন্ন ফল-মূল থেকে বেঁচে থাকার জন্যে জুস হিসেবে খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। রক্ত শুধু নারি মশাদের ডিম পাড়া জন্যে প্রয়োজন হয় এবং এটি তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে বাচিঁয়ে রাখার প্রয়াম মাত্র। কিন্তু এ রক্ত সংগ্রহ করার সময় তাদের দ্বারা বাহিত বিভিন্ন রকমের জীবানু আমাদের শরীরে প্রবেশ করে ফলে আমাদের বিভিন্ন রকম অসুখ হয়। অর্থাৎ স্ত্রী মশারাই আমাদের মশাবাহিত রোগের মূল কারণ।
মশার কথা আল্লাহ কেন কুরআনে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন তার কিছু অন্তর্নিহিত কারণ বুঝতে আধুনিক বিজ্ঞান আমাদেরকে সহায়তা করেছে। মশার আচারণ, প্রকৃতি ও গঠনগত দিক থেকে বেশ কিছু তথ্য তারা আবিস্কার করেছে যা সত্যিই সচেতন যে কাউকে ভাবনায় ফেলে দিবে। তন্মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হলো, (১) প্রায় ২৭০০ প্রজাতির মশা রয়েছে, (২) মশার একশ’র ও বেশি চোখ রয়েছে, (৩) মশার মুখে ৪৮ টা দাঁত রয়েছে, (৪) একটি মশার তিনটি পূর্ণ হার্ট (হৃদযন্ত্র) রয়েছে, (৫) মশার নাকে ছয়টি পৃথক ছুরি রয়েছে এবং প্রত্যেকটি ছুরির পৃথক ব্যবহার তারা করে থাকে, (৬) মশার শরীরে ডিজিটার এক্সরে মেশিন আছে যা রাতের আঁধারে মানুষের চামড়াকে সনাক্ত করার কাজে লাগায়, (৭) প্রত্যেক মশার নিজস্বভাবে এনেস্থেশিয়া দেয়ার জন্যে একধরণে ভ্যাকসিন আছে যা মানুষের শরীরে তাদের হূল ফোটানোর মাধ্যমে রক্ত নেয়ার সময় ব্যবহার করে সেই জায়গাটাকে অবশ করে নেয় যাতে রক্ত নিলেও কোন ব্যাথা না পাই আমরা, (৮) রক্ত পরীক্ষা করার বিশেষ ব্যবস্থা এদের আছে। কারণ, এরা সব ধরণের রক্ত পছন্দ করে না, (৯) পূণিমার সময়ে মশা প্রায় ৫০০ গুণ বেশি কামড়ায়, (১০) মশা উড়ার সময় সেকেন্ডে প্রায় ৫০০ বার তাদের পাখা নাড়ায়, (১১) বিশ্বব্যাপী মানুষের মৃত্যুর জন্যে সকল প্রাণীর মধ্যে মশাই বেশি দায়ী, (১২) ১৮ ফুট দূর থেকে তাদের টার্গেট ঠিক করতে পারে, (১৩) পুরুষের চেয়ে নারী মশারা বেশিদিন বাঁচে এবং (১৪) মশার মতো আরো একটি ক্ষুদ্র পতঙ্গ আছে যা মশা থেকেই রক্ত সংগ্রহ করে।
যদিও আধুনিক বিজ্ঞান মশা সম্পর্কে অনেক তথ্যই আমাদেরকে দিয়েছে তবুও আমরা বলব আরো অনেক তথ্যই অজানা রয়ে গেছে। কারণ, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আধুনিক বিজ্ঞান হিমশিম খাচ্ছে। কার্যকরী উপায় বের হবার আগেই প্রাণ হারাতে হচ্ছে শক্তিমান এ মানব জাতির অনেককেই। তাই, ভবিষ্যত বিজ্ঞান হয়ত সেগুলোকেও আমাদেরকে জানিয়ে দিবে।
আচ্ছা এতকিছু জানার পরেও কি মনে হচ্ছে মশার মধ্যে কোন নিদর্শন নেই? আমরা কি এখনও খুঁজে পাচ্ছি না মশার মাঝে আল্লাহর মহত্ত¡, কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা? যদি না পেয়ে থাকেন তাহলে আরো একটা আয়াতকে স্মরণ করিয়ে দেই আপনাদেরকে। আল্লাহ ঘোষনা করছেন, “হে মানব সম্প্রদায়, একটি উপমা বণনা করা হলো, অতএব তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শোন। তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের পূজা কর, তারা কখনও একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না, যদিও তারা সকলে একত্রিত হয়। আর মাছি যদি তাদের কাছ থেকে কোন কিছু ছিনিয়ে নেয়, তবে তারা তার কাছ থেকে তা উদ্ধার করতে পারবে না। প্রার্থনাকারী ও যার কাছে প্রার্থনা করা হয়, উভয়েই শক্তিহীন।” (সূরা আল-হজ, ২২: ৭৩)
আয়াতে আল্লাহর ক্ষমতা, কর্তৃত্ব সম্পর্কে শুধু নয় বরং আল্লাহ ব্যতীত অন্য সকলের অক্ষমতার কথা প্রকাশ করা হয়েছে। আর আল্লাহর ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সৃষ্টির মধ্যেও এমনভাবে নিহীত রয়েছে যা করার ক্ষমতা কারো তো নেই বরং সেসব বিষয়ের চিন্তা আমাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে।
মশা নিয়ে কুরআনের আরো একটি গল্প মনে করিয়ে দিতে চাই। মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম (আ.) এর সময়ের রাজার নাম ছিল নমরুদ। সে নিজেকে এতটাই উচ্ছতায় ভাবত যে, সৃষ্টিকর্তা হিসেবেও দাবি করেছিল। জন্ম, মৃত্যু, খাদ্যের জোগান সবকিছু তার ক্ষমতার মধ্যে বলেও দাবি করেছিল। তার সাথে নবি ইবরাহিম (আ.) এর একটি কথপোকথন আল্লাহ তা’আলা কুরআনে উল্লেখ করেছেন। (দেখুন: সূরা আল-বাকারাহ, ২: ২৫৮) এই নমরুদের সেনাবাহিনীকে শেষ করে দেয়া হয়েছিল অসংখ্য মশা দ্বারা। আর ছোট্ট এই মশা প্রবেশ করেছিল নমরুদের নাকের মধ্যে। শেষপর্যন্ত মৃত্যু হয়েছিল সৃষ্টিকর্তা দাবি করা এই পাপিষ্ঠের একটি মশার কারণে।
কুরআনের এ গল্পটি আমাদেরকে স্মরণ করে দেয় মশার ক্ষমতা এবং এর ব্যবহারের উদ্দেশ্য। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে যেমন আমাদেরকে পরীক্ষা করার নিমিত্তে¡ হতে পারে তেমনি আমাদের পাপের শাস্তিও হতে পারে। নমরুদের বেলায়ও তাই হয়েছিল।
একটু খেয়াল করলে দেখতে পাবো কী হচ্ছে বর্তমান পৃথিবীতে? কী পরিস্থিতি পার করছি আমরা। জীবন সেখানে অনিরাপদ হয়েছে বিভিন্ন কারণে। সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ সেখানে অগ্রণী ভ‚মিকা পালন করছে। বিচারবহিভর্‚ত হত্যা, নিরঅপরাধ মানুষদেরকে হত্যা, পাপের প্রসরতা, মদ ও মাদক দ্রব্যের ব্যপকতা, হারামকে হালাল মনে করার প্রবণতা, দূর্ণীতি বৃদ্ধি, ন্যায় বিচারের উপেক্ষা, ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি অনিহাসহ অন্যান্য কারণ কিন্ত বর্তমান পরিস্থিতির জন্যে দায়ী হতে পারে। আল্লাহই জানেন প্রকৃত রহস্য, উদ্দেশ্য। তদুপোরি, হঠাৎ করে আমাদের দেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বৃদ্ধি এবং ইতিমধ্যে কিছু প্রাণহানী কিন্তু আমাদেরকে অনেক কিছু জানিয়ে দেয়। অন্যান্য কার্যকরী পদক্ষেপের পাশাপাশি আল্লাহর রহমত ছাড়া এ পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের আশু কোন পথ দেখছি না। আমাদের প্রত্যেকের উচিত সৃষ্টিকর্তা যার ক্ষমতা শুধু অসীম না বরং সকল কিছুতে তাঁর কর্তৃত্ব সমসীন, চিরস্থায়ী তার কাছেই জীবনের সুস্থতা ও নিরাপত্তার জন্যে দু’আ করা প্রয়োজন। প্রিয় নবি মুহাম্মদ (সা.) একটি দু’আ আমাদেরকে শিখিয়েছেন। তারই ভাষায়, “আ’উযু বি কালামাাতিল্লাহি তাাম্মাতি মিন শার্রি মা খালাক¦া” (অর্থ: আল্লাহর পূর্ণ কালিমার বিনিময়ে তাঁর সৃষ্টির সকল অনিষ্ট থেকে পরিত্রাণ চাচ্ছি)” (দেখুন: সুনানু আবি দাউদ, হাদিস নম্বও ৩৮৯৮ এবং ৩৮৯৯)। আল্লাহ আমাদেরকে সুস্থ ও নিরাপদ রাখুন!
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।