বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
আল্লাহ তায়ালার প্রাকৃতিক নিয়ম নিঃসন্দেহে খুবই বিজ্ঞানসম্মত ও কৌশলপূর্ণ। সৃষ্টিজগৎ পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যে নীতিমালা বা রীতিপদ্ধতি প্রণয়ন করেছেন; আল্লাহর হুকুম ছাড়া তার কোনো ব্যত্যয় হয় না। যেমন দুনিয়াকে তিনি দারুল আসবাব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তাই ইহকালে কোনো নিয়মনীতি, বিজ্ঞান, মাধ্যম ও কারণ ছাড়া কোনো কিছু সংঘটিত হয় না। ‘হওয়া সম্ভব নয়’ এমন নয়, তবে হয় না।
এরপরও মানুষ যেন রীতি, নীতি, পদ্ধতি, বিজ্ঞান, মাধ্যম ও কারণকেই স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করে না বসে এবং প্রকৃতিকে যে প্রতিমুহূর্তে আল্লাহ নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করছেন, এ কথাটি ভুলে না যায়, সেজন্য মানুষের ইতিহাসে মহান আল্লাহ তায়ালা অনেকগুলো কুদরত এমন প্রদর্শন করেছেন, যা তাঁর নিরঙ্কুশ ইচ্ছা ও ক্ষমতাকে সুদৃঢ়ভাবে প্রমাণ করেছে।
সূর্যের মতো স্পষ্ট করে দিয়েছে যে নীতি, পদ্ধতি ও প্রকৃতি আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তা অনুসরণে তিনি নিজে বাধ্য নন। তবে মহাসৃষ্টিকে তার নির্ধারিত সময়কাল পর্যন্ত ধারণাতীত সুচারুরূপে পরিচালিত করার জন্য তিনি তার সুন্নত বা রীতিপদ্ধতি বেঁধে দিয়েছেন।
যেমন পিতা-মাতার মতো উৎস ছাড়া হযরত আদমকে সৃষ্টি। আবার পিতা-মাতা ছাড়া কিন্তু আদমের দেহের কোষ থেকে হযরত হাওয়াকে সৃষ্টি। সমস্ত জনপদকে পানিতে ডুবিয়ে ধ্বংস করেছেন, কিন্তু হযরত নূহ আ. ও তার নৌযানের মানুষ ও প্রাণীগুলোকে রক্ষা করেছেন। আগুনের চিরাচরিত দহনশক্তি কেবল হযরত ইবরাহীম আ.-এর জন্য রহিত করে সেদিনকার জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডকে তার জন্য শান্তি ও শীতলতার বিছানায় পরিণত করেছিলেন।
নবী-রাসূল ও তাঁর অনেক মনোনীত নেক বান্দাদের জীবনে সর্বশক্তিমান আল্লাহ অনেক অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটিয়েছেন, যা দুনিয়ায় প্রচলিত তাঁর রীতিপদ্ধতির বাইরে। তালাশ করে উদাহরণ পেশ করলে এমন অনেক ঘটনা পাওয়া যাবে। বলতে গেলে নবীগণের সমস্ত মোজেযা ও সালেহিনের সমস্ত কারামত এরই অন্তর্ভুক্ত।
সদ্যজাত শিশুর মুখে বুলি ফোটানো যেমন হযরত ঈসা আ. তাঁর মায়ের পবিত্রতার বিষয়ে সম্প্রদায়ের লোকদের আশ্বস্ত করেছিলেন। যেমন মিসরের শাসকের প্রাসাদে দুগ্ধপোষ্য কোলের শিশু হযরত ইউসুফ আ.-এর নিষ্কলুষ চরিত্রের কথা অপূর্ব এক যুক্তির মাধ্যমে ঘোষণা করেছিল। সেখানে শিশুটির বাকশক্তি শুধু নয়, তার যুক্তি ও বুদ্ধির অতুলনীয় ব্যবহারও সর্বশক্তিমান আল্লাহর স্বপ্রচলিত ও স্বনির্ধারিত রীতিপদ্ধতির ব্যতিক্রম, যা তিনি তাঁর সর্বময় ক্ষমতার নিদর্শন হিসেবে মানুষের সামনে পেশ করেছেন, যাতে মানুষ স্বাভাবিক নিয়ম বা প্রকৃতির রীতিকে অবধারিত ও স্বয়ংক্রিয় মনে না করে বসে।
যে বড় দাগের ভুলটি ন্যাচারালিস্ট নামের নাস্তিক সম্প্রদায় করে থাকে। বাংলায় যাদের প্রকৃতিবাদী বলা যেতে পারে। তারা অজ্ঞতাবশত ধরে নিয়ে থাকে যে, জীবন জগতের কোনো স্রষ্টা নেই। এর খবর রাখার, পরিচালনা করার, নিয়ন্ত্রণ করার বা শেষ পর্যন্ত এর সমাপ্তি এবং পরিণতি ঘটানোর মতো কেউ নেই। প্রকৃতি নিজেই তার নিয়মে সৃজন, বিকাশ ও ধ্বংস করে যাচ্ছে।
এ মতবাদটি অবাস্তব ও অজ্ঞতাজনিত দুর্বলতার কারণে জন্ম নিয়েছে। যার অনুসারীরা বলে, আমাদের এ জীবন, জন্মলাভ ও মৃত্যু ছাড়া আর কী। চলে আসা নিয়মেই আমাদের জন্ম, নির্দিষ্ট সময়ে এখানে থাকা ও প্রকৃতির নিয়মেই চলে যাওয়া। মাঝে কিছু সময়ের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, প্রাপ্তি ও বঞ্চনামাত্র।
আর যারা সৃষ্টিকর্তার ওপর ঈমান রাখে তারা নিজের সীমিত চিন্তাশক্তি কিংবা দুর্বল দৃষ্টিশক্তির ওপর নয়; বরং তারা নির্ভর করে সর্বশক্তিমানের বাণীর ওপর। তাঁর দেয়া বার্তা, নির্দেশনা ও জ্ঞানের ওপর; যা তিনি পৃথিবীর বাসিন্দা ও মানবকুলের মনোনীত নবী-রাসূল শ্রেণির কাছে প্রেরণ করেন। ঈমানদাররা আল্লাহর কালামের মধ্যেই আল্লাহর বিস্তারিত পরিচয় পেয়ে থাকেন।
আল্লাহ নিজেকে মানুষের চিন্তা ও উপলব্ধির ঊর্ধ্বে এমন এক সত্তারূপে পরিচিত করেছেন, যিনি আকাশ ও জমিনের তথা গোটা সৃষ্টিজগতের নূর বা জ্যোতি। যার সম্ভাব্য বর্ণনা পবিত্র কোরআনে এভাবে এসেছে, ‘আল্লাহ হলেন জমিন ও আকাশমন্ডলীর নূর বা জ্যোতি। তার নূরের উপমা এই যে, যেন একটি শামাদান বা দীপাধার। তাতে একটি প্রদীপ। প্রদীপটি রয়েছে একটি কাচাবরণের মাঝে। কাচটি যেন একটি মণি-মাণিক্যের নক্ষত্র। যা প্রজ্বলিত আছে একটি মহান জ্বালানি-বৃক্ষ যাইতুনের উৎস থেকে। যেটি পূর্ব বা পশ্চিম কিংবা কোনো দিকের সাথে সীমাবদ্ধ নয়।
বৃক্ষের তেল যেন নিজ থেকেই প্রদীপ হয়ে জ্বলে উঠছে, যদিও আগুন তাকে স্পর্শ করেনি। আলোয় আলোয় ভরা আলোকময় অস্তিত্ব। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন তাকে আলোর পথ দেখান। তার জ্যোতির পানে টেনে নেন। আর আল্লাহ মানুষের জন্য উদাহরণ পেশ করে থাকেন। বস্তুত আল্লাহ প্রতিটি বিষয়ে পরম জ্ঞানী। - সূরা নূর, (২৪) : ৩৫।
আল্লাহ নূর হিসেবে, পরম শক্তির আধার হিসেবে, সৃষ্টিজগতের স্রষ্টা, নিয়ন্তা ও বিধাতা হিসেবে এক, একক ও অদ্বিতীয়। যাকে ধারণা বা কল্পনা করা যায় না। যাকে ক্ষুদ্র ও দুর্বল মানুষ অনুভব বা উপলব্ধিও করতে পারে না। মানবিক অক্ষমতায় সে কেবল আল্লাহর নিজপ্রদত্ত পরিচয়টুকু লাভ করতে সক্ষম। আল্লাহকে সে স্মরণ করতে পারে। তাকে ভালোবাসতে পারে। তাকে ভয় করতে পারে। তাঁর সাথে মন, মেধা ও অস্তিত্বের সবটুকু দিয়ে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে। নিবেদনের দীপ জ্বেলে আল্লাহর সকাশে নিজের সবটুকু আবেগ নিংড়ে উপস্থাপন করতে পারে। নিজের দুঃখ, কষ্ট, যাতনা, অভাব, অভিযোগ, প্রার্থনা নিঃশেষে প্রকাশ করতে পারে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।