হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মোবায়েদুর রহমান
আসুন, আমরা কল্পনায় একটি দৃশ্য দেখি। আপনি একজন গরিব বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। আপনি একটি অসুখ নিয়ে একজন ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার সাহেব আপনাকে ভাল করে দেখলেন এবং কতগুলো পরীক্ষা করতে বললেন। আপনি ডাক্তার দেখালেন কিন্তু তার চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসার সময় আপনাকে কোন পয়সা বা ফি দিতে হলো না। বেরিয়ে এসে কয়েকটি টেস্ট করালেন। টেস্ট করানোর জন্যও আপনাকে কোন ফি দিতে হলো না। ২/১ দিন পর ঐ সব টেস্ট রিপোর্ট নিয়ে আপনি ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার আপনাকে প্রেসক্রিপশন দিলেন। প্রেসক্রিপশনে কয়েকটি ওষুধের নাম লেখা আছে। আপনি প্রেসক্রিপশন নিয়ে বেরিয়ে এলেন। এবারেও আপনাকে কোন পয়সা দিতে হলো না। অতঃপর ঐ প্রেসক্রিপশন নিয়ে আপনি একটি ফার্মেসি বা ওষুধের দোকানে গেলেন। ফার্মেসিওয়ালা আপনাকে ওষুধ দিলেন। আপনি ওষুধগুলো নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন। ওষুধ নিতেও আপনাকে কোন পয়সা দিতে হলো না। ঘরে ফিরে আপনি ওষুধ খাওয়া শুরু করলেন। চিকিৎসার এই সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় কোথাও আপনাকে কোনো টাকা পয়সা খরচ করতে হলো না।
এমন একটি দৃশ্য কি আপনি কল্পনা করতে পারেন? নিশ্চয়ই পারেন না। কিন্তু এমন ঘটনা ঘটে। পৃথিবীর অনেক দেশেই এভাবে চিকিৎসা করা যায়।
দ্বিতীয় দৃশ্য কল্পনা করুন। আপনি একটি বড় অসুখ নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেন। ডাক্তার সাহেব আপনাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন। তারপর টেস্ট রেজাল্ট দেখে বললেন, আপনাকে একটি মেজর অপারেশন করতে হবে। হসপিটালে ভর্তি, কেবিন চার্জ, অপারেশন, ওষুধপত্র সব কিছু মিলিয়ে হসপিটালে ১০ দিন থাকার পর আপনি সুস্থ হয়ে ফিরে এলেন। এই সামগ্রিক চিকিৎসা বাবদ আপনার চিকিৎসা বিল এলো ৫ লাখ টাকা। ৫ লাখ টাকার মধ্যে আপনি মাত্র ১ লাখ টাকা দিয়ে হসপিটাল থেকে রিলিজ অর্ডার নিয়ে ফিরে এলেন। অথবা একটি পয়সাও পেমেন্ট না করেই হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ সার্টিফিকেট নিয়ে ফিরে এলেন।
এই ধরনের দৃশ্য কি বাংলাদেশে কল্পনা করা সম্ভব? মোটেই সম্ভব নয়। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশেই এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। বিশ্বাস হয় না? না হলে আপনাকে আমি দুয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি।
॥ দুই ॥
আমি এবং আমার সহধর্মিণী কয়েক বছর আগে গ্রিনকার্ড পেয়ে আমেরিকা গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে প্রথমে গ্রিনকার্ডটি বের করতে হলো। তারপর অন্য অফিসে গিয়ে হেলথ কার্ড বের করতে হলো। হেলথ কার্ড বের করার পর আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হলো আমরা আমেরিকার ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে কোন রাজ্যে সেট্ল করব। সাতপাঁচ ভেবে আমরা নিউইয়র্কে সেট্ল করার সিদ্ধান্ত নিলাম। যে কয়দফা আমরা আমেরিকা যাই তার মধ্যে অন্তত ৩ দফায় আমরা দুজনেই অসুস্থ হয়ে পড়ি। আমরা দুজনই চিকিৎসা করাই এবং উপরে যেসব বর্ণনা দিলাম সেভাবেই আমাদের চিকিৎসা হয়। আমাদের সমগ্র চিকিৎসা বিনামূল্যে সম্পাদিত হয়। চিকিৎসা খরচ বহন করে সরকার। আমাদের কাছে যে হেলথ কার্ড ছিল বা স্বাস্থ্য বীমা ছিল সেই স্বাস্থ্য বীমার অধীনে খরচ নির্বাহ করা হয়। আমাদের শুধুমাত্র বিলের ওপর সই করতে হয়। ডাক্তার সাহেব বা হসপিটাল কর্তৃপক্ষ সরকারের নিকট থেকে সেই বিলের টাকা পায়।
আমার এক শ্যালক বাস করে আমেরিকার ভার্জিনিয়াতে। সে একটি দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। মেজর সার্জিক্যাল অপারেশনে বাংলাদেশী মূল্যে তার বিল উঠে ৮০ লাখ টাকা। তাকে পেমেন্ট করতে হয় ১৫ লাখ টাকা। আমাদের মতই সেও হেলথ ইন্স্যুরেন্স কার্ডের অধীনে এই চিকিৎসা সুবিধা পায়। আজও সে বেঁচে আছে এবং বহাল তবিয়তে ভার্জিনিয়াতে পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে দিন কাটাচ্ছে।
এসব কথা মোটামুটি সকলেই জানেন। আজ আনুমানিক দেড় থেকে ২ কোটি বাংলাদেশী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। এরা হলেন বাংলাদেশী ডায়াসপোরা (উরধংঢ়ড়ৎধ)। তাদের কয়েক কোটি আত্মীয়স্বজন বাংলাদেশে বাস করেন। তারা এসব সুযোগ-সুবিধার কথা নিশ্চয়ই জানেন। যারা জানেন না শুধুমাত্র তাদের জন্য আমি এসব কথা বলছি।
আরো দুটি ঘটনা বলে উদাহরণ দেয়া শেষ করব। গত বছর আমি একা অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলাম। তার আগে আমি সপরিবারে যাই। প্রথমবার আমার অর্ধাঙ্গিনী অসুস্থ হয়ে পড়েন। আমরা তো অস্ট্রেলিয়ার নাগরিকও নই, অথবা পার্মানেন্ট রেসিডেন্টও (পিআর) নই। সুতরাং আমরা সেখানে চিকিৎসাসেবা পাব কেন? কিন্তু সেখানেও একটি ব্যবস্থা আছে। যেদিন আমি বা আমরা অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে নামি সেদিন বা তার পরদিন আমাদের ছেলে আমাদের নামে হেলথ ইন্স্যুরেন্স করে। বিদেশীদের জন্য বিভিন্ন প্রকার হেলথ ইন্স্যুরেন্স রয়েছে। সেটা অস্ট্রেলিয়ান ১০০ ডলার থেকে শুরু করে ২০০, ৩০০, ৫০০ ডলার- এই ধরনের বিভিন্ন পর্যায়ের ইন্স্যুরেন্স রয়েছে। আমরা দুজন ১০০ ডলার করে দুজন ২০০ ডলারের হেলথ ইন্স্যুরেন্স করি। কথায় বলে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। সেখানেও আমরা ছোটখাটো অসুখে পড়ি। আমাদের দুজনের বিল আসে ১১০০ ডলার। অথচ আমাদের কোন পেমেন্ট করতে হয় না। ঐ ২০০ ডলারের মধ্যেই সব কাভার্ড হয়ে যায়।
॥ তিন ॥
সবশেষে ইংল্যান্ডের কথা বলি। ম্যানচেস্টারে আমার ছোট বোন থাকে। আমি যখন ম্যানচেস্টার পৌঁছি তখন আমার হাতের একটি হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিল। প্লাস্টার করা অবস্থাতেই আমি সেখানে যাই। আমার তো সেখানে চিকিৎসাসেবা পাওয়ার কথা না। আমি খুব সংকোচ করছিলাম। বোনের ঘাড়ে চিকিৎসা বাবদ এতগুলো পাউন্ডের বোঝা চাপিয়ে দেব? কিন্তু আমার সংকোচ ও ভয় দূর করে আমার বোন বলল, ‘মেজদা, আপনি চিন্তা করবেন না। আমার প্যারেন্ট ক্যাটাগরিতে আমি আপনার ট্রিটমেন্ট করব।’ প্রথমে একজন জিপিকে দেখনো হয়। জিপি আমাকে হসপিটালে রেফার করেন। চারদিন পর হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসি। আমার জন্য আমার বোনকে কোনো পাউন্ড খরচ করতে হয়নি।
সবশেষে আরেকজনের কথা না বললেই নয়। ‘দৈনিক ইনকিলাবে’ আমার এক কলিগ ছিলেন। তিনি ভিজিট ভিসা নিয়ে নিউইয়র্ক যান। সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় বা পলিটিক্যাল অ্যাসাইলামের জন্য আবেদন করেন। অ্যাসাইলাম পেতে তার বেশ কয়েক বছর লাগে। যতদিন অ্যাসাইলাম পাননি ততদিন তিনি ছিলেন ইল্লিগ্যাল বা অবৈধ। ইল্লিগ্যালরা কোথাও কোন বেনিফিট পায় না। তো, আমার সেই কলিগ একবার গুরুতর অসুস্থ হন এবং তার বন্ধুরা তাকে হসপিটালে নিয়ে যায়। হসপিটাল কর্তৃপক্ষ জানতে চায়, রোগী কি আমেরিকার নাগরিক? উত্তর হলো, না। তারপর ওরা জানতে চায়, রোগী কি আমেরিকার পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট বা গ্রিনকার্ড হোল্ডার? উত্তর হলো, না। তখন ওরা ফের জানতে চায়, রোগীর কি কোন ওয়ার্ক পারমিট রয়েছে? উত্তর হলো, না। তখন চিকিৎসকরা একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে থাকেন। তারা প্রকাশ্যেই বলেন, এই রোগীর চিকিৎসা কোন বীমার আন্ডারে হবে? সে তো ইল্লিগ্যাল। তার চিকিৎসার কোন রাস্তাই খুঁজে পাওয়া যায় না। তখন একজন চিকিৎসক দৃঢ়তার সাথে বলেন, “আসুন, আমরা এখনই চিকিৎসা শুরু করি। ঐসব প্রশ্ন ভেবে বেশি দেরি করলে এই রোগী মারা যাবে। আমরা আমেরিকাতে বিনা চিকিৎসায় একটি মানুষকেও মরতে দিতে পারি না, সে দেশী হোক বা বিদেশী হোক, সে লিগ্যাল হোক আর ইল্লিগ্যাল হোক।’
এরপর তার চিকিৎসা শুরু হয়। ৭ দিন পর আমার সেই প্রাক্তন কলিগ সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসে। নিউইয়র্কে আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘তোমাকে কোন টাকা-পয়সা দিতে হয়নি?’ সে বলে, ‘আমি বেকার, টাকা-পয়সা পাব কোথায়? এ কথা আমি ডাক্তারদের সাফ জানিয়ে দিয়েছি। ডাক্তাররা পরে সম্ভবত পরিস্থিতির বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের নিকট পত্র লেখে। স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সেই পত্র পড়ে বিশেষ ব্যবস্থাধীনে বিল পরিশোধ করে।’
প্রিয় পাঠক ভাইবোনেরা, এমন একটি দৃশ্য কি আপনারা বাংলাদেশে কল্পনা করতে পারেন? এখানে ডাক্তারের কাছে বা হসপিটালে গেলে প্রথমেই আপনাকে যেটি করতে হবে, সেটি হলো, ‘ফেল কড়ি, মাখ তেল।’ আপনি যদি মাল দিতে না পারেন তাহলে হসপিটালের বারান্দায় আপনি মরে পড়ে থাকবেন। কেউ আপনার জন্য একফোঁটা অশ্রুও বিসর্জন দেবে না। আপনি যদি ডাক্তারের ফি দিতে না পারেন তাহলে বাইরে যে লোকটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট তালিকা মেইনটেইন করে সে আপনাকে ঢুকতেই দেবে না। অথচ আমরা কত প্রকারের চেতনার কথা বলি। এই চেতনা, সেই চেতনা ইত্যাদি। কিন্তু কেউ কি মানবতার চেতনার কথা বলে? যেমন বলেছিলেন, আমেরিকার সেই চিকিৎসকরা? বলেছিলেন, ‘আমরা আমেরিকাতে বিনা চিকিৎসায় একটি মানুষকেও মরতে দিতে পারি না, সে দেশী হোক বা বিদেশী হোক, সে লিগ্যাল হোক আর ইল্লিগ্যাল হোক।’ আমরা বাংলাদেশে সেই ধরনের মানুষ চাই, সেই ধরনের চিকিৎসক চাই। এখানে সব চেতনা এসে মিলিত হোক একটি বিশেষ চেতনায়। সেটি হলো মানবতার চেতনা। রবীন্দ্রনাথ একটি প্রেমের গানে লিখেছেন,
কেটেছে একেলা বিরহের বেলা
আকাশকুসুম-চয়নে।
সব পথ এসে মিলে গেল শেষে
তোমার দুখানি নয়নে।
আমি আগেই বলেছি, এটি রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গান। আমরা গানের মূল সুরটিকে একটু ঘুরিয়ে মানবতার পথে কি ধাবিত করতে পারি না? যেখানে বলতে পারি, ‘সব পথ এসে মিলে গেল শেষে / মানবতার ঐ চরণে।’ সেই পথে অর্থাৎ মানবতার পথে আমাদের চেতনার উদ্বোধন ঘটাতে হবে। আর সেটা করতে হলে প্রয়োজন সেই ধরনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা রাজনৈতিক দল। এখানে আমি আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী বা জাতীয় পার্টি বুঝতে চাই না। আমার এখন একমাত্র আকুতি হচ্ছে কুসুম কুমারী দাসের সেই অমর কবিতার চার লাইন।
আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?
মুখে হাসি, বুকে বল তেজে ভরা মন
‘মানুষ হইতে হবে’ --- এই তার পণ।
Email: [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।