সিয়াম ও অর্থনৈতিক সংযম
এ. জেড. এম. শামসুল আলমউপবাস থাকা সিয়াম সাধনার প্রধান অঙ্গ হওয়ার তাৎপর্য কি?আদম সন্তানের প্রথম
মুহাম্মদ বশির উল্লাহ
সময়ের আবর্তে আরবি সনের এগারোটি মাস অতিক্রম করে আমাদের কাছে হাজির হয়েছে রহমাতের ঝর্ণাধারা রমজানুল মুবারক। বহু প্রতীক্ষিত বস্তু যখন সুন্দর উপস্থাপনায় কারো কাছে উপস্থিত হয় তখন আর আনন্দের কোন সীমা থাকে না। তেমনি, চাতক পাখির ন্যায় দীর্ঘ এগারোটি মাস প্রতীক্ষার পর মুসলমানদের কাছে যখন মাহে রমজানুল মুবারক উপস্থিত হয় তখন প্রবাহিত হতে থাকে রহমাতের ঝর্ণাধারা। খুলে দেয়া হয় ক্ষমার দুয়ার। খুলে দেয়া হয় জান্নাত। আকাশের দরজা। বন্ধু করে দেয়া হয় জাহান্নামের দরজা। কবর আযাব। শয়তানকে করা হয় শিকলবন্দি। পবিত্র করে তোলা হয় মানুষকে। পাপ থেকে করা হয় মুক্ত। ধনীরা আদায় করতে থাকে গরিবের হক। আদায় করতে থাকে যাকাত। আদায় করে ফিতরা। পাপীরা তাওবার মাধ্যমে ফিরে আসে সত্যের দুয়ারে। ধনী-গরিব, শত্রু-মিত্র দাঁড়িয়ে যায় একই কাতারে। শুরু হয় শান্তি, সৌহার্দ্যরে অপরূপ লীলা ও রহমাতের ঝর্ণাধারা।
কৃচ্ছ্রসাধনা, ত্যাগ, সংযম এবং পরহিতৈষণার মহান বার্তা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয় হিজরি সালের নবম মাস মাহে রমজান। এ মাসকে মহান আল্লাহ তা’আলা জাল্লা শানহু সিয়াম পালনের মাস হিসেবে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এ মাসের প্রতিটি ক্ষণ-অনুক্ষণ মহান আল্লাহ তা’আলা জাল্লা শানহু’র খাস রহমতে পরিপূর্ণ। এ মাস এক অসাধারণ মাস। নিঃসন্দেহে এ মাস স্বতন্ত্র ও মাহাত্ম্যের দাবি রাখে।
সমগ্র মুসলিম জাহানে রহমাত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস মাহে রমজানের কঠোর সিয়াম সাধনা শুরু হয়। দীর্ঘ এক মাসব্যাপী রমজানের কঠোর পরিশ্রম ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে মহান আল্লাহ তা’আলা জাল্লা শানহুর তাকওয়া অর্জন ও এর সামগ্রিক সুফল সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারলে বিশ্বব্যাপী মানবতার শান্তি ও সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত হবে। রমজানের রোজা সাধনার মাধ্যমে মানুষের অন্তরের রিপুকে মহান আল্লাহ তা’আলা জাল্লা শানহুর তাকওয়া অর্জনের মাধ্যমে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিশ্চিত করা হয়। অন্তরের পশু প্রবৃত্তি তথা নফসে আম্মারাকে বশীভূত করে মানুষ নফসে লাওয়্যামা ও নফসে মুতমাইন্না (সর্বোচ্চ প্রশান্ত আত্মা)-এর পর্যায়ে উপনীত হয়। প্রকৃত রোজাদার তাই এ মাসে আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংশোধনের পর্যায় উপনীত হয়। আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংশোধনের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তা’আলা জাল্লা শানহুর নৈকট্য লাভ করে। আর সত্যিকার সিয়াম সাধনার মাধ্যমে সমাজ থেকে সকল অন্যায়, অনাচার, ব্যভিচার ও সন্ত্রাস দূরীভূত হয়। গোটা ব্যক্তি জীবনে নিরাপদ ও নির্বিঘেœ জীবনযাপনের নিশ্চয়তা লাভ করা যায়। এখন আমরা দেখবো মাহে রমজান সম্পর্কে পবিত্র কুরআন, হাদিস ও আধুনিক বিজ্ঞান কি বলে।
মহাগ্রন্থ আল কুরআন। মানব জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সংবিধান। ইসলামের যাবতীয় বিধানের মৌলিক দিকগুলো তাতে বিধৃত আছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তা’আলা জাল্লা শানহু বলেন, ‘আমি এই কিতাবে কিছুই বাদ দেইনি।’ (সূরা আনয়াম : ৩৮) তাই আমরা যদি পবিত্র আল কুরআনে রোজা সংক্রান্ত আয়াতগুলো পর্যবেক্ষণ করি তবে দেখতে পাব, রোজা ও তৎসংশ্লিষ্ট অধিকাংশ বিধি-বিধান এবং আদব-কায়দা এতে বর্ণিত রয়েছে। এখানে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত রোজা ও তৎসংশ্লিষ্ট কিছু আয়াত নি¤েœ উপস্থাপনা করা হলো।
“হে মু’মিনগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়ছিলো তোমাদের পূর্বপবর্তীদের উপর। যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার।” (সূরা বাকারা : ১৮৩)
“এ রোজা নির্দিষ্ট কয়েক দিনের। তোমাদের মধ্যে কেউ রোগাক্রান্ত হলে অথবা সফরে থাকলে এ সংখ্যা পূরণ করে নিতে হবে অন্য সময়। আর এ রোজা যাদের জন্য অতিশয় কষ্টকর, তাদের এর পরিবর্তে ফিদ্্য়া দিতে হবে এবং একজন মিসকিনকে খানা খাওয়াতে হবে। যদি কেউ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নেক কাজ করে, তা হবে তার জন্য কল্যাণকর। আর রোজা পালন করা তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জানতে।” (সূরা বাকারা : ১৮৪)
“রমজান মাস, এ মাসেই নাযিল করা হয়েছে আল কুরআন যা মানুষের জন্য হিদায়েত ও উজ্জ্বল বিবরণদায়ক স্পষ্ট নিদর্শন এবং হক ও বাতিলের মীমাংসাকারী, অতএব, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাস পাবে, তাকে অবশ্যই রোজা রাখতে হবে। তবে রোগাক্রান্ত হলে অথবা সফরে থাকলে এ সংখ্যা অন্য সময় পূরণ করবে। আল্লাহ চান তোমাদের জন্য যা সহজ, আর তিনি চান না তোমাদের জন্য যা কষ্টকর, যেন তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং আল্লাহর মহিমা ঘোষণা কর। তোমাদের সৎপথে পরিচালিত করার জন্য এবং যেন তোমরা শুকর করতে পার।” (সূরা বাকারা : ১৮৫)
“আর যখন আমার বান্দা আমার সম্বন্ধে আপনাকে জিজ্ঞাসা করে তবে আমি তো কাছেই আছি। আমি মঞ্জুর করি আবেদনকারীর আবেদন যখন আমার কাছে আবেদন করে। তাদের উচিত আমার বিধান মেনে চলা আর আমার প্রতি ঈমান আনা। আশা যে, তারা সুপথ লাভ করতে পারবে।” (সূরা বাকারা ঃ ১৮৬)
“তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে রোজার রাত্রীতে স্বীয় স্ত্রীদের সঙ্গে প্রবৃত্ত হওয়া। তারা তোমাদের পোশাক আর তোমরা তাদের পোশাক। আল্লাহ জানেন, তোমরা তো অবিচার করেছিলে নিজেদের প্রতি। তারপর তিনি তোমাদের প্রতি ক্ষমাশীল হলেন এবং তোমাদের মাফ করে দিলেন। অতএব এখন থেকে তোমরা তাদের সঙ্গে মিলিত হতে পার এবং কামনা কর তা, যা আল্লাহ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন তোমাদের জন্য আর তোমরা খাও ও পান কর, যতক্ষণ না স্পষ্ট হয়ে যায় তোমাদের কাছে ভোরের সাদা রেখা রাতের কালো রেখা থেকে। তারপর তোমরা পূর্ণ কর সিয়াম রাত পর্যন্ত। আর তোমরা মিলিত হবে না তোমাদের স্ত্রীদের সাথে মাসজিদে ইতিকাফরত অবস্থায়। এসব আল্লাহর সীমারেখা। অতএব তোমরা এর কাছেও যাবে না। এভাবেই আল্লাহ স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেন তার আয়াতসমূহ মানুষের জন্য, যাতে তারা মুত্তাকী হতে পারে।” (সূরা বাকারা : ১৮৭)
এখন আমরা দেখবো রোজা সম্পর্কে হাদিস কি বলে। রোজা সম্পর্কে অসংখ্য হাদিস বিভিন্ন কিতাবে পাওয়া যায়। তার কয়েকটি হাদিস সমূদয় পাঠকদের খেদমতে তুলে ধরা হলো -
“হযরত আবু হুরায়রা রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম ইরশাদ করেছেন। যখন রমজান মাস আসে তখন আকাশের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়, অপর এক বর্ণনায় আছে, জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয়, শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। অন্য বর্ণনায় আছে, রহমাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয়।” (বুখারী ও মুসলিম)
“হযরত সাহ্ল ইবনে সাদ রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বলেছেন, জান্নাতের আটটি দরজা রয়েছে। তন্মেধ্যে একটি দরজার নাম রাইয়ান। শুধু রোজাদারগণ ব্যতীত ঐ দরজা নিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে না।” (বুখারী ও মুসলিম)
“হযরত আবু হুরায়রা রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছাওয়াবের আশায় রমজান মাসের রোজা রাখে তার পূর্বের সমূদয় গুনাহ (সগীরা) মাফ করে দেয়া হবে, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছাওয়াবের আশায় রমজান মাসে রাতে ইবাদাতে কাটাবে তার পূর্বের গুনাহসমূহ মাফ করা হবে এবং যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছাওয়াবের আশায় কদরের রাত ইবাদাতে কাটাবে তার পূর্বকৃত সমূদয় গুনাহ মাফ করা হবে।” (বুখারী ও মুসলিম)
“হযরত আবু হুরায়রা রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আদম সন্তানের প্রতিটি নেক আমল দশ গুণ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়ে থাকে। মহান আল্লাহ তা’আলা জাল্লা শানহু বলেন, কিন্তু রোজা এর ব্যতিক্রম। কেননা, রোজা একমাত্র আমারই জন্য রাখা হয়, আর আমিই এর প্রতিদান দিব। বান্দা আমারই জন্য নিজের কামনা ও পানাহার পরিহার করে থাকে। রোজাদারের জন্য দু’টি আনন্দ রয়েছে, একটি হলো ইফতারের সময় এবং অপরটি হলো (পরকালে) তার প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাৎ লাভের সময়। নিশ্চয়ই রোজাদারের মুখের গন্ধ-মহান আল্লাহ তা’আলা জাল্লা শানহুর নিকট মিশকের সুগন্ধি থেকেও অধিক সুগন্ধময়। রোজা হলো ঢাল স্বরূপ। সুতরাং যখন তোমাদের কারো রোজার দিন আসে, সে অশ্লীল কথাবার্তা বলবে না এবং গ-গোল করবে না। তাকে যদি কেউ কূট কথা বলে অথবা লড়াই করতে চায় তবে সে যেন বলে আমি একজন রোজাদার।” (বুখারী ও মুসলিম)
“হযরত আবু হুরায়রা রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বলেছেন, যখন রমজান মাসের প্রথম রাত হয় শয়তান ও অবাধ্য জিনসমূহকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়, জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয়। অতঃপর এর একটি দরজাও খোলা হয় না। এবং জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় অতঃপর এর একটি দরজাও বন্ধ করা হয় না। এক আহ্বানকারী আহ্বান করতে থাকেন, হে পুণ্যের অন্বেষণকারী! সম্মুখে ‘অগ্রসর হর’ আর হে মন্দের অন্বেষণকারী! ‘থেমে যাও’। এ মাসে আল্লাহ তা’আলা অনেককে দোযখের অগ্নি থেকে মুক্তি দেন আর এটা প্রত্যেক রাতেই সংঘটিত হয়ে থাকে।’ (তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ)
‘হযরত আবু হুরায়রা রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম বলেছেন, তোমাদের নিকট রমজানের বরকতময় মাস এসেছে। এ রোজা মহান আল্লাহ তা’আলা জাল্লা শানহু তোমাদের উপর ফরজ করেছেন। এ মাসে আকাশের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করা হয়। অবাধ্য জিনসমূহকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। মহান আল্লাহ তা’আলা জাল্লা শানহুর রহমাতের জন্য এতে এমন একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাস (৮৩ বছর ৪ মাস) অপেক্ষাও শ্রেয়। যে এর কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে সে প্রকৃতপক্ষেই বঞ্চিত হয়েছে।” (আহমাদ ও নাসায়ী)
“হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, রোজা ও কুরআন (কিয়ামতের দিন) বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। রোজা বলবে, হে প্রতিপালক! আমি তাকে খাদ্য ও কাম প্রবৃত্তি থেকে দিনের বেলা বাধা প্রদান করেছি। সুতরাং তার ব্যাপারে তুমি আমার সুপাশি কবুল কর। কুরআন বলবে, হে পরওয়ারদিগার! আমি তাকে রাতের বেলায় ঘুম থেকে বাধা প্রদান করেছি। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপাশি কবুল কর। তখন উভয়ের সুপারিশ কবুল করা হবে।” (বায়হাকী ও শুআবুল ঈমান)।
“হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখনই রমজান মাস আসত, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম সকল বন্দীদেরকে মুক্ত করে দিতেন এবং সকল সওয়ালকারীকেই দান করতেন।”
“হযরত আবু হুরায়রা রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা এবং তা অনুসারে কার্যকলাপ করা পরিত্যাগ করেনি, তার পানাহার পরিত্যাগ করাতে মহান আল্লাহ তা’আলা জাল্লা শানহুর কোন প্রয়োজন নেই।” (বুখারী)।
“হযরত আবু উমামা রাদি-আল্লাহু তা’আলা আনহু বর্ণনা করেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে কোন আমলের আদেশ করুন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লামা বললেন, তুমি রোজা রাখ। কেননা, এর সমতুল্য কিছু নেই। আমি পুনরায় বললাম, আমাকে কোনো নেক আমলের কথা বলুন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি রোজা রাখ। কেননা, এর সমতুল্য কিছুই নেই।” (মুসনাদে আহম্মদ : হাদিস নং ২৩০৭০; ইবনে হিব্বান : হাদিস নং ৬৫২৩)।
এখন আমরা রোজা সম্পর্কে আধুনিক চিকিৎসক ও বিজ্ঞান যা বলেছেন তা নিয়ে আলোচনা করবো।
অভিজ্ঞ চিকিৎসকগণ বলেন, সর্বক্ষণ আহার সীমাতিরিক্ত ভোজন ও দূষিত খাদ্য খাওয়ায় শরীরে এক প্রকার বিষাক্ত উপকরণ ও উপাদানের সৃষ্টি হয় এবং জৈব বিষ (ঞড়ীরহ) জমা হয়। যার কারণে দেহের নির্বাহী ও কর্মসম্পাদন অঙ্গ প্রতঙ্গগুলো বিষাক্ত উপকরণ ও জৈব বিষ দমনে অক্ষম হয়। ফলে তখন জটিল ও কঠিন রোগের জন্ম হয়। দেহের মধ্যকার এমন বিষাক্ত ও দূষিত উপাদানগুলো অতিদ্রুত নির্মূলকরণের নিমিত্তে পাকস্থলিকে মাঝে মধ্যে খালি করা একান্ত প্রয়োজন। রোজাই এর একমাত্র সহায়ক। যার বিকল্প করা যায় না।
১৯৬০ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডা. গোলাম মোয়াজ্জেম কর্তৃক মানব শরীরের উপর রোজার প্রভাব শীর্ষক গবেষণামূলক নিবন্ধ অনুযায়ী জানা যায়, রোজা দ্বারা শরীরের ওজন সামান্য হ্রাস পায় বটে, তবে তা শরীরের কোন ক্ষতি করে না বরং শরীরের মেদ কমাতে রোজা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের খাদ্য নিয়ন্ত্রণ অপেক্ষা অধিক কার্যকর। তার পরীক্ষা-নিরীক্ষার আলোকে আরও জানা যায়, যারা মনের করেন রোজা রাখলে শূল বেদনার প্রলোপ বৃদ্ধি পায়, তাদের এ ধারণা সঠিক নয় বরং ভোজনের তা বৃদ্ধি পায়।
পাকিস্তানের প্রবীণ প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. মোহাম্মদ হোসেনের নিবন্ধ থেকে জানা যায়, যারা নিয়মিত সিয়াম পালন করে সাধারণত তারা বাতরোগে, বহুমূত্র, অজীর্ণ, হৃদরোগ ও রক্তচাপজনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত কম হয়। এছাড়া ডা. ক্লাইভসহ অন্যান্য চিকিৎসা বিজ্ঞানী পর্যন্ত স্বীকার করেছেন, ইসলামের সিয়াম সাধনার বিধান স্বাস্থ্যসম্মত ও ফলপ্রসূ, আর তাই মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার রোগব্যাধি তুলনামূলকভাবে অন্য এলাকার চেয়ে কম দেখা যায়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম কম খাওয়ার জন্য বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। ক্ষুধা লাগলে খেতে বলেছেন এবং ক্ষুধা না লাগলে খাওয়া বন্ধ করার জন্য উপদেশ দিয়েছেন যা চিকিৎসা বিজ্ঞানসম্মত। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে দীর্ঘজীবন লাভ করার জন্য খুব বেশি খাওয়ার প্রয়োজন নেই। এখন আধুনিক বিজ্ঞান ও কিছু অভিজ্ঞ চিকিৎসকের মতামত উল্লেখ করা হলো।
জার্মানির ডাক্তার ফেডারিক হভম্যান (জন্ম ১৬৬০ মৃত্যু ১৭২৪) বলেছেন, “রোজার মাধ্যমে মৃগীরোগ, গ্যাস্টিক ও আলসারের চিকিৎসা করা যায়।”
ইটালির বিশ্ববিখ্যাত শিল্পী মাইকেল এংলো ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। ৯০ বছর বয়স পার হওয়া সত্ত্বেও তিনি কর্মক্ষম ও কর্মঠ ছিলেন। তাকে এর রহস্য সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, আমি বহু দিন আগ থেকেই মাঝে মাঝে রোজা রেখে আসছি। আমি প্রত্যেক বছর এক মাস, প্রত্যেক মাসে এক সপ্তাহ রোজ রাখি এবং দিনে তিন বেলার পরিবর্তে দুই বেলা খাবার খাই।
ক্যাব্রিজের ডাক্তার লেখার জিম। তিনি ছিলেন, ফার্মাকোলজি বিশেষজ্ঞ। সব কিছু গভীরভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে তার স্বভাব। তিনি রোজাদার ব্যক্তির খালি পেটের খাদ্য নালীর লালা স্টোমক সিক্রেশন সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরী পরীক্ষা করেন। এতে তিনি বুঝতে পারলেন, রোজার মাধ্যমে ফুডপাটি কোলস সেপটিক সম্পূর্ণ আরো দেহের সুস্থতার বাহন। বিশেষত্ব পাকস্থলীর রোগের আরোগ্য গ্যারান্টি।
মহাত্ম গান্ধীর ইচ্ছা। মহাত্ম গান্ধীর উপোস থাকার ঘটনা সর্বজনবিদিত। ফিরোজ রাজ লিখিত দাস্তানে গান্ধীতে লেখা রয়েছে। তিনি রোজা রাখা পছন্দ করতেন। তিনি বলতেন মানুষ খাবার খেয়ে নিজের দেহকে ভারী করে ফেলে। এরকম ভারী অলস দেহ দুনিয়ার কোনো কাজে আসে না। তাই তোমরা যদি তোমাদের দেহ কর্মঠ এবং সবল রাখতে চাও তবে দেহকে কম খাবার দাও। তোমরা উপস থাকো। সারা দিন জপ তপ করো আর সন্ধ্যায় বকরির দুধ দিয়ে উপবাস ভঙ্গ করো। (দাস্তানে গান্ধী)।
সিগমন্ডনারায়েড মনস্তত্ত্ব বিজ্ঞানীর মন্তব্য। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট মনস্তত্ত্ব বিশারদ। তার আবিষ্কৃত থিওরী মনস্তত্ত্ব ক্ষেত্র পথনির্দেশকের ভূমিকা পালন করে। তিনিও রোজা এবং উপবাসের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। তিনি বলেন, রোজার মাধ্যমে মস্তিষ্কের এবং মনের যাবতীয় রোগ ভালো হয়। মানুষ শারীরিকভাবে বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। কিন্তু রোজাদার ব্যক্তির দেহ ক্রমাগত বায়ুচাপ সহ্য করার যোগ্যতা অর্জন করে। রোজাদার ব্যক্তি খিঁচুনি এবং মানসিক রোগ থেকে মুক্তি লাভ করে। এমনকি কঠিন রোগ থেকে মুক্তি লাভ করে এবং এর রোগের সম্মুখীন হওয়া থেকে বিরত থাকে।
আলেকজান্ডার গ্রেট এবং এরিস্টল। উল্লিখিত দু’জনই ছিলেন অধিবাসী। নিজ নিজ ক্ষেত্রে তারা বিশ্বখ্যাত। তারা মাঝে মাঝে ক্ষুধার্ত বা উপবাস থাকাকে দেহের সুস্থতা ও সবলতার জন্য খুবই উপকার বলে মনে করেন।
আলেকজান্ডার গ্রেট বলেন, আমার জীবনে অনেক ব্যতিক্রম ধর্মীয় অভিজ্ঞতা এবং ঘটনা দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি, সকাল-সন্ধ্যা যে আহার করে সে রোগমুক্ত। আমি ভারতে এরকম প্রচ- উষ্ণ এলাকা দেখেছি। সেখানে সবুজ গাছপালা পুরে গেছে। কিন্তু সেই তীব্র গরমের মধ্যেও আমি সকালে এবং বিকালে খেয়েছি। সারাদিন কোনো প্রকার পানাহার করিনি। এর ফলে আমি অনুভব করেছি এক নতুন অফুরন্ত প্রাণশক্তি (আলেকজান্ডার গ্রেট, মাহফুজুর রহমান আখর তারী)।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখপাত্র প্রফেসর’স মোরপান্ড বলেছেন, আমি ইসলাম সম্পর্কে মোটামুটি জানার চেষ্টা করেছি। রোজা অধ্যায় অধ্যয়নের সময় আমি খুবই মুগ্ধ ও অভিভূত হয়েছি। চিন্তা করেছি ইসলাম তার অনুসারীদের জন্য এক মহাফর্মুলা দিয়েছে। ইসলাম যদি তার অনুসারীদেও কোনো বিধান না দিয়ে শুধু রোজা দিত তবুও এর চেয়ে বড় নেয়ামত আর কিছু হত না।
বিষয়টি নিয়ে আমি একটু গভীর চিন্তায় মনোনিবেশ করলাম। তাই বাস্তব অভিজ্ঞতার জন্য আমি মুসলমানদের সাথে রোজা রাখতে শুরু করলাম। দেখলাম রোগ অনেকটাই কমে গেছে। আমি রোজা চালিয়ে গেলাম এতে দেহ আরো উন্নতি পরিবর্তন উপভোগ করলাম। কিছুদিন পর লক্ষ করলাম আমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়েছি। এক মাস পর আমি নিজের মাঝে এক অসাধারণ পরিবর্তন অনুভব করলাম। (রসালানঈ দুনিয়া)।
পাকিস্তানের বিদেশী বিশেষজ্ঞদের সার্ভে রিপোর্ট। রমজান মাসে নাক, কান, গলার অসুখ কম হয়। জার্মানি, ইংল্যান্ড এবং আমেরিকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের একটি টিম এ সম্পর্কে গবেষণা করার জন্য এক রমাজন মাসে পাকিস্তান আসে। তারা গবেষণাকর্মের জন্য পাকিস্তানের করাচী, লাহোর ও ফয়সালাবাদ শহরকে মনোনীত করেছেন। সার্ভে করার পর তারা যে রিপোর্ট দিলেন তার মূল কথা ছিলো নি¤œরূপ। মুসলমানরা নামাজের জন্য যে অজু করে সেই অজুর কারণে নাক, কান, গলার অসুখ কম হয়। খাদ্য কম খাওয়ার কারণে পাকস্থলী এবং লিভারের অসুখ কম হয়। রোজার কারণে তারা মস্তিষ্ক এবং হৃদরোগের আক্রান্ত কম হয়।
পরিবেশে মহান আল্লাহ তা’আলা জাল্লা শানহু আমাদেরকে সঠিক আকিদা ও আমলের মাধ্যমে জীবন গঠনের তাওফিক এনায়েত করুন। আমিন, ছুম্মা আমিন।
লেখক: ইসলামিক প্রাবন্ধিক, মেহেন্দিগঞ্জ, বরিশাল।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।