সিয়াম ও অর্থনৈতিক সংযম
এ. জেড. এম. শামসুল আলমউপবাস থাকা সিয়াম সাধনার প্রধান অঙ্গ হওয়ার তাৎপর্য কি?আদম সন্তানের প্রথম
অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমান
রোজা সামাজিক সাম্য, অর্থনৈতিক সমতা, ন্যায়ভিত্তিক মানবিক চেতনা, মানুষে মানুষে পারস্পরিক সহানুভূতি-সমমর্মিতা ও উদার ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টির মহত্তম প্রেরণা যোগায়। ইসলামের প্রতিটি বিধানই মানুষের কল্যাণ, সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা-সৌহার্দ্য সৃষ্টির পথ উন্মুক্ত করে। ইসলাম অর্থ শান্তি। যদি এটাকে ধর্ম বলি, তাহলে এটা শুধু মুসলমানের ধর্ম নয়, সমগ্র মানবজাতির ধর্ম। সমগ্র মানবজাতি ও বিশ্বভূম-লের মহান স্রষ্টা এর প্রণেতা। স্রষ্টার মনোনীত নবী-রাসূলদের মাধ্যমে যুগে যুগে পৃথিবীতে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে। নবী-রাসূলগণও শুধু মুসলমানদের জন্য নয়, সমগ্র মানবজাতির হিদায়াতের জন্য প্রেরিত হয়েছেন। তবে এ পর্যন্ত যারা নবী-রাসূলদের প্রচারিত দ্বীন মেনে নিয়েছেন ও অনুসরণ করেছেন, কেবলমাত্র তাদেরকেই ‘মুসলিম’ বলা হয়। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, ইসলাম শুধু মুসলমানদের ধর্ম। যে কোনো অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করতে পারেন, এমনকি নিষ্ঠা, আনুগত্য ও যোগ্যতার বলে মুসলমানদের ঈমাম বা নেতাও হয়ে যেতে পারেন। সৃষ্টির বিধান সব মানুষের জন্য সমান ও সর্বদা উন্মুক্ত। তবে জোর-জবরদস্তি করে কাউকে ইসলামে দাখিল করা ইসলাম সমর্থন করে না। ইসলামের প্রাণশক্তি এত প্রবল যে, তা যে কোনো জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান, যুক্তিনিষ্ঠ, কল্যাণকামী, বিবেকবান মানুষকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য যথেষ্ট।
শুরুতে রোজা সম্পর্কে বলেছি, এখন সে সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনার প্রয়াস পাব। আরবি ‘রমজ’ শব্দ থেকে রোজা শব্দের উৎপত্তি। ‘রমজ’ অর্থ পোড়ানো বা জ্বালানো। আগুনে পুড়িয়ে কোনো ধাতুকে যেমন নিখাদ করা হয়, রোজাও তেমনি। রোজা মানুষের অসৎ প্রবৃত্তিকে নাশ করে সুপ্রবৃত্তির বিকাশ ঘটায়। প্রত্যেক মানুষের স্বভাবে দু’টি বিপরীতমুখী প্রবণতা রয়েছে, একটি সৎ, অন্যটি অসৎ। রোজা অসৎ প্রবৃত্তি পুড়িয়ে মানুষের মধ্যে সৎ প্রবৃত্তি সৃষ্টি করে, মানুষকে সত্যিকার নিখাদ মানুষে পরিণত করে। রোজা মানুষের মধ্যে অসৎ প্রবৃত্তি নাশ করে তার মধ্যে সৎ প্রবৃত্তির উন্মেষ ঘটায়। এভাবে সৎ গুণাবলিতে ভূষিত হওয়ার অর্থ ‘তাকওয়া’ (‘তাকওয়া’ অর্থ আল্ল¬াহ্ভীতি অর্থাৎ আল্ল¬াহকে সদা-সর্বদা স্মরণ করে তাঁর আদেশ-নিষেধানুযায়ী জীবন-যাপন করার অর্থ তাক্ওয়া) অর্জন। তাক্ওয়ার গুণ অর্জনই রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য। আল-কুরআনের সূরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে রোজার উদ্দেশ্য সম্পর্কে মহান স্রষ্টা বলেনÑ “হে ঈমানদারগণ, তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের প্রতি ফরজ করা হয়েছিল, সম্ভবত তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে।”
উপরোক্ত আয়াত থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, রোজা শুধুমাত্র আখিরী নবীর উম্মতদের জন্যই নয়, পূর্ববর্তী উম্মতদের জন্য অবশ্য পালনীয় ছিল। ইহুদি, খ্রিস্টান, হিন্দু ও অন্যান্য অনেক ধর্মেই রোজা বা উপবাস ব্রত পালনের নিয়ম রয়েছে। তবে পালনের বিধি সব ধর্মে এক রকম নয়। এ ভিন্নতা সত্ত্বেও অনেক ধর্মেই রোজার প্রচলন থাকায় এটা সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, রোজা এক সর্বজনীন ইবাদত। রোজা পালনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছেÑ রোজার দ্বারা সম্ভবত তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারবে। এখানে তাকওয়া অর্জনকে রোজার মূল উদ্দেশ্য বলে উল্লেখ্য করা হয়েছে। ‘সম্ভবত’ শব্দ এসেছে কতগুলো শর্তের কারণে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শুধু পানাহার ও স্ত্রী সহবাস বর্জন করার নাম রোজা নয়। এর সঙ্গে আরো কিছু শর্ত পূরণ অপরিহার্য। তা হলোÑ রোজা একমাত্র আল্লাহ্র হুকুমে এবং তাঁর সন্তুষ্টির জন্যÑ লোক দেখানো বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নয়। রোজা রেখে মিথ্যা বর্জন করা, ফাহেসা কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা, ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত না হওয়া, কেউ কষ্ট পাবে এমন কোনো আচরণ ও কাজ না করা তথা সকল কু-প্রবৃত্তি, অন্যায় আচরণ, অশ্ল¬ীল ও গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকা রোজাদারের জন্য অবশ্য কর্তব্য। এ শর্তগুলো যথাযথরূপে পালন করে রোজা রাখলে রোজার হক আদায় হয়। বলাবাহুল্য, এ শর্তগুলো পূরণ করলে যে কোনো মানুষ ভালো মানুষ বা সৎ গুণের অধিকারী হতে পারে। রোজার উদ্দেশ্য মানুষকে প্রকৃত মানুষ (ইনসানে কামিল) করে তোলা, মানবিক মহৎ গুণাবলি অর্জনের মাধ্যমেই প্রকৃত মানুষ বা ইনসানে কামিল হওয়া সম্ভব। মানুষকে সে ধরনের উন্নত চরিত্র বিশিষ্ট মানবিক সত্তায় পরিণত করাই রোজার উদ্দেশ্য।
ব্যক্তির দ্বারা সমাজ গঠিত হয়। ব্যক্তি সমাজের ক্ষুদ্রতম ইউনিট। অসংখ্য ব্যক্তির সমন্বয়ে সমাজ গঠিত। মানুষের কারণেই সমাজ ভালো বা মন্দ হয়। যেহেতু মানুষের দ্বারা সমাজ গঠিত, সেহেতু মানুষ যদি ভালো ও সৎগুণাবলি বিশিষ্ট হয়, তাহলে সে সমাজ ভালো ও উন্নত হয়। অনুরূপভাবে মানুষ মন্দ বা অসৎ গুণাবলি সম্পন্ন হলে সে সমাজ খারাপ বা নিকৃষ্ট সমাজে পরিণত হয়। ভালো সমাজ প্রত্যেকের নিকটই একান্ত প্রত্যাশিত। ভালো সমাজে কোনো দুষ্কর্ম ঘটে না, অন্যায়-অনাচার-অবিচার সংঘটিত হয় না শান্তি-শৃঙ্খলার ব্যাঘাত ঘটে না। কিন্তু মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয় না, কারণ প্রত্যেক সমাজে ভালো মানুষের সংখ্যা আশানুরূপ নয়। সে কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সমাজে নানারূপ অশান্তি-বিশৃঙ্খলা-অরাজকতা, অন্যায়-অবিচার, নাশকতা-মাদকতা ইত্যাদি সমাজ জীবনকে প্রতিনিয়ত দুর্বহ করে তোলে। এক্ষেত্রে সামাজিক পরিবেশ সুস্থ-স্বাভাবিক ও সর্বপ্রকার কলুষতামুক্ত করার জন্য রোজা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সমাজের মানুষ যদি নিষ্ঠার সাথে রোজাব্রত পালন করে কুপ্রবৃত্তি থেকে মুক্ত হয়ে সুপ্রবৃত্তিসম্পন্ন হয়ে ওঠে তাহলে সে সমাজে অন্যায়-অশান্তি-দু®কৃতি-অনাচার-ব্যভিচার-অবিচার, হত্যা-লুণ্ঠন ও অপরাধমূলক কাজ সংঘটিত হতে পারে না। তাই সমাজ সংস্কার বা সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় রোজার বিধান অতি গুরুত্বপূর্ণ। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, রমজান মাসে যে কোনো মুসলিম সমাজে অসামাজিক ও অপরাধমূলক কাজ তুলনামূলকভাবে কম হয়। প্রকৃতপক্ষে, সমাজের মানুষ যদি যথাযথভাবে রোজা পালন করে, তাহলে সে সমাজে অন্যায় ও অপরাধমূলক কোনো কাজই সংঘটিত হওয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া, রমজানের পরে রোজার প্রভাব তেমন চোখে পড়ে না। কারণ আমরা রমজানের পরে সৎ থাকার প্রয়োজনীয়তা বোধ করি না। অথচ রোজা কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে যে মানবীয় সৎ গুণাবলি সৃষ্টি করে, সারা জীবন পরম নিষ্ঠার সাথে তা ধারণ করা বাঞ্ছনীয়। এর মূল কারণ যথার্থ নিষ্ঠার সাথে রমজানের তাৎপর্য উপলব্ধি করে আমরা রোজা রাখি না।
রমজান মাসে অকস্মাৎ সামাজিক দৃশ্যপট সম্পূর্ণ বদলে যায়। রোজার প্রভাবে সামাজিক পরিবেশে এরূপ দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটে। বছরে অন্যান্য মাসে আমরা সাধারণত সারা রাত বিশ্রাম করি। সূর্যোদয়ের পর আমাদের জীবনে কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়। কিন্তু রমজানে এর বিপরীত অবস্থা চোখে পড়ে। সূর্যাস্তের পূর্ব থেকে কর্মব্যস্ত মানুষ সকল কর্মব্যস্ততা ভুলে ইফতারি বানানো, ইফতারি সাজানো, ইফতারির জন্য দাওয়াত দেয়া ও ইফতারি বিতরণের কাজে ব্যস্ত হয়। মাগরিবের আযজানের সাথে সাথে সকলে একসঙ্গে এক দস্তরখানার পাশে বসে ইফতারিতে শরিক হয়। পরিবার, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে নিয়ে ইফতার করার রেওয়াজ আছে। গরিব ও অভাবী লোকেরাও ইফতারি থেকে মাহ্রুম হননা। ধনী ও বিত্তবানেরা সব সময় গরিব ও অভাবী লোকদের মধ্যে ইফতারি বিতরণ করে থাকেন। অনেকে পরিবারে, পাড়া-মহল্ল¬ায়, কমিউনিটি সেন্টার বা বড় কোনো হল-হোটেল-রেস্তোরাঁয় সাড়ম্বরে ইফতার পার্টির আয়োজন করে। এভাবে রোজা এক সামাজিক সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি করে। সকলে এক সাথে ইফতারিতে শরিক হওয়ার ফলে সর্বত্র এক আনন্দঘন উৎসব-মুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এ সময় হাট-বাজার, মসজিদ ও প্রতিটি গৃহে ইফতারের ঘ্রাণ ও আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। সমবেতভাবে ইফতার করার ফলে পারস্পরিক সম্প্রীতি-সৌহার্দ্য বৃদ্ধি পায়, মুসলিম সমাজের ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় হয়। এ সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে রাসূলুল¬াহ্ স. রোজাদারদেরকে ইফতার করানোর ব্যাপারে সকলকে উৎসাহিত করেছেন। এক হাদিসে আছে, রোজাদার যখন কাউকে ইফতারি করায়, তখন সে দু’টি রোজার সওয়াব পায়। একটি তার নিজের, অন্যটি যাকে ইফতার করানো হলো তার এবং এর দ্বারা যাকে ইফতার করানো হলো, তার রোজার সওয়াব এতটুকু কমে না। এ কারণে রমজানে প্রত্যেক মুসলিম অন্য রোজাদারকে ইফতারি খাওয়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এটা সমাজে পারস্পরিক সহমর্মিতা, সাম্য ও ভাতৃত্ববোধ সৃষ্টিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
রোজা ব্যক্তি মনুষের চিন্তা-বিশ্বাস, আমল-আখলাক, আচার-আচরণ, ব্যবহারিক ও আধ্যাত্মিক জীবনধারায় এক বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন নিয়ে আসে, মানুষের মধ্যকার সকল হীনতা, নীচতা, কপটতা, অসাধুতা ও অমানবিক স্বভাব বৈশিষ্ট্য দূর করে তার মধ্যে এক মহৎ, উন্নত, সৎ, উদার মানবিক গুণ সৃষ্টি করে। রোজা মানুষকে তার পাশবিক প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণ করে তার মানবিক বোধ ও সত্তাকে জাগ্রত করে। মানুষের মানবিক সত্তার বিকাশে রোজা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই অন্যান্য ধর্মে ঋধংঃরহম বা উপবাসব্রতের সাথে রোজার পার্থক্য মৌলিক, তাৎপর্যগত অর্থে রোজার গুরুত্বও তেমনি অনন্যসাধারণ। রোজা ব্যক্তি জীবনে যে প্রভাব বিস্তার করে, সামাজিক-অর্থনৈতিক ও সামগ্রিক জীবন-ব্যবস্থায়ও তেমনি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে আসে। রোজা ব্যক্তি জীবনে যেরূপ বিপ্ল¬বাত্মক পরিবর্তন আনে সামাজিক জীবনধারায়ও তেমনি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে আসে। রমজান মাসে সাধারণত দিনের বেলায় হোটেল-রেস্তোরাঁ বন্ধ থাকে। রাস্তা-ঘাটে, হাটে-বাজারে-জনপদে সর্বত্র রমজানের এক পবিত্র ভাব-গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়। অফিস-আদালত-শিক্ষায়তন ইত্যাদি সকল জনপদ ও কর্মস্থলে কর্মব্যস্ত মানুষ নিজ নিজ কাজে নিয়োজিত অবস্থায় সচেতনভাবে রোজার কথা স্মরণ রেখে নিষ্ঠা ও সততার সাথে দায়িত্ব পালন করে। রোজাদারের মনে সব সময় এক পবিত্র অনুভূতি জাগ্রত হয়, যা তাকে সঠিকভাবে দায়িত্বপালনে উদ্বুদ্ধ করে। এভাবে রমজানে মানুষের সামগ্রিক জীবনধারায় ও সমাজ-পরিবেশে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটায়। চুরি-ডাকাতি-ব্যভিচার ইত্যাদি অপরাধমূলক কাজ রমজানে হয় না বললেই চলে। রোজা যে পবিত্রতা ও সংযমের শিক্ষা দেয়, সে কারণে সামগ্রিকভাবে সমাজ-জীবনে এক ধরনের ভাব-গাম্ভীর্যপূর্ণ সুন্দর অনাবিল পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
ইফতারের পর সালাতুল মাগরিব। নামাজের পর অল্প কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার এশার আজানের সাথে সাথে মুসুল্লিরা পাড়া-মহল্ল¬ার মসজিদে সমবেত হয়। এশার নামাজ শেষে তারাবীহ্র নামাজ শুরু হয়। এ সময় এক স্বর্গীয় দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। নামাজে দীর্ঘ সময় পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত এবং আল্ল¬াহর অনুগত বান্দারা যখন বিনয় নম্্র ও আত্মনিবেদিত অবস্থায় সিজদারত থাকে, তখন এক অপার্থিব দৃশ্যের অবতারণা হয়। মুসুল্লিগণ নামাজ ও দো’আ দরূদ শেষে ঘরে ফেরেন। তারাবির নামাজের পর অল্প কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আল্ল¬াহর অনুগত বান্দারা অন্ধকার রাত্রির নির্জনতায় কিয়ামুল লাইল বা তাহাজ্জত নামাজের জন্য জায়নামাজে দাঁড়ায়। নামাজের মাধ্যমে নিভৃতে মহান স্রষ্টার কাছে নিজেকে নিঃশেষে সমর্পণ করে দেয়। অশ্রু সজল নেত্রে নিজের কৃত সকল অপরাধ মার্জনার জন্য প্রাণ খুলে দোয়া করে। এভাবে আল্ল¬াহর নেক বান্দারা আল্ল¬াহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করে। এতে স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির যে গভীর নিবিড় আধ্যাত্ম সম্পর্ক সৃষ্টি হয়, তা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। মু’মিনের এ আত্মগত উপলব্ধিই তাকে আশরাফুল মাখলুকাতের সুউচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে। এরপর সাহ্রী খাওয়ার পালা। পরিবারের সকলে খাবার টেবিলে সমবেত হয়ে পরম তৃিপ্তর সাথে সাহ্রী খায়। সাহ্রী খাওয়া শেষ হতেই মুয়াজ্জিনের সুললিত কণ্ঠে ফজরের আজান শুনে সকলে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে জমায়েত হয়। নামাজ শেষে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম গ্রহণ এবং নিদ্রাভঙ্গের পর দিনের কার্যক্রম শুরু হয়। রমজানে প্রত্যেকটি ভালো কাজের জন্য সত্তর থেকে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত অধিক সওয়াব। তাই এ মাসে রোজাদারগণ রমজানের রাতগুলো যথাসম্ভব বেশি বেশি ইবাদতের মধ্যে মশগুল থাকেন।
রমজান আমাদেও দৈনন্দিন জীবনের রুটিন যেমন বদলে দেয়, তেমনি সামাজিক পরিবেশ পাল্টে দিয়ে এক অনবদ্য পবিত্র ভাবধারায় জীবনকে নতুনভাবে উজ্জীবিত ও সমাজ-পরিবেশকে সুন্দর করে তোলে। আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাস ও তাঁর প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য প্রদর্শনের দ্বারা রোজাদাররা পুরো রমজান মাস কঠোর সংযম ও সাধনায় অতিবাহিত করার ফলে এ মাসে আমাদের দৈনন্দিন জীবনধারা ও সামগ্রিক সমাজ পরিবেশে আমূল পরিবর্তন ঘটে। রোজা আমাদের জীবন ও সমাজকে পবিত্রতার চাদরে আচ্ছাদিত করে দেয়। রোজা মানুষের জীবন ও পরিবেশ বদলে দেবার এক অসাধারণ শক্তি রাখে বলেই রোজার প্রভাব আমাদের জীবন ও সমাজে সুস্পষ্ট ও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তনেও রমজানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। রমজানে সদাকাতুল ফির্ত আদায় করা হয়। রমজানে যাকাত আদায়ের প্রচলন রয়েছে। সাধারণত এ মাসে দান-সদ্কাও অধিক হারে বিতরণ করা হয়। যাকাত-ফিতরা-সদ্কা ইত্যাদি কোনো দান বা করুণা নয়, এসবই ধনীর বিত্তে গরিবের ন্যায্য অধিকার। বর্তমানে যাকাত, ফির্ত, সদ্কা এমনভাবে বিতরণ করা হয় যেন এটা গরিবের প্রতি ধনীর অনুকম্পা। দয়ার দান হিসাবে তারা ইচ্ছানুযায়ী এগুলো বিতরণ করে। আবার অনেকে মোটেই করে না বা হিসাব-নিকাশ না করে যৎসামান্য দান হিসাবে বিতরণ করে থাকে। ফলে ভিক্ষুক চিরকাল ভিক্ষুক থেকে যায়, ধনী দিন দিন আরো বিত্তশালী হয়। অথচ যাকাত, ফির্ত, সদ্কা দারিদ্র্য বিমোচনের নিশ্চিত গ্যারান্টি। ইনকাম ট্যাক্স যেভাবে তালিকা করে প্রত্যেক বিত্তশালীর নিকট থেকে আদায় করা হয়, সেভাবে সরকারি বা কোনো আইনানুগ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এগুলো প্রত্যেক বিত্তশালী ব্যক্তির কাছ থেকে যথাযথভাবে আদায় করে দেশের সব গরিব ও অভাবীদের তালিকা করে তাদের মধ্যে বণ্টনের সুব্যবস্থা করলে সুফল অনিবার্য। সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে যথাযথভাবে গরিব ও অভাবীদের মধ্যে এগুলো বিতরণের ব্যবস্থা করলে সারা দেশের দারিদ্র্য একপর্যায়ে অবশ্যই দূর হবে। সরকারের পক্ষ থেকে এটা না করা হলে পাড়ায়-মহল্ল¬ায়-গ্রামে-গঞ্জে অর্থাৎ সকল জনপদে ধর্মীয়-সামাজিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সুসংগঠিতভাবে যাকাত আদায় ও বন্টনের ব্যবস্থা করে স্ব স্ব এলাকার দারিদ্র্য বিমোচনে যথার্থ ভূমিকা রাখলেও ইপ্সিত ফল পাওয়া সম্ভব।
ইসলামে যাকাত ব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য এটাই। প্রকৃতপক্ষে, কোনো মুসলিম সমাজে দারিদ্র্য কোনো চিরস্থায়ী ব্যবস্থা হতে পারে না এবং ভিক্ষুকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে জীবিকা সংগ্রহের প্রয়োজন পড়ে না। ইসলাম ভিক্ষাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করেছে। প্রত্যেক কর্মক্ষম মানুষের জন্য কর্ম-সংস্থানের ব্যবস্থা করা মুসলিম সমাজের দায়িত্ব। কর্মক্ষম নয়, এরূপ শারীরিক প্রতিবন্ধী, অসহায় দুস্থ ব্যক্তিদের জীবনধারণের ব্যবস্থা করে দেয়া ইসলামী সমাজের দায়িত্ব। মুসলিম সমাজ বা রাষ্ট্রের অপরিহার্য দায়িত্ব হলো নাগরিকদের মৌলিক অধিকার পূরণ এবং তাদের সম্মানজনক, নিরাপদ ও স্বাভাবিক জীবন-যাপনের সুব্যবস্থা করা। অর্থনৈতিক সমবণ্টন, দারিদ্র্য-দূরীকরণের নিশ্চিত ব্যবস্থা হিসাবে ইসলামে যাকাত, সদ্কা, উশর ইত্যাদির বিধান রয়েছে। রমজানে এ বিধান পালন করে সমাজের দরিদ্র, অসহায় মানুষের সম্মানজনক, নিরাপদ ও স্বাভাবিক জীবন-যাপনের ব্যবস্থা করা সম্ভব। দুর্ভাগ্যবশত এ বিধানকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে আমরা চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। ফলে দারিদ্র্য মুসলিম সমাজের অনিবার্য বিধিলিপি হয়ে আছে।
রোজার শেষে শওয়াল মাসের প্রথম দিনে ঈদ উদ্যাপিত হয়। ঈদ রোজারই অংশ। রোজা পালনের ফলে মু’মিন ব্যক্তি যে তাকওয়ার গুণ অর্জিত হয়, তার শুকরিয়া হিসাবে ঈদ উদ্যাপিত হয়। যে পূর্ণ একমাস নিষ্ঠার সাথে রোজা পালন করেছে, তার জন্যই ঈদ। রোজার মাসে যে রোজা পালন করেনি, তার জন্য অঈদ বা নিরানন্দ। ঈদের আনন্দে নারী-পুরুষ, শিশু-যুবা-বৃদ্ধ, গরিব-দুঃখী, রাজা-প্রজা, মালিক-শ্রমিক সকল শ্রেণির মানুষ একত্রে শরীক হয়। একসঙ্গে সকলে ঈদের নামাজ আদায় করে। নামাজ শেষে ইমাম সাহেব মুসলিম সমাজের উন্নতি-অবনতি, দায়িত্ব-কর্তব্য ও ধর্মীয় পালনীয় বিষয় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। এরপর বিশেষভাবে সমবেত মুসুল্লি ও সাধারণভাবে মুসলিম উম্মাহ্র জন্য দো’আ করা হয়। দো’আ শেষে সকলে কোলাকুলি, মোসাহেবা ও কুশল বিনিময় করে। তখন এক অসাধারণ সাম্য-সহমর্মিতা ও উদার ভ্রাতৃত্বপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
ঈদের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গরিব-দুঃখী-অভাবীদের মধ্যে সদ্কাতুল-ফিত্র আদায় করা কর্তব্য, যাতে তারাও ঈদের আনন্দে শরিক হতে পারে। ঈদগাহ থেকে ফিরে সকলে হরেক রকম সুস্বাদু খাবার খায়। এ সময়ও আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, গরিব-দুঃখী-মিসকিনদেরকে সাধারণত খাবারে শরীক করা হয়। ঈদের দিনে সকলে নানারূপ আনন্দ-উৎসবে অংশগ্রহণ করে। এখানেও কোন ভেদাভেদ নেই। সামাজিকভাবে ঈদের আনন্দ সকলের জন্য সমান। ঈদের দিনে সকলে সব ভেদাভেদ ভুলে এক অনাবিল আনন্দে মেতে ওঠে। এভাবে যে সামাজিক সাম্য-সমতা-সহমর্মিতা ও উদার ভ্রাতৃত্বপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তা কি শুধু ঈদের দিনের জন্যই? মূলত ইসলামে মানুষে-মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই, মানবিক মর্যাদা ও অধিকারের ক্ষেত্রে সকল মানুষ এক ও অভিন্ন। সব মানুষ এক আদমের সন্তান। তাই মানুষে মানুষে সকল কৃত্রিম ভেদাভেদ দূর করার জন্যই রোজা ও ঈদের শিক্ষার আলোকে বৈষম্যহীন, ভ্রাতৃত্বপূর্ণ, কল্যাণময়, ন্যায়ানুগ মানবিক উদার সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হওয়া মুসলিম মিল¬াতের কর্তব্য। আসন্ন রমযান ও ঈদের উৎসবকে আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত না করে আমরা রোজা ও ঈদের প্রকৃত শিক্ষার বাস্তব রূপদানে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হলে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে উঠবে। রমজানের কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন ও ঈদের আনন্দ তখনই পূর্ণতা পাবে ও তাৎপর্যম-িত হয়ে উঠবে এবং সেদিনই আমরা জাতীয় কবির অমর গাঁথাÑ “রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ”-সকলে সমবেত কণ্ঠে প্রাণভরে গেয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠবো, ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে পড়বে সকল প্রাণে, সমাজে, আকাশে-বাতাসে, বিশ্ব চরাচরে সর্বত্র। ই-মেইল : সধঃরঁৎৎধযসধহ১৯৪১@মসধরষ.পড়স
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।