সিয়াম ও অর্থনৈতিক সংযম
এ. জেড. এম. শামসুল আলমউপবাস থাকা সিয়াম সাধনার প্রধান অঙ্গ হওয়ার তাৎপর্য কি?আদম সন্তানের প্রথম
এইচ. এম. মুশফিকুর রহমান
সিয়াম সাধনার মাস রমজান আমাদের দুয়ারে হাজির। পশ্চিম দিগন্তে উদিত এক ফালি বাঁকা চাঁদ প্রতি বছর মুসলিম উম্মাহর জন্য নিয়ে আসে রহমত, মাগফিরাত, মুক্তি ও শান্তি-সম্প্রীতির অমীয় বার্তা। মানব জাতির ঐকান্তিক কল্যাণ ও মঙ্গল লাভের অপার সম্ভাবনা নিহিত রয়েছে এই বার্তায়। কারণ এ মাসে করুণাময় তার অফুরন্ত রহমত ও শান্তির বারিধারা বর্ষণ করেন। তার নিয়ামতের ভা-ার খুলে দেন। অগণিত বান্দাকে মাফ করে দেন। মুক্তির সুসংবাদ পৌঁছে দেন মুমিনের দুয়ারে দুয়ারে। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে প্রতিটি বিশ্বাসী বান্দার জন্য রয়েছে আল্ল¬াহ-ঘোষিত পুরস্কার লাভের মহা সুযোগ। এ মাস মানবতার জীবনের গতিবিধি পাল্টে দেয়। সামাজিক আবহে ছড়িয়ে দেয় শান্তি ও সম্প্রীতির সুবাতাস।
রমজান মাসে সিয়াম সাধনা তথা রোজাব্রত পালনের মাধ্যমে মানুষ নিজের সমুদয় জাগতিক কামনা-বাসনা পরিহার করে আত্মসংযম করে এবং ষড়রিপুকে দমন করে আল্ল¬াহর একনিষ্ঠ অনুগত বান্দা হওয়ার সামর্থ্য অর্জন করে। মাহে রমজান মানুষের অভ্যন্তরীণ যাবতীয় অহঙ্কার, কুপ্রবৃত্তি, নফসের দাসত্ব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় বলে এ মহিমান্বিত মাসের নাম ‘রমজান’।
রমজান মুমিন জীবনের অনন্য প্রাপ্তি। রোজার মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা তার বান্দাদের বহুমুখী কল্যাণের সন্ধান দেন। মানুষের গতিপথ বিভ্রান্ত করার জন্য অভিশপ্ত শয়তান সব সময় পাঁয়তারা করতে থাকে। কিন্তু রমজানের চাঁদ উদয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শয়তানকে বন্দি করে দেয়া হয়। শয়তানের কুমন্ত্রণা দ্বারা বিভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা আর থাকে না। রমজানে মানবতার প্রত্যাশিত ঠিকানা জান্নাতের দুয়ার খুলে দেয়া হয়। আর অভিশপ্ত জাহান্নামের দুয়ার দেয়া হয় বন্ধ করে। যারা জীবনের স্রোতধারা সঠিক পথে প্রবাহিত করতে চায় তাদের জন্য রমজান আশীর্বাদস্বরূপ। আল্ল¬াহ তা’আলা রমজানের চাঁদ উদয়ের মাধ্যমে মানব জাতির কাছে বার্তা পৌঁছে দেন ‘হে কল্যাণের প্রতীক অগ্রসর হও। আর হে অমঙ্গলের হোতা, তুমি তোমার কুকর্মের রশি টেনে ধর’।
রমজান মুমিনের জন্য কাক্সিক্ষত সফলতা লাভের জোরালো হাতছানি। যারা পাপাচারের মাধ্যমে জীবনটাকে অতিষ্ঠ করে করে তুলেছে রমজান তাদের ক্ষান্ত হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। পাপের খনিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত বান্দাকেও এ মাসের বরকতে মাফ করে দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন মহান রাব্বুল আলামীন। যারা দীর্ঘ এগার মাস পাপাচারে লিপ্ত থেকে অন্তরাত্মাকে কলুষিত করেছেন তারা আত্মিক উৎকর্ষ সাধন করে পৌঁছে যেতে পারেন সফলতার শীর্ষ শিখরে। এ মাসের একটি ফরজের বিনিময়ে অন্য সময়ের ৭০টি ফরজের সওয়াব দেয়া হয়। এ মাসের একটি রাতের ইবাদত হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা উত্তম। প্রতিটি রোজা মুমিনের জন্য ঢালস্বরূপ। যে ব্যক্তি ঈমান ও বিশ্বাসের সঙ্গে রোজা রাখবে তাকে সম্পূর্ণ পাপমুক্ত করে দেয়ার ঘোষণা রয়েছে।
পবিত্র মাহে রমজান মুসলিম জাতির প্রতি মহান আল্লাহর সীমাহীন অনুকম্পা ও অনুদানের অন্যতম। রহমতে আলম সাল্লাল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল¬াম এ মাসকে শাহরুন মুবারাকুনÑ বরকতময় মাস বলে অভিহিত করেছেন। এ মাসের রয়েছে বিশাল মর্যাদা ও ফযিলাত। রয়েছে বিশেষ বিশেষ আমল। এ মাসকে কেন্দ্র করে মহান আল্লাহ প্রতিটি ঈমানদারের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উন্নতি ও কল্যাণ সাধনের সুযোগ অবারিত করে দিয়েছেন। তাইতো মুমিন বান্দারা রমজানের চাঁদের হাসিতে মহা খুশি হয়। আর খুশি হওয়ার কারণ হলোÑ রাসূলুল্ল¬াহ সাল্ল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল¬াম ইরশাদ করেন, “তোমরা চাঁদ দেখতে পেলে রোজা রাখবে আবার চাঁদ দেখতে পেলে রোজা ভঙ্গ করবে। আর আকাশ (মেঘাচ্ছন্ন হয়ে) ঢেকে থাকলে গণনা করবে।” [বুখারি ১৯০০ ও মুসলিম ৮/১০৮০]
রাসূলুল্লাহ সাল্ল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল¬াম রমজান পাবার জন্য আল্ল¬াহর নিকট দু’আ করতেন। রজব মাস আসলে তিনি এ বলে দু’আ করতেন, “হে আল্ল¬াহ রজব ও শাবানকে আমাদের জন্য বরকতময় কর এবং আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দাও।” [বাইহাকি/শুআবুল ঈমান, হাদিস নং ৩৫৩৪, বাযযার/মুসনাদ ৬১৬, প্রমুখ]
আবু হুরায়রা রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্ল¬াহ সাল্লাল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, “তোমাদের নিকট রমজান এসেছে, বরকতময় এক মাস। আল্লাহ তা’আলা তোমাদের ওপর এর রোজা ফরজ করছেন। এ মাসে আকাশের সবগুলো দরজা খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের সবক’টি দরজা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং দুষ্ট-অবাধ্য শয়তানদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয়। এতে রয়েছে এমন এক রজনী, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। যে এ রাতের কল্যাণ হতে বঞ্চিত হয় সে (সর্বৈবভাবে) বঞ্চিত হয়।” [আহমাদ ২/২৩০, নাসাযী ৪/১২৯]
নবীজী নিজ সাহাবাদেরকে এ মাসের আগমনে সুসংবাদ প্রদান করতেন এবং তাদেরকে এর বৈশিষ্ট্যাবলি বর্ণনা করে শুনাতেন। তিনি তাদেরকে এ মাসে ফরজ কিংবা নফল-সালাত, দান-সদাকাহ, সৎ কাজ, দয়া-অনুগ্রহ, আল্লাহর ইবাদতে ধৈর্য ধারণ ইত্যাদি নেক আমল সম্পাদনে শ্রম ব্যয়ে উৎসাহ প্রদান করতেন। আরো উৎসাহ দিতেন মাসের দিবসগুলো রোজার মাধ্যমে আর রজনীগুলো কিয়ামের মাধ্যমে আবাদ করতে। প্রতিটি মুহূর্ত কুরআন তিলাওয়াত ও আল্ল¬াহ জিকিরে অতিবাহিত করতে।
সালাফে সালেহীনরাও নবী আদর্শের অনুবর্তিতায় আধ্যাত্মিক উন্নতি ও মাওলা সুবহানাহুর সান্নিধ্য-সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইবাদত-আনুগত্যে রমজান মাসকে অধিক গুরুত্ব দিতেন। নেক আমল সম্পাদনের লক্ষ্যে অন্যান্য ব্যস্ততা কমিয়ে দিতেন। রাতগুলো তাহাজ্জুদ আর দিনগুলো রোজা, জিকির, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদির মাধ্যমে আবাদ করতেন। এসব আমলের মাধ্যমে মসজিদগুলো থাকত সদা সজীব। প্রতিটি স্থান হতে রাহমানুর রাহীমের জিকিরের গুঞ্জরণ প্রতিধ্বনিত হতো।
রমজানের প্রাপ্তি ও সুফল নিশ্চিত হওয়ার পূর্বশর্ত হলো রমজানের দাবি যথাযথভাবে আদায় করা। আর মুমিনরা সে দাবি পূরণে সদা-সর্বদা সচেষ্ট থাকে।
প্রকৃত রোজাদার পানাহার থেকে বিরত থাকে, তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গুনাহ থেকে বিরত রাখে, তার জিহ্বাকে গালি-গালাজ ও খারাপ কথা বলা থেকে বিরত রাখে, তার শ্রবণকে গান-বাজনা, বাঁশির সুর, গালি-গালাজ ও অন্যের দোষ শোনা থেকে বিরত রাখে, তার দৃষ্টিকে নিষিদ্ধ নজর থেকে বিরত রাখে। রাসূলুল্ল¬াহ সাল্ল¬াল¬াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল¬াম বলেছেন, “যে ব্যক্তি মিথ্যা বলা ও আমল বর্জন করে নাই। তাহলে তার পানাহার ছেড়ে রোজা রাখার দরকার নেই। কেননা এতে সে আল্ল¬াহর পক্ষ থেকে কোনো বিনিময় পাবে না।” [বুখারি : ১৯০৩]
রোজাদারের জন্য যা করা অপছন্দীয় : রোজাদারের জানা উচিত যে, সে একটি মহৎ ইবাদত সম্পাদন করছে। এ ইবাদতের বিঘœ সৃষ্টি করতে পারে এমন কোনো কাজ না করা। রোজাদারের পুরোটা সময় ইবাদত গণ্য করা হবে। রাতের ঘুমও রোজার অন্তর্ভুক্ত হবে যখন সে রোজা রাখার শক্তি যোগানোর জন্য ঘুমাবে। সুতরাং রোজা রাখা অবস্থায় এ ইবাদতের সঙ্গে এমন কিছু না করা যা তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখে না।
রাসূলুল্ল¬াহ সাল¬াল্ল¬াহু আলাইহি ওয়া সাল¬াম বলেছেন, “তোমাদের কেউ যেন রোজা রাখা অবস্থায় কোনো খারাপ কর্ম না করে। যদি কেউ তার সঙ্গে ঝগড়া করতে আসে বা গালি দেয় তাহলে সে যেন বলে আমি রোজাদার।” [বুখারি : ১৮৯৪]
মাহে রমজানে রোজার প্রস্তুতির জন্য সহীহ-শুদ্ধভাবে আবশ্যকীয় বিধি-বিধান, শরীয়তের মাসআলা অনুযায়ী রোজাদারদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান থাকা খুবই দরকার। এ ছাড়া আসন্ন মাহে রমজানের পবিত্রতা রক্ষার্থে ইবাদত-বন্দেগি তথা সাহরী, ইফতার, তারাবীহ, পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত, ইতিকাফ, তাহাজ্জুদ, জিকর-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, দু’আ-ইস্তেগফার, জাকাত-ফিতরা, দান-সাদাকা প্রভৃতি সৃষ্টিকর্তার হক আদায়ের সামগ্রিক পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া উচিত।
শুধু না খেয়ে উপোস থাকাই রোজার দাবি নয়। এর প্রকৃত চাহিদা হচ্ছে সংযম। প্রতিটি কাজে-কর্মে, আচার-আচরণে সংযমী হতে পারলেই কেবল রমজানের হক আদায় করা সম্ভব। প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রোজার ছাপ অনুভূত হতে হবে। কোনো অন্যায় তো দূরে থাক, এর কল্পনা করাও পাপ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যে ব্যক্তি রোজা রেখে মিথ্যা কথা, অগোচরে নিন্দা তথা পাপকার্য থেকে বিরত রইল না, তার রোজা অর্থহীন উপবাস ছাড়া আর কিছুই নয়।’ রমজানে পাপ কাজ থেকে বেঁচে থাকা অতি সহজ। কারণ মানুষের চিরশত্রু ইবলিশকে তখন শিকলবদ্ধ করে রাখা হয়। সে জন্য রমজানের বাঁকা চাঁদ পাপমুক্ত থাকার সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। সুতরাং এত বড় সুযোগ পেয়েও যারা তা কাজে লাগাতে পারে না রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বড়ই দুর্ভাগা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
রমজানে আমলের মাধ্যমে ব্যক্তিত্বের উন্নয়ন ঘটানো যেমন অপরিহার্য তেমনি মানুষের প্রতি সদয় দৃষ্টি দেয়াও কর্তব্য। বান্দা না খেয়ে থাকলে আল্ল¬াহর কোনোই স্বার্থ নেই। আল্ল¬াহ দেখতে চান তারা বান্দা প্রভুর নির্দেশ পালনে কতটুকু আন্তরিক। আদম সন্তানের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে কী প্রয়াস গ্রহণ করে। যারা প্রাচুর্যের মাঝে বাস করেন তারা এ মাসে দুর্গতদের দুঃখ-কষ্টের কথা কিছুটা অনুধাবন করতে পারেন। রমজানের অঘোষিত আহ্বান হলো তাদের প্রতি করুণার হাত প্রসারিত করা। আল্ল¬াহর সৃষ্টির প্রতি মমতা দেখানো। রকমারি খাবারে শুধু নিজেদের উদর ভর্তি না করে তাদের প্রতিও কিছুটা সহানুভূতি দেখানো। মানুষ মানুষের জন্য এটাই রমজানের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। প্রত্যেকেই নিজ নিজ সাধ্য অনুযায়ী সমাজের দীন-দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারলে রমজানের উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য বাস্তবায়ন সহজ হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।