বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
‘মহান হজের দিবসে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ হতে মানুষের প্রতি এটা এক ঘোষণা যে, নিশ্চয়ই মুশরিকদের সম্পর্কে আল্লাহ দায়মুক্ত এবং তাঁর রাসূলও।’ (সূরা : তওবা, আয়াত-৩)। ‘ইয়াওমে হজে আকবর’, অর্থাৎ ‘মহান হজ’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে সে সম্পর্কে তফসিরকারগণের বিভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে। অনেকে বলে থাকেন যে, শুক্রবারে হজ হলে তাকে ‘হজে আকবর’ বা ‘আকবরি হজ’ বলা হয়। এর কোনোটাই সঠিক নয়। আয়াতে বর্ণিত ‘হজে আকবর’-এর সাথে ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ইতিহাস যুক্ত। সর্বসম্মত মত অনুযায়ী, হিজরি নবম সালে হজ ফরজ হয় এবং এ বছরই রসূলুল্লাহ (সা.) হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)-কে আমিরুল হজ বা হজ প্রতিনিধিদলের নেতা মনোনীত করে প্রেরণ করেন। তাঁর সফর সঙ্গীদের সংখ্যা ছিল তিনশ’। আমিরুল হজ হিসেবে তিনি মুসলমানদের হজ করাবেন, এটাই ছিল উদ্দেশ্য।
উল্লেখ্য, রাসূলুল্লাহ (সা.) ‘তাবুক’ যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তনের পর রমজানের বাকি মাস শাওয়াল এবং যিলক্বদ মাস মদিনায় অবস্থানের পর এ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনশ’ লোক ছাড়াও রাসূলুল্লাহ (সা:) হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)-কে তার পক্ষ থেকে দশটি কোরবানির পশু প্রদান করেন। এগুলোর দেখভালের দায়িত্ব পালনের জন্য নাজিয়া ইবনে জুন্দব আসলামী (রা.)-কে নিয়োগ করেন। হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) খোদ নিজের পক্ষ থেকে পাঁচটি কোরবানির পশু নিয়েছিলেন।
ইবনে ইসহাকের বর্ণনা অনুযায়ী, এরপর সূরা বারাতের চুক্তি ভঙ্গ-সংক্রান্ত আয়াতগুলো অবতীর্ণ হয়, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) হজরত আলী (রা.)-কে তাঁর ‘আল-আযবা’ নামের উটনী দিয়ে প্রেরণ করেন, যেন তিনি কাফেরদের সামনে সূরা রাবাতের আয়াতগুলো পাঠ করে শোনান।
ইবনে সাদ বলেন, হজরত সিদ্দীক (রা.) যখন ‘আল-আরাজ’ নামক স্থানে উপনীত হন, তখন ‘আল আযবা’ সওয়ার। হজরত আলী (রা.) সেখানে পৌঁছেন। তাঁকে দেখে হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি আমির হিসেবে এসেছেন নাকি ‘মামুর’ (আদিষ্ট) হিসেবে?’ হজরত আলী (রা.) বলেন, ‘মামুর হিসেবে।’ এরপর উভয়েই হজরত যাত্রা করেন। ইবনে সাদের বর্ণনায় আরো আছে, হজরত সিদ্দীক (রা.) হজরত আলী (রা.)-এর কাছে জানতে চান যে, “রাসূলুল্লাহ (সা.) আপনাকে ‘মানাসেকে হজ’ আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন কি?” হজরত আলী (রা.) জবাবে বললেন, “না, আমাকে তো এ জন্য প্রেরণ করেছেন যে, আমি লোকদেরকে সূরা ‘বারাত’-এর আয়াতগুলো পাঠ করে শুনিয়ে দেবো এবং যার সাথে অঙ্গীকার রয়েছে, তার অঙ্গীকার তাকে ফেরত দেবো, (অর্থাৎ বহাল রাখব কিংবা বাতিল করব)।”
মোট কথা, হজরত সিদ্দীক (রা.) লোকদেরকে মানাসেকে হজ শিক্ষা দেন, হজ করান এবং খুতবা পাঠ করেন এবং হজরত আলী (রা.) কোরবানি দিবসে ‘জামরাতুল আকবার’-এর নিকট দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেন, যেভাবে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে বলেছিলেন এবং যার সাথে অঙ্গীকার ছিল তার অঙ্গীকার ফেরত দেয়ার কথা ঘোষণা করেন এবং বলেন : “হে লোক সকল! কোনো কাফের জান্নাতে প্রবেশ করবে না এবং এই বছরের পর কোনো মোশরেক হজ করবে না এবং উলঙ্গ অবস্থায় কেউ বায়তুল্লাহ তওয়াফ করবে না এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য যার অঙ্গীকার ছিল তা অক্ষুন্ন থাকবে।” ‘আমিরুল হজ’ হিসেবে এটি ছিল হজরত সিদ্দীক (রা.)-এর হজ পালনের সংক্ষিপ্ত কাহিনী। আর এটিই ছিল পরবর্তী বছর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর হজ পালনের পটভ‚মিকা, যা ছিল তার জীবনের শেষ হজ এবং মদিনায় হিজরতের পর প্রথম হজ। যেটাকে বলা হয়েছে ‘হজে আকবর’।
এ ক্ষেত্রে বলে রাখা দরকার, রাফেজী শিয়াদের মনের আগুন এখানেও জ্বলে ওঠে। তারা হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)-কে ‘আমিরুল হজ’ হিসেবে মেনে নিতে নারাজ। এমনকি হজরত আলী (রা.)-কে রাসূলুল্লাহ (সা.) ‘আমিরুল হজ’ হিসেবে প্রেরণ করেন এবং হজরত সিদ্দীক (রা.)-কে এ পদ থেকে বাদ করে দেন। সুতরাং আলী (রা.)-এর নেতৃত্বেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তাদের এরূপ ভিত্তিহীন অভিযোগ খন্ডন করা হয়েছে। বলতে হয়, এ অন্ধ জ্ঞানপাপীরা হজরত আলী (রা.)-এর মুখে উচ্চারিত স্বীকারোক্তিগুলোকে অস্বীকার করে তাদের মনগড়া বিভ্রান্তিকর মতবাদ প্রচার করতে দ্বিধাবোধ করে না। যেকোনো সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন লোক রাফেজী শিয়াদের এই ভ্রান্ত মতবাদকে সমর্থন করতে পারে না। এটি তাদের ইতিহাস বিকৃতির অপতৎপরতা, যা কিছুতেই গ্রহণযোগ্য নয়। (পরবর্তী আলোচ্য : ‘হজে আকবর’)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।