হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির খড়গ : আসামের এনআরসি এবং বাংলাদেশ
কিশোর শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে ঢাকাসহ সারাদেশে তীব্র রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছিল,
মেহেদী হাসান পলাশ
গত ৩১ মে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, ২০১৭ সাল থেকে আর পঞ্চম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষা থাকবে না। এর পরিবর্তে ৮ম শ্রেণীতে অনুষ্ঠিত হবে পিএসসি পরীক্ষা। মন্ত্রীর এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের মধ্যে আনন্দ সঞ্চারিত হয়েছে। একই সঙ্গে বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের মধ্যে দীর্ঘশ্বাস ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের ক্ষোভের কারণ মন্ত্রী যখন তুলে নিলেনই তখন এ বছর থেকে নিলে সমস্যা কি ছিল!
আসলে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নিয়ে ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকগণ প্রবল ভোগান্তির শিকার হতো। সে কারণে তারা এ পরীক্ষা তুলে নেয়ার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা শুরু থেকেই পঞ্চম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষা রাখার সমালোচনা করে আসছিলেন। তাদের মতে, এ পরীক্ষা পঞ্চম শ্রেণীর একটি শিশুর ওপর প্রবল মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছে, যা সুষ্ঠুভাবে একটি শিশুর মানসিক বিকাশের অন্তরায়।
পঞ্চম শ্রেণীতে পিএসসি পরীক্ষা থাকায় নিজের সন্তানের জন্য সর্বোচ্চ জিপিএ পাওয়ার আশায় সন্তানকে ভয়াবহ প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দিয়ে থাকেন অভিভাবকরা। পঞ্চম শ্রেণী পড়ুয়া একজন শিশু শারীরিক ও মানসিকভাবে এই ভার বহনে অক্ষম হলেও অভিভাবক ও স্কুল টিচারদের চাপে মুখ বুজে টানতে বাধ্য হয়। গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব এডুকেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রবর্তিত সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন না খোদ অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষক। ২৫ ভাগ শিক্ষার্থী পরীক্ষার সময় প্রশ্নপত্র বুঝতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে, সৃজনশীল পদ্ধতি ভালো হলেও এর সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। এ পদ্ধতি চালুর পর থেকে শিশুদের ওপর বইয়ের বোঝা বেড়ে গেছে। সরকারের নির্ধারিত বইয়ের অতিরিক্ত কোনো বই স্কুলের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হবে না, এই মর্মে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের পরিষ্কার নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও অনেক স্কুল কর্তৃপক্ষই তা অনুসরণ করেন না। ফলে বইয়ের বোঝা বইতে হয় শিক্ষার্থীদের। মূলত প্রকাশকের কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহণ ও কোচিং বাণিজ্য করার জন্যই শিক্ষকরা সিলেবাসের বাইরের বই শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেন। তারপরও তাদের নির্দেশ বা নোট শিটের মতো করে প্রশ্নের উত্তর বা সমাধান না লিখলে শিক্ষকরা উত্তর কাটা দিয়ে দেন। এ সুযোগে শিক্ষকদের আলাদা নোটশিট বাণিজ্য শুরু হয়। প্রত্যেক বিষয়ের জন্য আলাদা কোচিং, আলাদা শিট। শিটের নামে শিশুদের ওপর প্রশ্নের সরাসরি উত্তর বা সমাধানের পরিবর্তে উচ্চতর শ্রেণীর নানা তথ্য সংযোজন করে বিশাল বিশাল রচনা তৈরি করেন। ছোটখাটো প্রশ্নেরও দীর্ঘ উত্তর তৈরি করেন শিক্ষকরা। অপ্রয়োজনীয় এ তথ্য সম্বলিত উত্তর মুখস্থ করতে ও লিখতে গিয়ে শিশুদের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়।
সিলেবাসের বই, সিলেবাস বহির্ভূত বই, নোট, গাইড, শিট, খাতা, পানি, নাস্তাসহ একটি শিশুকে ২০ কেজির মতো ভারী একটি ব্যাগ প্রতিদিন স্কুলে বহন করে নিয়ে যেতে হয়। এটি শিশুর শারীরিক বৃদ্ধির পক্ষে ভয়াবহ ক্ষতিকর। ভোর ৫টার দিকে এই শিশুকে ঘুম থেকে টেনে তোলেন অভিভাবক। এরপর আসে ধর্মীয় শিক্ষক, তাকে বিদায় দিয়ে ৭টার মধ্যে রেডি হয়ে বের হতে হয় কোচিংয়ের উদ্দেশ্যে। কোচিং শেষ করে স্কুল। বিকালে স্কুল শেষ হলে আবার কোচিং করিয়ে রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে সন্ধ্যা ৭টায় বাড়ি ফিরতে ফিরতেই হোম টিউটর এসে খাড়া। হোম টিউটর চলে যাওয়ার পর ঘুমের ক্লান্তি-শ্রান্তিতে ঢলে পড়া শিশুকে টেনে ধরে অভিভাবক হোম টাস্ক করাতে বসেন। পরে রাত ১২-১টার পর যে শিশুটি ঘুমাতে যায় তাকেই আবার পরদিন ভোর ৫টায় ঘুম থেকে টেনে তোলেন অভিভাবক। সাপ্তাহিক ছুটির দিনেও যে সে একটু রেহাই পাবে তার উপায় নেই। আর্টের ক্লাস, নাচের ক্লাস, গানের ক্লাস, কোচিংয়ে মডেল টেস্ট পরীক্ষা ইত্যাদি থাকে এদিন। ফলে সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য যে খেলাধুলা, বিনোদন, মানসিক ফ্রেসনেস কোনোটাই পায় না শিশুরা। এমতাবস্থায় যন্ত্রের মতো বেড়ে ওঠা শিশুর জিপিএর দৌড়ে নোটশিট গোগ্রাসে গেলা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এতে হয়তো জিপিএ অর্জন হয় কিন্তু বিদ্যার্জন ও বিদ্যার্জনের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়।
এদিকে শিশুর সঙ্গে জিপিএ প্রতিযোগিতায় দৌড়ে অভিভাবকদের মাসিক অর্জনের অধিকাংশ টাকা ব্যয় হয়ে যায়। রাজধানীতে একটি শিশুর শিক্ষার পেছনে যে কোনো অভিভাবকের কমপক্ষে মাসিক ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। স্কুলের বেতন, কোচিং, হাউস টিউটর, ধর্মীয় শিক্ষক, সহশিক্ষা, যাতায়াত, খাবার, বই, খাতা, পোশাক, কলম, নোট, শিট ইত্যাদি মিলিয়ে এই অর্থ ব্যয় হয়। এর বাইরেও সেশন ফি, ভর্তি ফি, পরীক্ষার ফি ইত্যাদি নামে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ হয়। বর্তমান পদ্ধতিতে সরকারি নিয়ম মেনে পরীক্ষার মাধ্যমে রাজধানীর স্কুলগুলোতে খুব অল্প পরিমাণ শিশু ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু এরপর ওই স্কুলগুলোতেই হাজার হাজার শিশু ভর্তি হয় শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের ঘুষ দিয়ে। রাজধানীতে এই ঘুষের পরিমাণ দেড় লাখ টাকা থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। এভাবে ঘুষ নিয়ে একেকটি ক্লাসে বিপুল পরিমাণ শিশু ভর্তি করার ফলে ক্লাসের নির্ধারিত সময়ে একজন শিক্ষকের পক্ষে হাজিরা নেয়ার পর বড়জোর হোমটাস্ক দেয়ার সুযোগ হয়। আর এভাবেই ক্লাসে পূর্ণ শিক্ষা না পাওয়ায় শিশু ও তার অভিভাবকদের সামনে কোচিংয়ে যাওয়া ছাড়া ভিন্ন গত্যন্তর থাকে না। সরকার স্কুলের শিক্ষকদের কোচিং করানো বন্ধের জন্য বিভিন্ন আইন ও বিধান করেছে। কিন্তু শিক্ষকরা ঠিকই তার ফাঁক গলিয়ে অবাধে কোচিং বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। আগে শিক্ষকরা পড়াতেন আর এখন তার পরিবারের সদস্যরা পড়ায়। তাতে বরং ছাত্রদের ক্ষতিই বেশি হয়েছে। কোচিং বলতে নোটশিট দেয়া ও মডেল টেস্ট। মূল পড়াটা বাড়িতেই পড়তে হয়। অথচ এই কোচিংয়ের নামে রাজধানীতে একজন শিক্ষক মাসে ৫ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকেন। বিনা পুঁজির এই ব্যবসায় শিক্ষকদের মূল আগ্রহই কোচিংয়ে। এভাবে একজন বাচ্চার পেছনে শিক্ষা জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একজন অভিভাবক শুধু শিক্ষা খাতে ব্যয় করেন কোটি টাকা ওপর। যে অভিভাবকের একাধিক বাচ্চা স্কুলগামী তার রাজধানীতে ২০-৫০ হাজার টাকা শুধু মাসিক শিক্ষা ব্যয়। শুধুমাত্র চাকরি বা একটি কাজের ওপর নির্ভরশীল একজন অভিভাবকের পক্ষে সন্তানের শিক্ষা ব্যয় নির্বাহ করা অসম্ভব। সে কারণে একজন অভিভাবককে নির্ধারিত চাকরির বাইরে অন্য কাজ করতে হয়। এতে করে ওই অভিভাবকের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবন, বিনোদন, বিশ্রাম, শখ বলে কিছুই থাকছে না। সন্তানের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে একজন পিতা বা অভিভাবককে যেভাবে উদয়াস্ত পরিশ্রম করতে হয় তাতে অতিরিক্ত জীবনী শক্তি ক্ষয়ে দ্রুতই বার্ধক্য, রোগ ও মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছেন তারা।
একইভাবে যে মাকে তার শিশুকে নিয়ে স্কুল ও নানা ধরনের কোচিংয়ের পেছনে দৌড়াতে হয় তারও ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবন নষ্ট হচ্ছে। বিনোদন, বিশ্রাম, আকাক্সক্ষা, শখ সব বিসর্জন দিয়ে সন্তানের হাত ধরে দৌড়াতে গিয়ে বিষণœতা, অবসাদ, হতাশার মতো নানা মানসিক ও শারীরিক রোগে আক্রান্ত হতে হচ্ছে। স্বামী বা সংসারের প্রতি তারা মনোযোগী হতে পারছেন না। বিদ্যালয় নানা উপলক্ষে ছুটি থাকে। কিন্তু কোচিং, ছুটির পড়া ও ছুটির পরের পরীক্ষার চিন্তায় মায়ের পক্ষে সে ছুটি উপভোগ করা হয় না। বর্তমান বাস্তবতায় একজন মাকে ভোর ৪টা থেকে ৫টায় ঘুম থেকে উঠতে হয়। এরপর চুলায় রান্না চাপিয়ে বাচ্চাকে টেনে তুলে পড়তে বসাতে হয়। কোনো রকমে রান্না শেষ করে বাচ্চাকে রেডি করে তার হাত ধরে স্কুলের পানে ছুটতে হয়। আর্থিক সক্ষমতা, দূরত্ব, যাতায়াত সমস্যার কারণে অধিকাংশ মাকে বাচ্চাকে কোচিংয়ে দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতে হয়। কোচিং শেষ হলে তাকে নিয়ে স্কুলে ঢুকিয়ে আবার বাইরে দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়। স্কুল শেষ হলে আবার তাকে নিয়েই বিকালের কোচিং করিয়ে ক্লান্ত দেহে বাসায় ফিরেও বিশ্রামের সুযোগ নেই, বাচ্চাকে আবার হাউস টিউটরের কাছে পড়ানোর জন্য রেডি করে দিতে হয়। হাউস টিউটর চলে গেলে মাকে আবার বাচ্চাকে জোর করে হোমটাস্ক করাতে বসতে হয়। সারা দিনের পরিশ্রমে বাচ্চাটি তখন ঘুমে ঢুলুঢুলু, তাই পড়ার দায়িত্ব মাকেই নিতে হয়। শ্রান্ত দেহে মা জোরে জোরে পড়েন আর বাচ্চা চোখ বন্ধ করে শ্রবণেন্দ্রীয় ব্যবহার করে অধ্যয়ন চালিয়ে যায়। এরপর বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে পর দিনের স্কুলের জন্য বইখাতা গুছিয়ে রেখে যতক্ষণে তিনি ফ্রি হন, শরীর ও মনে এক বিন্দুমাত্র শক্তি ও উৎসাহ অবশিষ্ট থাকে না সংসারী কাজে মনোযোগ দেয়ার। ফলে সংসার ও স্বামীর দিকে খেয়াল দেয়ার কোনো অবকাশই থাকে না তার। একান্ত সময়, নিজস্ব আশা-আকাক্সক্ষা পূরণের কোনো অবকাশ না থাকায় বাবার মতো মাকেও অকাল বার্ধক্য ও নানা রোগের শিকার হতে হয়।
এত গেল এক দিক, অনেক মাকেই সন্তানের জন্য তার গ্লোরিয়াস রেজাল্ট, ব্রাইট ক্যারিয়ার বিসর্জন দিতে দেখা যায়। বিশেষ করে সন্তান হওয়ার পর তার লালন-পালন ও একটু বড় হওয়ার পর তাকে নিয়ে পড়াশোনার তদারকি করতে গিয়ে আমাদের দেশে মা-দেরকেই তাদের ক্যারিয়ার বিসর্জন দিতে হয়। অনেক মা চাকরি থেকে মাতৃত্বকালীন ছুটি নিলেও ছুটি শেষে আর চাকরিতে ফিরতে পারেন না সন্তান লালন-পালনের জন্য। আবার সংসারী নারীদের নানা ঝামেলার কথা চিন্তা করে অনেক ক্ষেত্রেই চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের চাকরিতে রাখতে চায় না। ফলে তারুণ্য ও ছাত্রজীবনের স্বপ্নকে বিসর্জন দিয়ে মাকে সন্তানের পেছনে ছুটতে হয়। আবার বাচ্চা মেয়ে শিশু হলে আরেক সংকট। রাস্তাঘাটের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে মাকে সারাক্ষণ তার পিছু পিছু ছুটতে হয়। ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রেও এ সংকট কম নয়। ছেলে বিপথে ও বখাটেদের পাল্লায় পড়বে এই ভয়ে মা ছেলে সন্তানকে স্কুল বাসে দিতেও সাহস পান না। এভাবে যে শিক্ষা আনন্দের হওয়ার কথা ছিল তা শিশু ও অভিভাবকের ওপর নির্যাতনের মতো আপতিত হয়েছে।
অথচ উন্নত দেশগুলোতে এর সম্পূর্ণ উল্টো চিত্র দেখতে পাই। যুক্তরাষ্ট্রে বাচ্চাদের বাড়িতে পড়তে হয় না। সেখানে বাচ্চারা স্কুলে পড়ে, বইখাতা সেখানেই রেখে চলে আসে। জাপানে বাচ্চাদের কোনো ক্লাসে কোনো রোল নম্বর থাকে না। ফলে অভিভাবকরা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় বাচ্চাদের নামতে বাধ্য করে না। ফিনল্যান্ডের শিক্ষা ব্যবস্থায় কোনো ধরনের বাহ্যিক খবরদারি বা মান যাচাইয়ের লক্ষ্যে ঘন ঘন পাবলিক পরীক্ষার চল নেই। পিতামাতারা তাদের সন্তানদের ভার শিক্ষকদের ওপর ছেড়েই নিশ্চিন্ত। ফলে ফিনল্যান্ডে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার ১% এরও কম। আমাদের শিশুদের মতো গাদা গাদা বই বিশ্বের আর কোনো দেশে পড়তে হয় না। এই গাদা গাদা বই পড়ানোর পেছনে শিশুর জ্ঞানার্জনের কোনো উদ্দেশ্য কাজ করে না, করে বই বাণিজ্য ও শিক্ষা বাণিজ্য। সরকার আইন করে নোট-গাইড নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু আইনের ফাঁক গলিয়ে শিক্ষা সহায়িকাসহ নানা নামে বাজারে নোট গাইডের দোর্দ- প্রতাপ। সেসব আবার উচ্চ দামে বিক্রি হচ্ছে, যা থেকে শিক্ষক, বিদ্যালয়ের অভিভাবক কমিটি ও শিক্ষক সংগঠনগুলো কমিশন পাচ্ছে। সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক কারণে একজন শিশুর ওপর অতিরিক্ত বইয়ের নামে নির্যাতন চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে শিশু তার আনন্দময় শৈশব, দুরন্ত কৈশোর হারিয়ে ফেলছে। ফলে এ শিশুরা হয়তো জিপিএর ভারি গ্রেড অর্জন করছে কিন্তু মানবিক, সামাজিক গুণসম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ মানসিক বিকাশ পাচ্ছে না।
কলোম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল সেন্টার অব এডুকেশনের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, শিশুদের ওপর অতিরিক্ত চাপ তাদের মাদকাসক্তের দিকে ঠেলে দেয়। এই ‘চাপ’ বলতে মানসিক, পড়াশোনা বিষয়ক, পারিবারিক, সামাজিক সব ধরনের চাপ বুঝানো হয়েছে। এই গবেষণায় বাচ্চাদের জন্য সবচেয়ে বেশি চাপ অনুভূত হয়েছে পড়াশোনার চাপ। গবেষক দল তাদের সার্ভের জন্য ১ হাজার ৯৮৭ জন শিশু-কিশোর এবং ৫০৪ জন অভিভাবকের ইন্টারভিউ নিয়েছিল। ফলাফলে দেখা গেছে, ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের ভেতর যারা প্রায় একঘেয়েমিতে থাকে তাদের মধ্যে পঞ্চাশ ভাগই ধূমপান, অ্যালকোহল সেবন, মদ্যপান ইত্যাদিতে আসক্ত হয়। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানা গেছে. দাদা-দাদি, নানা-নানীর সাহচর্য শিশুদের দীর্ঘজীবী করে। এখন পড়াশোনার আর পরীক্ষার চাপে দাদা বাড়ি, নানা বাড়ি বেড়ানোর সুযোগ পায় না শিশুরা। আবার ব্রিটেনভিত্তিক দাতব্য সংস্থা রয়েল সোসাইটির এক জরিপে জানা যায়, ব্রিটেনে ১৫ থেকে ৩৪ বছর বয়স্ক মানুষের কোনো সোনালি শৈশব নেই! প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়ার মতো অকৃত্রিম অভিজ্ঞতা তাদের জীবনে ঘটেনি! জরিপে সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেনÑ সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার জন্য শিশুজীবনে প্রকৃতিবান্ধব অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নেই।
আমাদের বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন হয়, শিক্ষা নীতি পরিবর্তন হয়, বছর বছর সিলেবাস পরিবর্তন হয়। এসব কিছু যতটা না শিক্ষার জন্য তার চেয়ে বেশি প্রজেক্ট তৈরির উদ্দেশ্যে। আর প্রজেক্ট মানেই টাকা। কাগজে বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষার কথা বলা হলেও বাস্তবতা উপরে আলোচিত হয়েছে। শিক্ষার অতি বাণিজ্যিকীকরণ করে আমরা শিশুদের কেবলই বলছি পড়, পড়, পড়। আর অভিভাবকদের বলছি তার পেছনে টাকা ঢালো আর দৌড়াও। শিক্ষার অপর নাম এখন নির্যাতন-শিক্ষা নির্যাতন। এখান থেকে আমাদের বেরুতে হবে অতি দ্রুত। আমাদের শিশুরা আনন্দমুখর পরিবেশে শিক্ষা লাভ করুক, আমাদের অভিভাবকগণ বাচ্চার শিক্ষা নিয়ে নিশ্চিতে থাকুন এমন পরিবেশ দ্রুত তৈরি হোক, এটাই জাতির প্রত্যাশা।
Email:[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।