বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
সিন্ধু বিজয় ইসলামের ইতিহাসের একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। পঞ্চাশ হাজার বাহিনীসহ পৌত্তলিক হিন্দু রাজা ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনীর নিকট শোচনীয় পরাজয় বরণ, দাহিরের নিহত হওয়া এবং রাণীর অগ্নিকান্ডে আত্মাহুতির মাধ্যমে সিন্ধু ‘বাবুল ইসলাম’ অর্থাৎ ইসলামের প্রবেশদ্বারে পরিণত হয় এবং ভারতবর্ষে সিন্ধু হয় প্রথম ইসলাম রাষ্ট্র। হজরত ওমর (রা:)-এর খেলাফত আমলে মুসলমানগণ মাকরান (বেলুচিস্তান) জয় করেণ এবং এই এলাকাকে আরব সাম্রাজ্যের সর্বশেষ পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশ হিসাবে গণ্য হয়। উমাইয়া খলিফা প্রথম ওয়ালিদ (৭০৫-৭১৫)-এর শাসনামলে আরবরা এই অঞ্চলে আরও বিজয় অর্জন করতে থাকে। ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ সাকাফী এই প্রদেশের সুবেদার (গভর্নর) ছিলেন।
বনী উমাইয়া যুগের সবচেয়ে বিচক্ষণ, দূরদর্শী গভর্নর হাজ্জাজের অধীনে আরবরা সিন্ধুতে অভিযান চালিয়ে তা জয় করেন। সিন্ধু বিজয়ের ফলে পূর্বাঞ্চলে মুসলমানদের পথ খুলে যায়। এইজন্য সিন্ধুকে পূর্বাঞ্চলে ইসলামের প্রবেশদ্বার বলা হয়। এই সিন্ধু বিজয়ের একটি ঐতিহাসিক ঘটনা রয়েছে।
সিন্ধুর রাজা দাহিরের রাষ্ট্র আরবদের মাকরান প্রদেশের পূর্বে অবস্থিত ছিল। সে সময়ের একটি ঘটনা। সর›দ্বীপে অবস্থানকারী কোনো কোনো আরব বণিকের ইন্তেকাল হয়। সেখানকার রাজা ছিলেন সন্ধিপ্রিয় এবং মুসলমানদের সাথে উত্তম সম্পর্ক স্থাপনের প্রত্যাশী। তিনি আরব বণিকদের পরিবারবর্গ ও এতিম শিশু কন্যাদের ৮টি জাহাজের সমন্বয়ে গঠিত একটি নৌবহরযোগে পাঠিয়ে দেন এবং এই জাহাজে গভর্নর হাজ্জাজ কিংবা খলীফা ওয়ালিদের জন্য বেশ কিছু মূল্যবান উপহার-উপঢৌকন প্রেরণ করেন।
প্রচলিত বর্ণনা অনুযায়ী দেবলের সৈন্য ও নৌ-দস্যুরা নৌবহরে আক্রমণ চালায়। যাত্রীদের মারধর করে ও জাহাজের মালসামান লুট করে নিয়ে যায়। এমনকি আরব নারী-শিশুদেরকেও গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। একজন মহিলা তখন চিৎকার করে ফরিয়াদ করতে থাকে, “হে হাজ্জাজ, সাহায্য কর!” হাজ্জাজ এই নির্যাতনের খবর শুনে খুবই মর্মাহত ও বিক্ষুব্ধ হন এবং বলে উঠেন, “আমি এখনই সাহায্য পাঠাচ্ছি।”
হাজ্জাজ হিন্দুরাজ দাহিরের নামে প্রেরিত এক পত্রে লেখলেন; “আমাদের নিরীহ আরব নারী ও শিশুদেরকে ফেরত পাঠাও।” কিন্তু দুষ্ট দাহির জবাবে বললো; “এ কাজটি নৌ-দস্যুরা করেছে এ ব্যাপারে আমার করণীয় কিছুই নেই।” একই সাথে হাজ্জাজকে স্বয়ং এসে দস্যুদের দমন করার উপদেশ প্রদান করে। দাহিরের এ অশুভ আচরণের প্রতিক্রিয়া স্বরূপ হাজ্জাজ আবদুল্লাহ আসলামীকে ছয় হাজার সৈন্যসহ সিন্ধু অভিযানে প্রেরণ করেন। আব্দুল্লাহ এ যুদ্ধে শহীদ হন।
অত:পর বোদাইন ইবনে তোহফা বাজালীকে আম্মান হতে দেবলে প্রেরণের নির্দেশ দেয়া হয়। তিনিও ছয় হাজর সৈন্যসহ সেখানে পৌঁছেন এবং অত্যন্ত বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত: এ সময় তিনি ঘোড়া হতে পতিত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। হাজ্জাজ এই দু:সংবাদ পেয়ে খুবই ব্যথিত হন।
অত:পর তিনি তৃতীয় অভিযান হিসাবে তার যুবক চাচাত ভাই ও পারস্যের শাসনকর্তা ইমামুদ্দীন মোহাম্মদ ইবনে কাসেম সাকাফকে ছয় হাজার সিরীয় সৈন্যসহ সিন্ধু অভিযানে প্রেরণ করেন। উল্লেখ্য, সিন্ধুর নৌ-দস্যুরা আরবদের ক্রমবর্ধমান ব্যবসা-বাণিজ্যে অহরহ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে আসছিল। এই কারণে এবং হাজ্জাজের সাথে দাহিরের অশুভ আচরণ ও অন্যান্য স্থানীয় শাসকদের অত্যাচার-নির্যাতন চিরতরে বন্ধ করা অতি জরুরী হয়ে পড়েছিল।
অত:পর তৃতীয় অভিযানের অংশ হিসাবে মোহাম্মদ ইবনে কাসেমকে সেনাপতি নিয়োগ করে ছয় হাজার সিরীয় অশ্বরোহী, কোনো কোনো বর্ণনা অনুযায়ী, একই সংখ্যক উষ্ট্রারোহীসহ মাকরানের দিকে যাত্রা করেন। সেখানে তিনি আরও সৈন্য সাহায্য লাভ করেন। ৭১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি দেবলের নিকটবর্তী দুর্গ অবরোধ করেন এবং কয়েক মাস অবরোধের পর দেবল দুর্গ বিজিত হয়। এরপর মোহাম্মদ ইবনে কাসেম দেবলে চার হাজার সৈন্য রেখে দিয়ে সামনে অগ্রসর হতে থাকেন। বিনা যুদ্ধে বহু এলাকা জয় করে উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। এসময় রাজা দাহির পঞ্চাশ হাজার সৈন্যসহ মুসলমানদের অগ্রযাত্রা রোধ করতে আসে।
মোহাম্মদ ইবনে কাসেম সিন্ধু নদ অতিক্রম করার প্রস্তুতি শুরু করে দেন এবং নদী অতিক্রম করে তিনি ‘রাওড়’ নামক স্থানে উপনীত হন। সেখানে উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। রাজা দাহির পরাজিত হয়ে নিহত হন, রাণী অগ্নিকুন্ডে আত্মাহুতি দেয় এবং তাঁর অবশিষ্ট সৈন্যরা রণক্ষেত্র ত্যাগ করে পালিয়ে যায়। সে দেশের অদিবাসীরা বিনা প্রতিরোধে আত্মসমর্পণ করে। এভাবে সিন্ধু ‘বাবুল ইসলাম’ বা ইসলামের প্রবেশ দ্বারে পরিণত হয়। মোহাম্মদ ইবনে কাসেম সেখানে বিজয় পতাকা উত্তোলন করত: তাঁর বিজয় অভিযান অব্যাহত রাখেন। এভাবে হিজরী ৯৩/৭১২ সালের ১২ জুন (ভিন্ন মতও রয়েছে) মোহাম্মদ ইবনে কাসেম কর্তৃক সিন্ধু বিজিত হয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।