Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

তিন বছর পর নির্বাচন

সুদানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির- শেষ

ডন | প্রকাশের সময় : ৭ জুলাই, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

অর্থের জন্য বেপরোয়া হয়ে ওঠা বশির একই মাসের শেষদিকে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির সাথে বৈঠক করার জন্য দোহা সফরে যান। বশিরের ঘনিষ্ঠ মহলের এক সদস্যের মতে, বশিরকে ১০০ কোটি ডলার লাইফলাইনের প্রস্তাব দেন আমির। সূত্র জানায়, আমির যখন প্রকাশ করেন যে তার উপর বিশেষ পক্ষের চাপ রয়েছে, তখন বশির শূন্য হাতে দেশে ফেরেন। এই পক্ষ কে, তা আমির তাকে বলেননি।
কাতার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, সুদানের প্রতি কাতারের সাহায্যের উদ্দেশ্য ছিল সুদানি জনগণের উন্নতি ও কল্যাণ। তার সাথে কোনো দল বা শাসক গোষ্ঠির সম্পর্ক ছিল না। কর্মকর্তা বলেন, সুদানে সাহায্য বন্ধের ব্যাপারে কাতারের উপর তৃতীয় কোনো পক্ষের চাপ ছিল না। সুদানে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো চলমান ছিল।
একটি চক্রান্ত : চোখের আড়ালে বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করার চক্রান্ত বাস্তব রূপ নিতে চলেছিল। এক বিরোধী নেতা, যিনি ছিলেন রাজধানী খার্তুমে কোবার কারাগারে আটক অন্যান্য রাজবন্দিদের একজন। তিনি বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে গোয়েন্দা প্রধান সালাহ গশ অপ্রত্যাশিতভাবে কারাগারে আসেন ও ৮ জন বিরোধী নেতার সাথে সাক্ষাত করেন।

সালাহ গশ তাদের বলেন যে তিনি আবুধাবি থেকে এসেছেন। ইউএই জ্বালানি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক সাহায্যের অঙ্গীকার করেছে। তিনি সুদানে নয়া রাজনৈতিক ব্যবস্থার এক পরিকল্পনার প্রতি তাদের সমর্থন কামনা করেন। ১০ দিন পর সালাহ আবার কারাগারে গিয়ে ২৬টি সেলে যান। সেগুলোর প্রত্যেকটিতে রাজনৈতিক বন্দিরা ছিলেন।

সেই বিরোধী নেতা অন্য সকল বন্দির সাথে মুক্তি লাভ করেছেন। তিনি বলেন, তারপর থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হল। আমাদের বিনামূল্যে সিগারেট ও একটি টিভি এবং চিবনোর জন্য তামাক দেয়া হল। তিনি বলেন, গোয়েন্দা প্রধান বিরোধী নেতাদের সাথে সাক্ষাত করায় আমরা খুব অবাক হলাম। কিন্তু যখন অভ্যুত্থান সংঘটিত হল, তখন তার কারণ বুঝলাম।

খার্তুমে একজন সিনিয়র পশ্চিমা কূটনীতিক, বশিরের ঘনিষ্ঠ মহলের সদস্যরা এবং সালাহ গশের ঘনিষ্ঠ সূত্রদের মতে, মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ইউএই ও সালাহ গশ বশিরের জন্য এক সম্মানজনক অপসারণের প্রস্তাব দেন। এ পরিকল্পনায় নির্বাচন অনুষ্ঠান পর্যন্ত বশিরকে অন্তর্বর্তী শাসক রাখার কথা বলা হয়। ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখ এক সাংবাদিক সম্মেলনে সালাহ গশ ঘোষণা করেন যে ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির নেতার পদ থেকে বশির পদত্যাগ করছেন এবং তিনি ২০২০ সালের নির্বাচনে দাঁড়াবেন না।

তার পরপরই এক টেলিভিশন ভাষণ দেন প্রেসিডেন্ট বশির। তাতে দলের নেতার পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর কথা তিনি উল্লেখ করেননি। তিনি দলের সদস্যদের সেদিনই জানান যে সালাহ গশ ব্যাপারটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছেন। তারপর থেকেই বশিরের বিরুদ্ধে তৎপরতা জোরদার হয়। ইউএই বশির-উত্তর সুদানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনার জন্য সুদানের বিরোধী দলগুলো ও বশিরের বিরুদ্ধে লড়াইরত বিদ্রোহীদের সাথে যোগাযোগ করে।

এপ্রিলের ৬ তারিখ বিক্ষোভকারীরা সুদানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাইরে এবং বশিরের প্রাসাদের অনতিদূরে ক্যাম্প স্থাপন করে। তখন সালাহ গশের নেতৃত্বাধীন গোয়েন্দা সংস্থা ও নিরাপত্তা দফতর তাদের থামানোর চেষ্টা করেনি। হাবানি বলেন, আমরা তখন বুঝতে পারলাম যে সেনাবাহিনী ক্ষমতা হাতে নিচ্ছে।

সালাহ গশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, সেনাবাহিনী প্রধান ও পুলিশ প্রধানের সাথে সাক্ষাত করেন। এখন বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করার সময় এসেছে বলে তারা একমত হন। সালাহ গশের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, প্রত্যেকেই উপলব্ধি করেন যে বশিরের দিন শেষ হয়ে গেছে। বর্তমানে সুদানের দায়িত্ব থাকা অন্তর্বর্তীকালীন সামরিক পরিষদের এক মুখপাত্র বলেন, বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সালাহ গশ এক প্রধান ভ‚মিকা পালন করেন।
বশিরের দীর্ঘদিনের মিত্র মিলিশিয়া নেতা লে. জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো ছিলেন বশির বিরোধী ষড়যন্ত্রে যোগদানকারী সর্বশেষ ব্যক্তি। দাগালো তার দাদীর দেয়া নাম হেমেদতি নামেই বেশি পরিচিত। তিনি সুদানের আতঙ্ক সৃষ্টিকারী বিপুল অস্ত্রসজ্জিত আধা সামরিক ইউনিট র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস-এর প্রধান। তাদের সংখ্যা বহু হাজার। তারা খার্তুম নিয়ন্ত্রণ করে।

বশিরের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। এপ্রিলের ১১ ভোরে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। এর কয়েকদিন পর ইউএই ও সউদী আরবের সাথে সম্পর্ক রক্ষায় নিয়োজিত বশিরের লোক হোসেন সউদী ও ইউএই প্রতিনিধিদলের দলের সাথে সুদানে ফিরে আসেন ও সুদানের নয়া সামরিক শাসকদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

২১ এপ্রিল ইউএই ও সউদী আরব ঘোষণা করে যে তারা সুদানকে সাহায্য হিসেবে ৩০০ কোটি ডলার দেবে। হেমেদতি তখনি বলেন, সুদানি সৈন্যরা ইয়েমেনে থাকবে। একই সময়ে বিরোধী দল ও বিদ্রোহীরা আবুধাবিতে ইউএই কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেন। দারফুরের রেবল জাস্টিস অ্যান্ড ইকুয়ালিটি মুভমেন্টের সিনিয়র কর্মকর্তা আহমেদ তুগোদ এ আলোচনায় উপস্থিতদের একজন ছিলেন।

তিনি বলেন, ইউএই কর্মকর্তারা সমঝোতা ও স্থিতিশীলতার ব্যাপারে তাদের মত জানতে চান। আমরা শান্তি প্রক্রিয়ার উপর গুরুত্ব আরোপ এবং যুদ্ধ এলাকায় কিভাবে যুদ্ধ থামানো সম্ভব, সে বিষয়ে আমাদের পরামর্শ দেই। আবুধাবির শাসক পরিবারের সদস্য ম্যাঞ্চেস্টার সিটি মালিক জায়েদ আল নাহিয়ান ইউএই ও বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর মধ্যে সংযোগ দেখার দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি তুগোদ ও অন্য যোগাযোগ রক্ষাকারীদের কথা বলেন।
এদিকে কাতার আলোচনার জন্য তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে খার্তুমে পাঠাতে চাইলে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। বশিরের অপসারণের কয়েক সপ্তাহে তার পুরনো মিত্র হেমেদতি সুদানের সর্বাপেক্ষা ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি বর্তমানে সুদান শাসনকারী অন্তর্বর্তী সামরিক পরিষদের উপপ্রধান। সাবেক এ গবাদিপশু ব্যবসায়ী ২০০৩ সালে শুরু হওয়া দারফুর যুদ্ধের অন্যতম নৃশংস মিলিশিয়া কমান্ডার হিসেবে আন্তর্জাতিক কুখ্যাতি অর্জন করেন।
মানবাধিকার গ্রুপগুলো তার মিলিশিয়াদেরকে গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়া ও হত্যা-ধর্ষণের জন্য অভিযুক্ত করেছে। হেমেদতি এ সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন যেমনটি করেছে বশির সরকার। সালাহ গশ ১৩ এপ্রিল অন্তর্বর্তী সামরিক পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি বিক্ষোভকারীদের তুমুল গালমন্দের শিকার হন ও পদত্যাগ করার জন্য তার উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়। সালাহ গশ এখন কোথায় তা কেউ জানে না। তবে খার্তুমে তার বাড়ির চারপাশে নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।

গত ৩ জুন হেমেদতির সৈন্যরা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাইরে বিক্ষোকারীদের উপর গুলি চালিয়ে তাদের বিতাড়িত করে। বিরোধী চিকিৎসকরা বলেন, এ ঘটনায় ১০০ জনেরও বেশি নিহত হয়। সরকারি হিসেবে ৬২ জন নিহত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এরপর সৈন্যরা প্ল্যাকার্ড ও ব্যানারগুলো অপসারণ করে। এসবে লেখা ছিল- ‘আমরা মিসরের মত হতে চাই না’। ‘সউদী আরব-ইউএই সুদানে হস্তক্ষেপ বন্ধ কর’।

এদিকে বিবিসি জানায়, গত শুক্রবার সুদানের সামরিক বাহিনী ও বিরোধী নেতাদের মধ্যে একটি ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এ চুক্তি অনুযায়ী একটি স্বাধীন পরিষদের হাতে ক্ষমতা থাকবে। তিন বছর পর সুদানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তার আগে পর্যন্ত দুই পক্ষ পালাক্রমে করে দেশ চালাবে। চুক্তির পর বিরোধী জোটের নেতা ওমর আল দেগাইর বলেছেন, এ চুক্তি সুদানে এক নতুন যুগের সূচনা করবে। (শেষ)



 

Show all comments
  • Mohi Uddin ৭ জুলাই, ২০১৯, ১:২১ এএম says : 0
    চলে যেতে বাধ্য হলন আরেকজন স্বৈরশাসক। সুদানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশির। মিলিটারী ক্যু এর মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়ে ৩০ বছর যাবত সুলতানী করেছেন। পেশাজীবী ও মহিলাদের নেতৃত্বে শুরু হওয়া গণবিক্ষোভে অবশেষে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হলেন।
    Total Reply(0) Reply
  • Jomadder Mizan ৭ জুলাই, ২০১৯, ১:২১ এএম says : 0
    আগেই আলজেরিয়ার আবদেল আজিজ ব্লুতাফিকাকেও এভাবে ২০ বছর শাসনের পর চলে যেতে হয়েছিল। তবে, দুটো রাষ্ট্রেই সেনাবাহিনী হচ্ছে ক্ষমতার মূল কারিগর।
    Total Reply(0) Reply
  • সৌমিক আহমেদ ৭ জুলাই, ২০১৯, ১:২২ এএম says : 0
    সুদানের বিষয়টা এখনো ধোয়াশায় আছে। কেননা সুলতান বশিরের প্রতি আনুগত্যশীল নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সেনাবাহিনীর আরেকটি গ্রুপের সংঘর্ষ ঘটে। সেনাবাহিনীই দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম দখলে নেয়।
    Total Reply(0) Reply
  • Mirza Anik Hasan ৭ জুলাই, ২০১৯, ১:২২ এএম says : 0
    মুসলিম অধ্যুষিত জনপদগুলোতে পরিবর্তন আকাঙ্খাই সর্বত্র গণবিক্ষোভের মাধ্যমে বেরিয়ে আসছে। জনগণের মধ্যে প্রকৃত গণতন্ত্রের তীব্র আকাঙ্খা থাকা সত্ত্বেও এক স্বৈরশাসক প্রতিস্থাপিত হয়ে নতুন স্বৈরশাসক চেপে বসছে। আমরা নিজেরাও এখন এই ধরনের চক্রে পরে গেছি।
    Total Reply(0) Reply
  • গুলাম ৭ জুলাই, ২০১৯, ১:২২ এএম says : 0
    স্বৈরাচার চিরদিন থাকে না, থাকবে না, থাকতে পারে না। কিন্তু তারা যাওয়া অবদি জনপদের মানুষের জীবনযাত্রার ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব সৃষ্টি করে
    Total Reply(0) Reply
  • Abdur Rahim Belal ৭ জুলাই, ২০১৯, ১:২৩ এএম says : 0
    স্বৈরাচাররা বিপদে আছে!
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ