Inqilab Logo

সোমবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮ আশ্বিন ১৪৩১, ১৯ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

মেঘ যখন বৃষ্টি হয়

প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

তাহমিনা কোরাইশী
নিজেকে দর্পণে দেখেছে হাজার বার, কিন্তু গুণ ছাড়া দোষ খুব একটা ধরা দেয়নি তামান্নার চোখে। অবশ্য সাধারণত নিজের দোষ নিজের চোখ তো এড়াতেই পারে। মানুষ নিজেকে বড় বেশি ভালোবাসে। কিন্তু অন্যের সমালোচনায় ক্ষিপ্ত হয় মন। অবশ্য তামান্নার বেলায় কিছুটা ব্যতিক্রম তো বটেই। তুলনামূলকভাবে সর্বক্ষেত্রে সে অনেকটাই সহনশীল চরিত্রের। চাকরি জীবনের পুরোটা সময় কখনও কারো সাথে বিরোধে যায়নি এবং সংসারেও একই পন্থা অবলম্বনের চেষ্টা। কিন্তু কিছুটা অভিমান নিজের উপর আস্থার দৃঢ়তায়। কর্মঠ, খুব আত্মবিশ্লেষণে অহংকারী কিন্তু বিনয়ী। নিজের প্রশংসা করে আত্মতৃপ্তি পাওয়াটা মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু চাকরি জীবনের ইতি টেনে কেমন ডিপ্রেশনে কাটছে ওর জীবনটা। জীবনের পাতায় রং আনার চেষ্টায় ছেলেটার বিয়ের ব্যাপারটা ভাবছে। অবশ্য ছেলে চেয়েছে আরো কিছুটা সময় পার হোক। কিন্তু মা তামান্নার তড় সইছে না। ছেলে হাসিব সবেমাত্র পাস করে মোটামুটি গোছের একটা চাকরি নিয়েছে। বাইরে গিয়ে এমবিএ করারও ইচ্ছে ছিল। মায়ের এই পুতুল খেলার শখের কারণে হয়ে ওঠেনি। আর তামান্নার মেয়ে অন্নি বেশ ছোট্ট, মানে ইন্টারমিডিয়েট পড়ছে। বাধ্য ছেলে মাকে খুশি করার জন্য আর প্রতিবাদ করেনি। পাত্রী দেখার তোড়জোড় চলছে। পছন্দসই গহনার অর্ডারও দেয়া শেষ। কত যে জল্পনা-কল্পনা, কী দেবে কী করবে। সাধ তো আকাশ ছুঁই ছুঁই, সাধ্যের কড়ি তো হাতেগোনা। তবুও সাধ্যের বেশি করার চেষ্টা। একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা। অনেকেই ওর এই আদিখ্যেতা দেখে সাবধান করেছে। বলেছেÑ হাসিবের মা, শুধু কি ও তোমার একটাই ছেলে আরো একটা মেয়ে আছে না। ওকে গুছিয়ে দিতে হবে না? ভেবে চিন্তে খরচ করো। অনেক আশার স্বপ্ন বোনে অন্যের পরামর্শ আজ তামান্নার কাছে কাঁটার মত বিঁধছে। এমন তো ছিল না তামান্না। কী জানি কী নেশা পেয়ে বসেছিল ওকে। বলেছে, ছেলেও আমার মেয়েও আমার। দুজনকে সমানভাবেই দেবো এবং করবো। তাই বলে যে মেয়েটা আমার ঘরে আসবে, নিজের বলে জানবে তাকে আনন্দে আহলাদে বরণ করে নেবো না? মেয়েরা সব জায়গাতেই নিগৃহীত। তাই নারীবাদী মনটাকেই প্রশ্রয় দিয়েছে। চাকরি করে জেনেছে ধাপে ধাপে ছেলে-মেয়েদের বৈষম্য। তাই ছেলে বউকে যতটুকু গহনা দেবে মেয়েকেও ততটুকুন দেবে মন স্থির করে ফেলে তামান্না। তামান্না তার স্বপ্নের জাল বুনে চলে।
এ ঘর তামান্নার ভুবন। তারই হাতের ছোঁয়ায় পরিপাটিভাবে সাজানো। এর মধ্যে আরো একটা সংসার জন্ম নিতে যাচ্ছে। সে কি এই সংসার তার নিজের বলে জানতে পারবে? ওকে ভাবনায় পেয়ে বসে। আজকাল অনেক ঘরেই দেখা যায় সমস্যা। তামান্না মনে ঠায় ধরে নিয়েছে ওর সাথে কোন সমস্যাই হবে না। ও তো এমন শাশুড়ি হতে চায় না। সর্বদা ওকে কৈফিয়ত দিতে হবে। ওর মত শাশুড়ি পেয়ে যে কোন মেয়ে ধন্য হবে। তবুও মাঝে মাঝে মনে হয়েছে বিপরীতও তো হতে পারে। কথায় বলে, অতি রাঁধুনী না পায় ঘর, অতি সুন্দরী না পায় বর। তবুও একটা আত্মপ্রত্যয় দৃঢ় তামান্নার মনোবল ভাবনায় পেয়ে বসে। এই সেদিন ওর পাশের বাড়ির শাপলার বিয়ে ভেঙে গেলো। মাত্র ছয় মাসের সংসার। এই ছয়মাস এতটুকুন সময় কে কাকে কতটুকু বুঝেছে? শাশুড়ি শ্বশুর বউ ছেলে কতটুকুন সহানুভূতি পূর্ণ ছিল বা যতœবান ছিল এই সংসার টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে। চলছে শটকার্ট ফর্মূলাÑ এডজাস্ট হচ্ছে না, তাই ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো। তামান্না এর ঘোর বিরোধিতা করে। সময়ই সমাধানের মলম এতেই সেরে উঠতে পারে সবকিছু। যদিও এই সমস্যা চিরন্তন। নারীর সাথে নারীর দ্বন্দ্ব সে তো চিরকালীন।
তেমন নারী তো তামান্না নয়। আজকাল যেটা সচরাচর চোখে পড়ে তা হলো নিজের সংসার। প্রায় সব মেয়েই চায় তার নিজের একটা ছোট্ট সংসার। শ্বশুরবাড়িতে স্বাধীনতার অভাব। কিন্তু তবুও সবাই মিলে যে সংসার তাতেও সুখ কম না। অন্যকে সুখ দিতে নিজের আত্মতৃপ্তি মেলে। অনেক অংশে অনেক ধরনের সুবিধাও পাওয়া যায়। যেটা তামান্না পায়নি। সন্তান তার দাদা-দাদীর নির্মল আনন্দে বেড়ে ওঠে। চাকরিজীবনে এই কষ্টটা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে তামান্না। কেউ ছিল না ওর সংসার জীবনে মাথার ওপর। কাজের লোকের হাতেই ছেলেমেয়েকে ছেড়ে দিতে হয়েছে। তামান্না বঞ্চিত হয়েছে এই সুখ থেকে। ওর স্বামী আনিসের বাবা-মা ওকে ছোট্ট রেখে চলে গেছেন পরপারে। বড় ভাই-বোনদের কাছেই মানুষ। তেমন জমজমাট সংসারে থাকার সৌভাগ্য হয়নি। আনিস আর তামান্না তাই চায় সবাইকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে। ক্যালেন্ডারের পাতায় দিন চলে যায়। আহ্লাদে মন নাচে। শুভক্ষণে তাদের বিয়ে হয়। ঘরে বউ আসে। সে ভালোবাসার কাঙ্গাল। নিজের মেয়ের মতই জেনেছে ছেলের বউকে।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। উদারতার প্রমাণ দিয়ে ঘরে তুলেছে যাকে তার সাথে সম্পর্ক এমনটি হবে ভাবতেও পারেনি তামান্না। সনাতন কলহ থেকে বেরিয়ে থাকতেই চেয়েছিল। পারেনি। যত নতজানু হয়েছে ততই নইয়ে গেছে সংসার। আনিস জানে তামান্না অহেতুক অহেতুক ঝামেলা বাধানোর মত মহিলা না। পরিস্থিতি এমনই কদর্য হয়েছে শব্দের বিষাক্ত ধোঁয়ায়। মনে হলেই আঁতকে ওঠে তামান্না। আশার স্বপ্নে বোনা দিনগুলো ধূলিতে গড়াগড়ি যায়। ইচ্ছে করেই আনিস তামান্নাকে দোষী করে ছেলের বউ স্বাতীকে প্রশ্রয় দিয়েছে কিছুটা সুখের আশায়। আনিসও চায়নি আগুনের শিখা আকাশ ছুঁয়ে যাক। তাতে আর তেল ঢালার সুযোগ নেই।
এমনভাবে দিনগুলো বছর মনে হয় ওদের কাছে। এমন দিনের সাথে ওদের পরিচয় ছিল না। ওদের চিন্তার সাথে বাস্তবতার কোন মিল খুঁজে পায় না। নীরবতা আলিঙ্গন করেছে ঘরের প্রত্যেকটি মানুষকে। সুনসান গুমট পরিবেশ। হৃদয়ের ভেতরে ঝড় থামানোর কেউ নেই। জনে জনে এইসব কথা প্রচারে নিজেকে অপমানিত করতে চায় না। সময়ের মলম সময়েই কাজ করবে এই বিশ্বাসে থাকে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় বের করলো আনিস ও তামান্না। ওরা দূরে থাক। সংসার আলাদা হয়ে যাক। তামান্নার ছেলে হাসিব মৃদুভাষী, ভদ্রগোছের ছেলে। সে জানে না সংসারের মারপ্যাঁচ। শুধু বড় বড় দুটো চোখ কী যেনো বলে যেতে চায়। ওর মনের ঝড়ের ভাষা হারায় সম্ভ্রমের দেওয়ালে। নিজ গতিতে ফিরে আসে নিজ বলয়ে। কাকে কী বলবে, মা নাকি বাবাকে না স্ত্রীকে? বিশ্বাসের স্থান গড়ে দিয়েছিলেন যে বাবা-মা, কোলের কাছে যতনে বড় করেছেন যারা তার সুখ চায় তাদের বিরুদ্ধে কিছুই বলার নেই। নীরবেই অশান্তির বোঝা বয়ে চলে যায় দূরে। অন্য কোথায় অন্য কোন নীড়ে। তামান্না নিজেকে সামলে নেয় সকল আপদ-বিপদ থেকে।
প্রথমটায় ওরা বুঝতে পারেনি। মেয়েটি যার নাম স্বাতী ওর নিজের কিছু সমস্যা ছিল। ছোটবেলায় বাবা-মা হারিয়েছে। ভাইয়ের কাছে মানুষ। হয়তো ভাবীর কাছ থেকে জীবন গড়ার ব্যাপারে কোন প্রকার সহযোগিতা পায়নি। সব কাজেই ভাবীকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবেছে। দ্বৈত সত্তার জন্ম নিয়েছে। কখনও খুব ভালো কখনও ভীষণ ডিপ্রেশনে থাকে। ছোটবেলার সমস্যাÑ না পাওয়ার যন্ত্রণা। তামান্না দুহাত বাড়িয়ে চেষ্টা করেছে কিন্তু সমাধান পায়নি। যদি কেউ নিজে থেকে সমর্পণ না করে তাকে তো জোর করে কিছু করানো যায় না। ভালো শব্দের অর্থ মন্দই জানবে সে।
এমন সাজানো সংসার এভাবে ভেঙে গেলো। ফুলগুলো ছড়ানো ছিটানো এদিক ওদিক নিজের সম্ভ্রমের কথা ভেবেই আর স্বাতীর আলোচনা সমীচীন মনে করেনি। যদি ও সমর্পণ করতো তামান্নার কাছে তবে জীবনের মোড় অন্যরকম হতে পারতো। তামান্না টেনে নিতো স্বাতীর দুঃখগুলো। আগলে রাখতো স্বচ্ছন্দের দোলনায় এই দুইহাতে। না, ওর ইগোতে বেধেছে হয়তো বা ভাবতে শেখেনি মা বাবা কত বড় সম্পদ। তাদের কাছে যেমন আছে দাবি তেমনি আছে পরম সুখের আশ্রয় স্থল। বাবা-মা বা শ্বশুর-শাশুড়ির সাথে কোন প্রতিযোগিতার বিষয় জড়িত নেই। সন্তানের মঙ্গল তাড়িত করে সর্বদা তাদের অন্তর। হাসিব সব সময়ই অল্প কথা বলে। কিছুটা মুখচোরাও বলা যায়। মায়ের কোল ঘেঁষা ছেলেটা আজ মায়ের চোখে চোখ মেলাতে পারেনি। ছলছল আঁখি বোবা দৃষ্টি কত কিছু বলে গেলো তা সবই তামান্না বুঝেছে শব্দের নয়, অন্তরের ভাষায়।
থাকো সুখে অন্য বাসায়। সময় সুযোগে এসো নতুবা নয়। তামান্না বুকে পাথর চাপা দেয়। ওর গড়া পৃথিবী ওকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়। সহ্যের সীমানায় শুধু আজ যুদ্ধ যুদ্ধ। সংসার টিকিয়ে রাখাই যখন মুখ্য তখন মৌচাকে আর কেন ঢিল ছোড়া? গ্রহণে যদি আগুন অতিমাত্রায় বেড়ে যায় তবে তাকে বর্জনই শ্রেয়। সান্ত¡না তামান্নার- দূরে থাকো। সুখে থাকো। তোমরা কখনও বলো না একা একা মনে হয় এ জীবন বড় বেশি। তখন আশেপাশে কাউকে পাবে না। সুখেই বলো আর দুঃখেই বলো। সময়ের সাথী সময়ে থাকে। সাধা লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে নেই।
তামান্না চেয়েছিল স্বাতীকে একলা আকাশে রাখবে না। পৃথিবীর মেলাতে সাজাবে যতনে। ছেলে যেমন আপন রক্তের সেই রক্তের সাথে যার সম্পর্ক সেও কি কখনও পর থাকে? স্বাতীকে কল্প রাজ্যে থেকে এনে মাটির পৃথিবীর ভালোবাসার গল্প বলবে হাসিব-স্বাতীর সন্তান সীমান্তকে শেখাবে ভালোবাসার ছড়াগান। আকাশের চাঁদ এনে কপালে টিপ পরিয়ে দেবে। আধো আধো বোলে ওরা আবার বিস্মৃত অতীতে ফিরে যাবে সীমান্তর সাথে।
হাঁটি হাঁটি পায়ে দোল খেয়ে হাঁটা পথে চেয়ে আনন্দে তারা গুনবে। সমস্ত আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেছে ওদের স্বাতী। নাতনী সীমান্ত ওদের থেকে দূরে। হাত বাড়ালেই কিছু আসে না হাতে। মন চাইলেও সংসারে রূঢ় বাস্তবতা তা হতে দেয় না। ঘুড়ি নাটাই ওদের হাতে। ছিনিয়ে নিতে জানে না। সেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হৃদয়জুড়ে শুধু হাহাকার। শব্দের দীর্ঘশ্বাস ওড়াউড়ি করে এই ঘরময়। তামান্নার জানা নাই অনেক কিছুই। অতি সহজেই সব কিছু গ্রহণে অভ্যস্ত এমনই একটা নির্মল মন আজ উদাস হয় চোখের তারায়। ভালোবাসার বিশ্বাসের আধার নষ্ট হয়ে যায়।
কেউ কেউ কারো কাছে অধরাই রয়ে যায়। জীবন বহতা। বয়েই যাবে নিরন্তর।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মেঘ যখন বৃষ্টি হয়
আরও পড়ুন