বর্ষপূর্তির কবিতা
ভালোবাসো মন খুলেআ ল ম শা ম সবৈশাখী ঝড়ে উড়ে গেছে চালবর্ষার বৃষ্টিতে ডুবে গেছে ঘরভাদ্রের বন্যায় ভেসে গেছে বাড়ি।তুমি শুধু একা।ভয় শংকায় হারিয়ে গেছে
॥ মিজানুর রহমান তোতা ॥
শুধুমাত্র দেশ ও জনগণের পক্ষের মুখপত্র দৈনিক ইনকিলাবের জন্মদিন উপলক্ষে ইতোপূর্বে বহুবারই লিখেছি আমার নিজের পেশার বিষয়াদি। এবার ভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখবো চিন্তা করছিলাম। এরই মধ্যে একজন নদী বিশেষজ্ঞের সাথে এক আড্ডায় কথা হলো। তিনি নদী পানি আবহাওয়া নিয়ে অনেক কথা বললেন। ষড়ঋতুর পরিবর্তন ঘটছে কেন তার ব্যাখ্যা দিলেন। বিষয়বস্তুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হলো। যে অঞ্চলে আমার বসবাস ও মাঠ সাংবাদিকতা। সেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল নদ-নদীর মৃত্যুমুখে পড়ার কাহিনী নিয়ে অনেক রিপোর্ট করেছি দৈনিক ইনকিলাবে। অঞ্চলটির কৃষি শিল্প ব্যবসা বাণিজ্যের কি ক্ষতি হচ্ছে, কতটা প্রভাব পড়ছে জীবন-জীবিকায় তা তুলে ধরেছি। ভাবলাম এটি নিয়ে বিস্তারিত লেখালেখি দরকার। তাই কলম চালানো।
সবাইকে গভীরভাবে চিন্তা করতে বলবো। আমরা আসলে কতটা ভয়াবহ বিপদের মধ্যে পড়তে যাচ্ছি। ভাবলে চমকে ওঠার মতো। কারণ ক্রমাগতভাবে চরম হচ্ছে গ্লে¬াবাল ওয়ার্মিং-এর বিপদ। কার্বন ডাই-অক্সাইড যা গ্রীন হাউজ গ্যাস আবহাওয়ায় তৈরি করে একটা আস্তরণ যাতে পৃথিবীর তাপ বিকীর্ণ হতে পারে না দূরাকাশে। একইভাবে নদ-নদীর প্রবাহ বিঘœতা ও সমুদ্রের পানির উচ্চতা জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটায়। এক্ষেত্রে অভিন্ন নদী শাসন বাংলাদেশের বিশাল এলাকার জীবন-জীবিকার উপর বড় ধরনের আঘাত দিচ্ছে তা কমবেশি সবাই অনুধাবন করতে পারছেন। কিন্তু এটি নিয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না বলে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। দিনে দিনে সমুদ্রে পানির উচ্চতা বাড়ছে। জলবায়ু ও ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তনে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতিবছর উপকূলীয় অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। নদী ভাঙনে সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসছে বহু মানুষ। ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে অপূরণীয়। পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদ-নদীর তলদেশ পলি জমে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এতে বর্ষা মৌসুমে বন্যা আর শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য পড়ছে হাহাকার। তবুও বিষয়টির কোন সুরাহা করার ব্যাপারে উদ্যোগী হতে দেখা যাচ্ছে না। ততটা উচ্চবাচ্যও হচ্ছে না। বিচ্ছিন্নভাবে একেবারে ছোট পরিসরে মাঝেমধ্যে প্রতিবাদ হয়। আর ফারাক্কা লংমার্চ দিবসে হয় গণসমাবেশ। এবারও হয়েছে। মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দল-মত নির্বিশেষে রাজশাহীর পদ্মা পাড়ে গণসমাবেশ থেকে ভারতের পানি আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তোলা আহ্বান জানানো হয়। মাঝেমধ্যে বাদ-প্রতিবাদে উল্লেখযোগ্যরা হল পরিবেশ সুরক্ষায় উপকূলীয় জোট। জোট সূত্র জানায়, বাংলাদেশের গড়াই-মধুমতি, নবগঙ্গা, ইছামতি, মাথাভাঙ্গা, কপোতাক্ষ, বেতনা নদীসহ সুন্দরবন, পরিবেশ, কৃষি, সুপেয় পানি, জীব-বৈচিত্র্য ধ্বংসকারী, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র নদীর পানির প্রবাহ নষ্টকারী ভারতের আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প (আইআরএলপি) বাতিলের দাবিতে পরিবেশবাদী সংগঠন ও ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি জোরালো প্রতিবাদ করে আসছে। কিন্তু কোন ফল হচ্ছে না। ফারাক্কা আর মিনি ফারাক্কাসহ অভিন্ন নদীর পানি প্রতিবন্ধকতা চলছেই। শুষ্ক মৌসুমে এর মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয় ভারত। বছরের পর বছর ধরে পানি প্রত্যাহারের প্রভাব ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।
সম্প্রতি এক সাংবাদিক বন্ধু বেড়াতে যান দার্জিলিং। ফারাক্কা ব্রিজ পার হবার সময় তার নজরে পড়ে ব্রিজের নিচে এপার আর ওপারের বিপরীত চিত্র। একদিকে পানি থৈ থৈ করছে। অন্যদিকে পানি নেই। তার সফরসঙ্গীরা অবাক হলেন। তিনি মোবাইলে ছবি তুললেন। ফেসবুকে লিখলেন ফারাক্কা ব্রিজের নিচে পদ্মার বুকে বাংলাদেশ অংশে সামান্য পানি পড়ছে চুইয়ে চুইয়ে। অথচ ভারতের অংশে পানিতে সয়লাব। যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। তার ওই লেখায় মুহূর্তে অসংখ্য ব্যক্তি কমেন্টস করেন। একজনের কমেন্টস- ‘ভাটির দেশ বাংলাদেশকে ভারত মরুভূমি বানাচ্ছে, আরেকজনের ওপারে পানিতে ডুবে গেলেও জিদের কারণে এপারে পানি দেবে না ওরা।’ আসলেই পদ্মা দিয়ে পানি আসছে চুইয়ে। গঙ্গানির্ভর সিংহভাগ নদ-নদী দিনে দিনে পরিণত হয়েছে মরা খালে। নদীদেহ নিথর হয়ে পড়ে আছে। কোন প্রাণ নেই। করছে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট।
পানি প্রতিবন্ধকতার সাথে কার্বন নিঃসরনে দ্রুত বদলে যাচ্ছে আবহাওয়া। ঘটছে ষড়ঋতুর পরিবর্তন। গড়পড়তা তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি বাড়ছে। বাড়ছে মরুকরণ। আবহাওয়ার অস্বাভাবিক আচরণে পরিবেশবিদগণ উদ্বিগ্ন। তাদের কথা, মারমুখী ও বিপজ্জনক হচ্ছে পরিবেশ। এতে কৃষি, মৎস্য সম্পদ, পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে। সংশ্লি¬ষ্ট বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানীদের কথা, এমনিতেই কার্বন নিঃসরণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে। তার ওপর অভিন্ন নদ-নদীর পানি প্রতিবন্ধকতায়ও গড় উঞ্চতা উদ্বেগজনকহারে বৃদ্ধি পেয়ে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, উত্তর ও পূর্বাঞ্চল এবং মধ্যভাগসহ গোটা বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যে নেমে আসছে ভয়াবহ বিপদ। জলবায়ু ও ভূ-প্রকৃতির পরিবর্তন যে হারে ঘটে চলেছে তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে উপায় নেই। দেশের নদ-নদীর পানি বঙ্গোপসাগরে পড়ার স্বাভাবিক ধারা হয়েছে অস্বাভাবিক। স্রোতহীন নদীর পানি একরকম চুইয়ে পড়ার মতো অবস্থার কারণে লবণাক্ততা গ্রাস করছে। ভূমি গঠনেরও পরিবর্তন ঘটছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লি¬ষ্ট বিভাগ ও নদী বিশেষজ্ঞদের মতে, বঙ্গোপসাগরের সাথে যুক্ত সুন্দরবনের নদ-নদীর পানির প্রবল তোড় কমে গেছে। নদ-নদী স্রোতহীন হওয়ার কারণে মারাত্মক উত্তপ্ত হচ্ছে সমুদ্র। পৃথিবীর অনন্য সম্পদ সুন্দরবনের বনভূমি বিপদের সম্মুখীন। উদ্ভিদ জীব-বৈচিত্র্য, পরিবেশ ও উপকূলীয় অঞ্চল চরম হুমকিতে পড়েছে।
সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সিডর ও আইলার মতো প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসও হচ্ছে ঘনঘন। পানি বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, নদীমাতৃক বাংলাদেশের অধিকাংশ নদী ও জলাশয়গুলো শুকিয়ে গেছে। মাটিরতলার পানি সম্পদ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে। অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর সংস্কার কিংবা খননের ব্যবস্থা নেই। গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্পও মুখ থুবড়ে পড়েছে। গড়াই, কপোতাক্ষ, বুড়িভদ্রা, ভৈরব, চিত্রা, নবগঙ্গা, মুক্তেশ্বরী ও মধুমতিসহ অসংখ্য নদ-নদীর পানির উৎস অভিন্ন নদ-নদীর। এসব নদ-নদীতে মাইলের পর মাইল চর জেগেছে। পদ্মার শাখা নদ-নদীর অবস্থা খুবই করুণ। যার কারণে উর্বর জনপদ হুমকির মুখোমুখি। সবুজ ঘেরা প্রান্তর হচ্ছে বিবর্ণ। দক্ষিণ-পশ্চিমের এক সচেতন ব্যক্তি একটি নদীর শুকিয়ে যাওয়া চিত্র তুলে ধরে তীব্র প্রতিক্রিয়ায় বললেন, ‘বছর বিশেকের ব্যবধানে নদ-নদী পরিণত হয়েছে খালে। এই যে দেখছেন প্রায় নদীর পাড় পর্যন্ত পানি থৈ থৈ করতো। ছিল জোয়ার ভাটা। এখন পানি পাওয়া যায় না তলানিতেও। কি যে হলো আস্তে আস্তে নদী মরে যাচ্ছে। নদ-নদীর চেহারা দেখলে যে কারো মায়া হবে, কষ্ট লাগবে। কষ্ট লাগে না কেবল ভারতের। ভাটির দেশ বাংলাদেশকে ভারত পরিকল্পিতভাবে মরুভূমি বানাচ্ছে। তবুও কোন প্রতিবাদ নেই। গানের কলির মতো আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম, আমার বলার কিছুই ছিল না পরিস্থিতি এমনই। কতটা ভয়াবহ অবস্থা তা শুষ্ক মৌসুমে নদ-নদীর দিকে তাকালে পানি দেখা যায় না। তবে চোখে পানি আসে।’
নদীই জীবন। মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন। মানুষের জীবন, কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, সভ্যতা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, জীব-বৈচিত্র্য, বনজ, মৎস্যসম্পদ, পরিবেশ রক্ষা ও সামগ্রিক উন্নয়নে নদ-নদীর ভূমিকা প্রধান। রক্তের শিরা-উপশিরার মতো বাংলাদেশের নদী ধাবমান। মানুষের জীবন, অর্থনৈতিক কর্মকা-, সভ্যতা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সাথে বলিষ্ঠ ও নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে নদ-নদীর। নদীদেহের অন্যতম হৃদপিন্ড পদ্মা এখন স্পন্দনহীন। পদ্মার বুকে শুরু হয়েছে হাহাকার। কান্না থামছে না। কাঁদছে পদ্মার সব ক’টি শাখা নদ-নদী। শাখা-প্রশাখার উৎসমুখ গড়াইয়ে পানি গড়িয়ে আসছে না পদ্মা থেকে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টের দৃশ্য তা রীতিমতো ভয়াবহ। পায়ে হেঁটে এখন বিশাল পদ্মা পার হওয়ার অবস্থা দাঁড়িয়েছে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতুর দু’দিকে যতদূর চোখ যায় শুধু শুধু বালু আর বালু। মাঝখান দিয়ে সরু খাল ও নালার মতো কোনরকমে চুইয়ে পানি প্রবাহ হচ্ছে। সে যেন শূন্যের গভীরে অণু। প্রায় পানিশূন্য অবস্থায় বালুচরের ওপর কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হার্ডিঞ্জ ব্রিজটি। ১৯১৫ সালে যখন বিশাল পদ্মায় ভেড়ামারা-পাকশীতে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ নির্মিত হয়েছিল, তখন গর্জনী স্রোত ছিল। দু’কূল জুড়ে পানি ছিল টইটম্বুর। ফারাক্কার কারণে পদ্মা আজ মৃত্যুর মুখে। অবস্থা যেদিকে যাচ্ছে তাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো প্রশ্ন ছুড়ে বসবে বিশাল ব্রিজ তৈরির প্রয়োজনীয়তা কি ছিল। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ও লালন শাহ সেতুর উপর একদ- দাঁড়িয়ে পদ্মার বর্তমান চেহারা দেখলে যে কারোরই প্রাণ কেঁদে উঠবে। পদ্মার জীবন-যৌবন হারিয়ে গেছে। আর কখনো ফিরে আসবে কিনা সন্দেহ। নদপাড়ের মানুষের কথা, পদ্মার চেনা চেহারা দ্রুত বদলে গেল, চোখের সামনেই ধুকে ধুকে মৃতপথযাত্রী হল, এখন অপেক্ষার পালা পদ্মার মৃত্যু হতে আর কত বাকি। বিশাল পদ্মায় ঢেউ নেই। কখনো আর কেউ আগেকার মতো ঢেউ দেখতে পাবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। পদ্মার জীবন-যৌবন হারিয়ে গেছে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্ট ছাড়াও রাজশাহী এলাকায় শীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে পদ্মা। ভারত আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে পানি প্রত্যাহারের ফলে পদ্মার এই হাল হয়েছে। শুধু আইন লংঘন নয়, দু’দেশের পানি চুক্তিও লংঘন করেছে।
শুধু পদ্মা নয়, পদ্মার শাখা নদ-নদী মাথাভাঙ্গা, গড়াই, ইছামতি, ভৈরব, আপার ভৈরব, কুমার, মধুমতি, ফটকি, বেতাই, চিত্রা, কপোতাক্ষ, নবগঙ্গা, ইছামতি ও কোদলাসহ অর্ধ শতাধিক নদ-নদীর প্রবাহ নির্ভরশীল অভিন্ন নদীর ওপর। ফারাক্কা ছাড়াও মিনি ফারাক্কার ধাক্কায় কাহিল অবস্থা অভিন্ন নদ-নদীর।
একটি উদাহরণ দিলেই পদ্মার আগের অবস্থা জানা যাবে। পদ্মা নদীর পূর্ব তীরে সাঁড়াঘাট ছিল দেশের অন্যতম বৃহৎ নদী বন্দর। সেই সময় দেশী-বিদেশী বড় বড় স্টীমার, লঞ্চ, বার্জ ও মহাজনী নৌকা ভিড়তো সাঁড়াঘাট বন্দরের ১৬টি ঘাটে। বিদেশী পর্যটকের ভিড় থাকতো অনেক। পরবর্তীতে অবশ্য যাতায়াত ও পণ্য পরিবহনের বিরাট সুবিধা করে দেয় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ। তখনকার পদ্মা আর এখনকার পদ্মার মধ্যে রয়েছে বিশাল পার্থক্য। পদ্মারপাড়ের কয়েকজন বৃদ্ধ বললেন, তখন ব্রিজের ওপর দিয়ে পারাপারের সময় পদ্মার ঢেউয়ের তোড়ে সবারই বুক কেঁপে ওঠতো। নতুন করে প্রমত্তা পদ্মার রূপ আর কখনো দেখা যাবে এমন আশা বহু আগেই ক্ষীণ হয়ে গেছে। পদ্মাপাড়ের বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের কথা, ভারত আন্তর্জাতিক নদী গঙ্গায় ফারাক্কা পয়েন্টে বাঁধ নির্মাণ করে নিজেদের স্বার্থে। যেটি বাংলাদেশের মানুষের মনে গভীরভাবে দাগ কাটে। বিশাল পদ্মা পায়ে হেঁটে পার হওয়া যাবে অতীতে কেউ কখনো ভাবেননি। বাস্তবে সেটিই হচ্ছে। পদ্মার ন্যায্য হিস্যার পরিমাপ করা হয় হার্ডিঞ্জ পয়েন্টে। সেখানে পানি প্রবাহ নেই বললেই চলে। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের মোট ১৫টি স্প্যানের মধ্যে ১৩টিই এখন পুরোপুরি পানিশূন্য। ২টি স্প্যানেও যা পানি আছে তা দেখে মনে হয় না নদী, একেবারে খালে পরিণত হয়েছে।
ভারত সব ক’টি অভিন্ন নদ-নদীর উজানে বাঁধ, গ্রোয়েন ও পাথর ফেলে পানি নিয়ন্ত্রণ করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। নদ-নদীর কঙ্কালসার চেহারা তার প্রমাণ। তাদের নিষ্ঠুর আচরণে নদ-নদীর মৃত্যু হচ্ছে। কার্বন নিঃসরণ, অভিন্ন নদীর পানি প্রতিবন্ধকতা ছাড়াও বনভূমি উজাড় ও বৃক্ষনিধন আবহাওয়া-জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যাকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পাশাপাশি মানবসৃষ্ট বিপর্যয় আজ বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। পরিবেশের সমস্যা গোটা পৃথিবীকে দারুণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। পরিবেশ সংরক্ষণে সবাই যতœবান হয়েছে। অতীতে হাজার বছর ধরে পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায়নি, আজকে যা দেখা যাচ্ছে। পৃথিবী জুড়েই জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। যার মূল কারণ তাপমাত্রা বৃদ্ধি।
বর্তমানে সচেতন প্রতিটি মানুষ অভিন্ন নদ-নদীর প্রতিবন্ধকতায় দারুণভাবে উদ্বিগ্ন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা প্রকাশ ছাড়া কিছুই করার নেই তাদের। নদী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে-ফলে নদীকে বাঁচাতে অভিন্ন নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে বাংলাদেশকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানানো হলেও খুব একটা তৎপর হতে দেখা যায় না। যার কারণে আবহাওয়ার পরিবর্তনে ক্রমেই মানুষের জীবন-মরণ সমস্যা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশদ ব্যাখা দেয়া না গেলেও বলা প্রয়োজন যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের অবস্থা একেবারেই কাহিল হয়েছে। ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রতীক সুন্দরবন এখন বিপর্যস্ত। প্রতিবছর একাধিকবার সমুদ্র উত্তাল হয়ে বড় ধরনের ধাক্কা দিচ্ছে। বুক পেতে ধাক্কা সামাল দিতে দিতে একেবারেই দুর্বল হয়ে পড়েছে সুন্দরবন। নিকট-অতীতের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর ও জলোচ্ছ্বাস আইলা ছাড়া এমন কোন বছর নেই যে ছোট-বড় আঘাত আসে না সুন্দরবনের উপর। প্রাকৃতিক ঢাল সুন্দরবনের উন্নয়নে পদক্ষেপও লক্ষ্য করা যায় না। সুন্দরবনের নদী রায়মঙ্গল ও আড়পাঙ্গাসিয়াসহ ছোট-বড় দেড় সহস্রাধিক খাল ও নালা রয়েছে। যা সংস্কার কিংবা খনন করা হয় না। সে জন্য পানি কমবেশি থাকলেও তা নিথর হয়ে আছে। কোন নড়াচড়া নেই। নদীর কিনার দেখলে স্পষ্ট বুঝা যাবে পানি কি পরিমাণ ছিল আর এখন কি পরিমাণ আছে। আসলে বঙ্গোপসাগরের কোলঘেষা সুন্দরবনকে বাঁচানোর পরিকল্পনা উল্লেখযোগ্য নয়। সুন্দরবনে আগের মতো বাঘের হুংকার ও দাপাদাপি নেই। কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে মায়াবী হরিণের ছুটোছুটি। বনজ ও জলজপ্রাণী এবং নানা প্রজাতির পাখির কলতানও থেমে গেছে অনেকটা। সুন্দরী. গেওয়া, শাল, কেওড়া, বাইন, কাকড়া, পশুর, ধন্দুল ও গোলপাতাসহ উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী গ্রীন বেল্টও ক্ষতিগ্রস্ত। বিশেষ করে সিডর ও আইলার পরপর দু’টি ধাক্কা সামাল দিতে গিয়ে মেরুদ- ও দেহ নিস্তেজ হয়ে গেছে সুন্দরবনের।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের কোলে অবস্থিত সুন্দরবন। ভারতের ২৪ পরগনার দক্ষিণ ভাগও সুন্দরবন। পশ্চিমে ভাগীরথি নদীর মোহনা থেকে পূর্বে মেঘনার মোহনা পর্যন্ত সুন্দরবন বিস্তৃত। সংশ্লি¬ষ্ট সূত্রমতে, ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত সুন্দরবনের ৪ হাজার ১৪৩ বর্গকিলোমিটার ভূ-ভাগ আর ১ হাজার ৮৭৪ বর্গকিলোমিটার জলভাগ। সংশ্লিষ্টদের সূত্রমতে, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল ক্রমাগতভাবে ডুবে যাচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, সাপ, শূকর, বানর, কাঠবিড়ালি, বাজপাখি ও শকুনসহ বিভিন্ন পশু-পাখি বিলুপ্তির পথে। সবচেয়ে যে বিষয়টি মহা বিপদ ডেকে আনছে তা হচ্ছে কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুম-লে নিঃসরণ কমাতে যে গাছ প্রধান ভূমিকা পালন করে সেই গাছ প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাত ও গাছ সাবাড় করাসহ নানা কারণে কমে গেছে সুন্দরবন থেকে।
সুন্দরবন সংশ্লিষ্ট সূত্র আরও জানায়, সমুদ্রের পানির উচ্চতা ও লবণাক্ততা বৃদ্ধি, ঘন ঘন ছোট-বড় সাইক্লোন, নদ-নদীতে পলি জমে সিলটেশন হওয়া, জলবায়ুর পরিবর্তন ও গাছপালা মারা যাবার কারণে দীর্ঘদিন ধরেই সুন্দরবন মারাত্মক হুমকির মুখে। এর থেকে উত্তরণের পথ কি তাও কখনো খুঁজে দেখা হয় না। প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা মূল্যবান গাছ পরিচর্যার কোন ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা আয় হচ্ছে সুন্দরবন থেকে। গাছ কাটা, মাছ ধরা ও মধু আহরণসহ সুন্দরবনকে ঘিরে অসংখ্য উপকূলীয় মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। অযতœ ও অবহেলায় সুন্দরবন টিকে আছে। বারবার ভয়াল প্রাকৃতিক থাবায় হাজার হাজার উপকূলবাসীকে পথে বসাচ্ছে। বিধ্বস্ত করছে উপকূলের গ্রাম-জনপদ। এখনো সিডর ও আইলার আঘাতের চিহ্ন শুকায়নি উপকূলবাসীর। একথা বলতে দ্বিধা নেই, অনেকক্ষেত্রে সুন্দরবন ‘লুটপাটের খনি’ হিসেবে অনেকের কাছে আশীর্বাদ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সামদ্রিক মৎস্যসম্পদের আবাসস্থলও ক্ষতি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনে। একই কারণে সুন্দরবনের শুঁটকির গন্ধের সাথে মাঝেমধ্যেই লাশের গন্ধে একাকার হচ্ছে। মুহূর্তে থেমে যায় জীবনযাত্রা। ঘটে মানবিক বিপর্যয়।
লেখক ঃ দৈনিক ইনকিলাবের বিশেষ সংবাদদাতা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।