বর্ষপূর্তির কবিতা
ভালোবাসো মন খুলেআ ল ম শা ম সবৈশাখী ঝড়ে উড়ে গেছে চালবর্ষার বৃষ্টিতে ডুবে গেছে ঘরভাদ্রের বন্যায় ভেসে গেছে বাড়ি।তুমি শুধু একা।ভয় শংকায় হারিয়ে গেছে
ফাহিম ফিরোজ
দৌলতগঞ্জ এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সকল গঞ্জের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তির স্পট। আলোচিত দৌলতগঞ্জের পূর্বনাম ছিল ‘গঞ্জে শাহরিয়ার’ নামের এক ব্যবসায়ীর নামে। ১৭১৪ সালে মোগল কমান্ডার দৌলত খাঁর নামে নামকরণ হয় দৌলতগঞ্জ। দৌলতখাঁ থেকে দৌলতগঞ্জ লেখাটি তৈরীতে সহায়তা করেছে ‘নদীয়া কাহিনী’, স্থানীয় বৃদ্ধ নজির মিয়া (৯২), ফজল আলী (৮৫), রবিউল হাড়ি (১০৫) প্রমুখ। এ লেখায় দৌলতখাঁ, লর্ড ক্লাইভসহ বহু অজানা তথ্য উঠে এসেছে। সঙ্গে থাকলো ওই এলাকা থেকে সদ্য প্রেরিত আতিকুজ্জামান চঞ্চলের কিছু আলোকচিত্র।
বর্তমান দৌলতগঞ্জের ভৈরব নদীর লোহার ব্রিজের দক্ষিণপাড়ে এবং ধ্বংস হওয়া তেঁতুল গাছের থেকে খুবই কাছে, আনুমানিক ৩০ গজ পশ্চিমে ছিল দুই কামরাবিশিষ্ট একটি মোগল বিল্ডিং। রং ছিল সাদা এবং গোলাপি। পিলার ছিল চিকন ও বহু কৌনিককেন্দ্রিক। সম্ভবত, এটি ছিল মোগলদের একটি নজরদারি চৌকি। [পর্যবেক্ষণ ক্যাম্প]। ছিল দক্ষিণ দুয়ারী। পিছনে নদীর দিকে ছিল বারান্দা। দৌলত খান ছিলেন দৌলতগঞ্জের মোগল কমান্ডার। জানা যায় ১৭১১ সাল থেকে ১৭১৪ সাল পর্যন্ত তিনি ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন। তার ক্যাম্প ছিল গঞ্জের আদিবাজারের নিকটস্থ বর্তমান হাবিবুর মিয়ার বাড়ির ওপড়। সৈনিকদের থাকার জন্য এখানে ৫টি পাকা ঘর ছিল। পাশে ছিল আর ও ক’টি পাকা ঘর। সৈন্য সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৩৭ জন। পাশে বর্তমানে করিম মিয়ার বাড়ি। এখানেই তিনতলা বাড়িতে কমান্ডার স্ত্রী নিয়ে থাকতেন। তার কোনো সন্তান ছিল না। এ ক্যাম্প থেকে তিনি প্রতিদিন ভৈরব ব্রিজের পশ্চিম পাশে পর্যবেক্ষণ ক্যাম্পে আসতেন। সৈন্যদের সঙ্গে সময় কাটাতেন। দেখতে ছিলেন লম্বা এবং পাগড়িধারী। ক্যাম্পের উত্তর দিকের বারান্দা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতেন নদীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ঠিক এ সময় ঘটে মাগুরায় এক মর্মান্তিক ঘটনা। ১৭১৪ [ইং] সালে মাগুরার জমিদার সীতারাম বাহিনীর হাতে আচমকা নিহত হন মোগল সেনাপতি তোরাব। নবাব মুর্শিদকুলী খাঁ এতে প্রচ- রকম ক্রুদ্ধ হন সীতারামের ওপর। মারণ আঘাত হানার প্রস্তুতিস্বরূপ সীতারামকে জীবিত বা মৃত অবস্থায় বন্দি করার জন্য সেনাবাহিনী এবং বঙ্গের সব জমিদারদের কঠোর নির্দেশ দেন। শেষ পর্যন্ত সীতারাম বন্দি হন এবং তাকে মুর্শিদাবাদে একটি গাছে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা হয়। ড. রজত কান্ত রায়ের লেখা ‘পলাশী ষড়যন্ত্র এবং সেকালের সমাজ ব্যবস্থা’ গ্রন্থে এ বিষয়ে বিশদ তথ্য রয়েছে। এই সীতারামের বিরুদ্ধে ভৈরব নদী দিয়ে যখন সেনাপতি হাসান খানের নেতৃত্বে সারি সারি সশস্ত্র মোগল নৌযান যাচ্ছিল, দৌলতগঞ্জ-লক্ষ্মীপুর এলাকায় তখন হঠাৎ দৌলতের ক্যাম্প এবং তার লক্ষ্মীপুরের ক্যাম্পের ১০-১২ জন মোগল সেনা কলেরায় আক্রান্ত হন। এদের মধ্যে দৌলতগঞ্জের মোগল কমান্ডার পতাকাবাহী দৌলত খাঁও ছিলেন। লক্ষ্মীপুরের একটি পুরনো কুয়ো থেকে কলেরার রোগীদের এ সময় পানি খাওয়ানো হতো। নদীর দুই তীরের কোনো লোক কলেরার ভয়ে এতে কোনো সহায়তা করেনি। দৌলত কলেরায় আক্রান্ত হন যুদ্ধে যাওয়ার একদিন আগে রাতে। জানা যায়, নিজ বাড়িতে দুই দিন তিনি কলেরায় মারাত্মক কষ্ট পান। তাকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় নিতে গেলে তিনি রাজি হননি। ওষুধ হিসেেেব খেতেন শুধু লবণ পানি ও গাছ-গাছরা। যা হোক, তৃতীয় দিন দুপুরের আগে এবং সকালের পরবর্তী সময়ে বর্ষা আসার আগে এই মোগল কমান্ডার ভূমিশয্যা গ্রহণ করেন।
নিজের কোনো বাড়ি ছিল না। মিশুক ও নিজ দায়িত্বে ছিলেন আন্তরিক। এ বিষয়ে এলাকায় তার সুনাম ছিল। দৌলতের দাফন হয় মৃত্যুর দিন সন্ধ্যার আগে। তার স্ত্রী ছিল কিন্তু লোকজন দাফন কাজে ব্যস্ত থাকায় তার স্ত্রীর কোনো খোঁজখবর সেদিন নিতে পারেননি। পরে তার স্ত্রী সম্পর্কে আর কোনো তথ্যও পাওয়া যায়নি। বয়স ছিল আনুমানিক ৫০। দৌলত যে এলাকায় কতটা জনপ্রিয় ছিলেন তার বড় প্রমাণ দাফনে উপস্থিত মুসলমানদের সংখ্যা। এ সংখ্যা ছিল ৫০ জনের মতো। কমান্ডারের মৃত্যুর খবর সমগ্র দৌলতগঞ্জে প্রচার করা হয়েছিল সামরিক বিধি মেনে এবং অত্যন্ত ভাবগাম্ভীর্যের সঙ্গে। সুদূর আমঝুপি (মেহেরপুর) এবং দর্শনা থেকে দৌলতের জানাজায় লোকজন ছুটে এসেছিল। আসবেই বা না কেন। দৌলত ছিলেন সেনা কর্মকর্তা। নিশান হচ্ছে সার্বভৌমত্বের প্রতীক। প্রধান সেনাপতির পিছনেই থাকেন নিশানদার। হাত থেকে নিশান পড়ে গেলেই যুদ্ধে পরাজয়। সুতরাং নিশানদারকে হতে হয় অত্যন্ত সাহসী। দৌলতগঞ্জে দৌলত খাঁর কোনো আত্মীয়স্বজন ছিল কিনা এ বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে প্রয়াত বটা ময়ড়ার পূর্ব পুরুষদের সাথে নাকি দৌলতের একটা নিবিড় সম্পর্ক ছিল। না, আজ সেই ফর্সা-স্বাস্থ্যবান এবং খর্বাকায় বটাময়ড়াও বেঁচে নেই, ছোটবেলায় তাকে দেখেছি ধুপ দুরন্ত পোশাকে। তবে বাড়িটা আছে। উত্তরসূরিরা নেই। যাদের কাছে দৌলত সম্পর্কে হয়তো কিছু তথ্য পাওয়া যেত।
দৌলতের মৃত্যুর আগে ভৈরবের দক্ষিণ পাড়ে একটি দর্গর পাশে নিজের কবরের স্থান নির্ধারণ করে যান। মৃত্যুর পর সেভাবেই তাকে কবর দেওয়া হয়। ১৭১৪ সালে দৌলত খাঁর মৃত্যুর অনেক পরে দুই কামরার ঘরের একটিতে ফকির গোছের এক পাগল থাকতেন। ছেঁড়া ময়লা কাপড় পড়তেন। কথা বলতেন কম। নজির মিয়া প্রায় আশি বছর আগে এ ফকিরকে দেখেছিলেন। ফকির কথা কম বলায় নজির মিয়া তার সঙ্গে কোনো সখ্যতা করেননি। পরে বৃটিশরা তাকে তাড়িয়ে দেয়। অন্য রুমে ইংরেজরা আড্ডা দিত। কেরামবোর্ড খেলত। তখন এই মোগল আমলের পাকা ঘরটির ছাদ জীর্ণ হয়ে প্রায় ভেঙে পড়েছিল। তখন ইংরেজরা বিল্ডিংয়ের মাথায় ত্রিভুজ আকৃতির নতুন গাঁথুনি দিয়ে এবং ব্রিটিশ বড় টালি দিয়ে চালের ব্যবস্থা করে। এতে মোগল বিল্ডিংয়ের জৌলুসটাই ম্লান হয়ে যায়। এভাবে এলাকায় অনেক মোগল ভবনই ইংরেজরা পুনর্নির্মাণের নামে ধ্বংস করে ফেলে।
গঞ্জে শাহরিয়ার
আগে দৌলতগঞ্জের নাম ছিলো ‘গঞ্জে শাহরিয়ার’। এই ব্যক্তি ছিলেন মনি-মুক্তা ব্যবসায়ী।তিনি এলাকার লোকদের ডেকে প্রথম বাজার বসান এবং বাজার উদ্বোধন করেন। সংক্ষেপে এই হলো গঞ্জের আদি বাজার। বাসস্থান ছিলো গঞ্জের বাজারের পাশে। দৌলতের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। অসুস্থ হয়ে দৌলতের আগেই তিনি মারা যান। ছিলেন নি:সন্তান। দৌলত তখন জীবিত। শাহরিয়ারের মৃত্যুর আগেই দৌলতখার নামে নাম হয় দৌতলগঞ্জ।
দৌলতগঞ্জের নামকরণ
দৌলতগঞ্জের নামকরণ নিয়ে রয়েছে বহু মতামত। মরহুম শিক্ষক মুন্সী আবদুস সাত্তারের ভাষায়... ‘নিশানদার দৌলত খাঁ এখানেই কলেরায় মারা যান। তাকে নদীর দক্ষিণ পাড়ে সামরিক মর্যাদায় সমাধিস্থ করা হয়। মোগল বাহিনীর নিশানদার মৃত দৌলত খাঁর নামানুসারে এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয় দৌলতগঞ্জ।’ তার আর এক ভাষ্য : ‘এই বাণিজ্যপুরীতে মাঝে মাঝে এক দরবেশবেশী পাগল এসে “ইনহাস্ত ধন ইনহাস্ত দৌলত” বলে বকতে বকতে যে পট্টিতে থামত সেখানে খুব বেচাকেনা হতো। একদিন সেই পাগল বিরক্তিভরে এক গলিতে ঢুকে আর বের হয় না। দরবেশের কথা ইনহাস্ত দৌলত অনুসারে নাকি এই মোকামের নাম দেওয়া হয় দৌলতগঞ্জ।’ এই উক্তি মরহুম কয়েকজনের। দৌলতগঞ্জের মধ্যযুগের সেই ইতিহাস যতটা পেরেছি পাখির দৃষ্টি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করেছি। এই আলোকে বলতে পারি, বৃটিশ শাসনের শেষের দিকে দৌলতগঞ্জে এই পাগলের রহস্যময় উত্থান এবং রহস্যময় প্রস্থান। বয়সছিল আনুমানিক ৩৫-৪০। কারো সঙ্গে কথা বলতেন না। ইশারায় সব বোঝাতেন ।এক কাপড়ে থাকতেন। কেউ কিছু দিলেও খেতেন না। মুখে দাড়ি ছিল না। অনুমান করা হয় মরহুম মুন্সী আবদুস সাত্তার মাস্টারের বাড়ির পাশের চিকন গলিতে পাগল নিখোঁজ হয়। সেই আমলে ফারসি ভাষার খুব প্রাধান্য ছিল। আমি কজন সমকালীন ফারসি প-িতকে পাগলের ওই ফারসি উচ্চারণের অর্থ জিজ্ঞেস করলে তারা বলেছেনÑ ‘এখানেই ধন এখানেই দৌলত অর্থাৎ এখানেই সব কিছু।’ বড়ই অর্থপূর্ণ কথা। যা হোক এই রহস্যময় পাগলের বহু বছর আগে ‘দৌলতগঞ্জ’ নামকরণ হয়েছে। আর ওই পাগলের আবির্ভাবের সময় তো একটু আগেই উল্লেখ করেছি। বর্তমানে স্থানীয় দু-একজন প্রবীণের অভিমত : এখানে একজন দৌলতবাবু ছিলেন। তার নামেই দৌলতগঞ্জ হতে পারে। কথাটা একেবারেই সত্য নয়। বাবু শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় ইংরেজ শাসনামল থেকে। অন্যদিকে ‘গঞ্জ’ শব্দের প্রচলন মোগল সময়ে এবং যা ফারসি শব্দ । সত্য হচ্ছে, কোনো আধ্যাত্মিক পাগল নয়, দৌলত বাবু নয়, মুর্শিদকুলী খানের সেনা কমান্ডার দৌলত খাঁর নামে দৌলতগঞ্জ হওয়া স্বাভাবিক।
মরেও শান্তি পাননি দৌলত
দৌলত মরেও শান্তি পাননি। মৃত্যুর পর দিল্লী থেকে আগত দুর্ধর্ষ মোগল সৈন্যরা দৌলতকে খুঁজতে থাকে ক্রুদ্ধ হয়ে। তারা মনে করে ছিল দৌলত সীতারামের পক্ষে। যখন তারা জানতে পারে কলেরায় সে মারা গেছে এবং তার কবর আছে তখন সৈন্যরা শান্ত হয়। তার কবরের সামনে সৈন্যরা কিছুক্ষন নীরবতা পালন করে সম্মান প্রদর্শন করে। তার কবরের সামনে সৈন্যরা কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে সম্মান প্রদর্শন করে। এ এলাকার অনেক জমিদারকে সে সময় গীতারামের সহযোগী হিসেবে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়।
প্রভুভক্ত বাহার শেখ
দৌলতের বডিগার্ড ছিলেন বাহার শেখ। বয়স আনুমানিক ৩৫। ছিলেন চির কুমার। সর্বক্ষণ কমান্ডারের সঙ্গেই থাকতেন। কমান্ডার আক্রান্ত হয়েছিলেন রাতে। সকালে অসুস্থতার জন্য মূল ক্যাম্পেও যেতে পারেনি। রাতেই বাহার শেখকে বলেন, সকালে যুদ্ধে যেতে হবে। বাহার শেখ জানিয়ে ছিলেন ক্ুঁপ বা অন্য কোনো দূষিত পানি পান করার ফলে সৈন্যদের এই অসুস্থতা। বাহার শেখ অসুস্থ সৈন্যদের নিয়ে কোলকাতার রওনা হন। ওখানে কেউ মারা গিয়েছিল কি না তা জানা যায় না। দৌলত মারা গেলে প্রভুভক্ত এই বাহার শেখ দৌলতের কবর পাহাড়ায় নিয়োজিত হন। যতটুকু জানা যায় বাহার শেখ এ দায়িত্ব ১৭৬৫ সাল পর্যন্ত পালন করে ছিলেন এবং অতিবৃদ্ধ অবস্থায় ইংরেজরা তাকে তাড়িয়ে দিলে তিনি ভারতে চলে যান। তারপর থেকে এই প্রভূভক্ত মানুষটির আর কোনো খোঁজ মেলেনি।
দৌলতের কবর স্থানান্তর
জানা যায়, ১৯৪০ সালে বর্তমান ভৈরবের লোহার ব্রিজের দক্ষিণের নিচের অংশে দৌলতের লম্বা কবর ছিল। কিন্তু নদী ভাঙনে কবর অর্ধেক ভেঙে যায়। বাকি অংশ ছিল দক্ষিণে, তেতুল গাছের ২-৩ হাত উত্তরে। ভাঙন থেকে বাঁচানোর জন্য তার হাড়-গোড় এবং ইট তুলে কয়েকগজ দক্ষিণ-পশ্চিমে স্থানান্তর করা হয় ১৯৪০ সালে। এখানেই এখন নতুন বটগাছ।
ঘোড়াসাহা মাটির নিচে
জানা যায়, লোহার ব্রিজের পূর্ব দক্ষিণ, ‘ঘোড়াসাহা’ নামের একজন ধনী ব্যবসায়ী স্বপরিবারে ভূমিকম্পে মাটি চাপা পড়ে নিহত হন। বাড়ি ছিল পাকা এবং দুতলা। উপরে নিচে ছ’টি রুম ছিলো। ১৭১৪ সালে গভীর রাতে ভূমিকম্পে তার বাড়ি মাটির নিচে চলে যায়। তার ছিলো এক সন্তান। পলাশি থেকে বনিকরা তার কাছ থেকে তামা-কাশা কিনতে আসতো এখানে। এই ব্যাক্তি ছিলেন হিন্দু সাহা সম্প্রদায়ের। অনেক ঘোড়া ছিল তার। মাথায় পাগড়ি পড়ে বগলে অস্ত্র নিয়ে ঘোড়া চালাতেন। দৌলতের মৃত্যুর ক’মাস আগে নিহত হন।
সিরাজ প্রেমিক ধর্মদাস : মৃত্যু ১৭৫৭
ধর্মদাস দেখতে ছিলেন উঁচালম্বা এবং কৃষ্ণকায়। ১৭৪১-১৭৫২ (ইং) সালে বর্গী হামলার আতংকে এবং নবাব সিরাজের নানা নবাব আলীবরদীর সহায়তায় (ধারণা করা হয়) দৌলতগঞ্জে একটি অনিন্দ্য সুন্দর দ্বিতল ভবনে বসবাসের সুযোগ লাভ করেন। সালটা ছিল ১৭৫০ (ইং)। আদিগঞ্জের বাজারে তার সুবৃহৎ বস্ত্রের ব্যবসা ছিল। এছাড়াও এখানে
ছিল তার আরও বহুবিধ ব্যবসা। মুর্শিদাবাদেও বস্ত্রের কারবার ছিল। নবাব সিরাজের চাকরি করতেন। সিরাজের পক্ষে দৌলতগঞ্জে তার মিটিংয়ের কথাও শোনা যায়। যুদ্ধের একদিন আগে সিরাজের নামে নাকি দৌলতগঞ্জে স্লোগানও দিয়েছিলেন। সিরাজের শত্রুদের সম্পর্কে তিনি সজাগ ছিলেন। ১৭৫৭ সালের ২২ জুন এক বিকেলে তিনি বাড়ি ত্যাগ করে চ্যাংখালি বর্ডার দিয়ে পলাশি এবং মুর্শিদাবাদ শহরের মধ্যবর্তী ‘মরদানপুর’ পৌঁছান। ওখানে তার ভাইদের পাকা বাড়ি ছিল। পলাশী যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি সকালের দিকে যান এবং বিকেলের দিকে অর্থাৎ যুদ্ধ শেষের দিকে ইংরেজদের গুলিতে নিহত হন । মতিলাল দত্ত তাকে যুদ্ধে যেতে নিষেধ করেছিল। বাড়ি ত্যাগ করার আগে ধনরতœ তিনি অত্যন্ত গোপনভাবে সুরক্ষা করে যান এবং ঘনিষ্ঠজনদের বলে যান তার ধনসম্পদ এখানে লুট হয়ে যাবে যুদ্ধের কারণে এবং এমনকি তার জীবনও বিপন্ন হতে পারে। ধর্মদাস ছিলেন তার সময়ে দৌলতগঞ্জের শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী এবং জমিদার। বাড়ির উপর ও নিচে রুম ছিল ছ’টি। ভাই, চাচাতো ভাই, পুত্র-স্ত্রী নিয়ে ছিল তার সমৃদ্ধ জীবন। পলাশী যুদ্ধের একদিন পরে ২৪ জুন একদল ইংরেজ চ্যাংখালি সীমান্ত দিয়ে ধর্মদাসের বাড়িতে পৌঁছায়। তাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে বলে। কিন্তু বাড়ির ভেতর থেকে বলা হয় দু’দিন আগে এক বিকেলে চ্যাংখালি দিয়ে তিনি যেন কোথায় চলে গেছেন। ধারণা করা হয় ধর্মদাসকে পেলে ইংরেজরা তার প্রাণবায়ু কেড়ে নিত। ইংরেজরা ধর্মদাসকে না পেয়ে তর্জন গর্জন করে ধর্মদাসের কিছু সম্পদ একাধিক ধর্মদাস যখন দৌলতগঞ্জে আসেন ১৭৫০ সালে তখন বাড়িটি ছিল জনশূন্য। একজন প্রতাপশালী ব্যবসায়ী হিন্দু এ বাড়ির মালিক ছিলেন। কোলকাতা-কাশ্মীরে তার ব্যবসা ছিল। কোনো কারণে তিনি কোলকাতায় চলে গেলে দ্বিতল ভবনটি শূন্য হয়ে পড়ে। সেখানেই ধর্মদাস উঠেন।
পলাশী যুদ্ধ এবং দৌলতগঞ্জে উত্তেজনা
ইতিহাসের এই অংশটুকু ঠিক নয়। প্রায় তিনশো বছর ধরে একই পুরনো রেকর্ড প্লেয়ার বাজানো হচ্ছেÑ ‘পলাশীতে যখন যুদ্ধ চলছিল তখন লোকজন মাঠে কাজ করছিল। যুদ্ধ নিয়ে কোন মাথাব্যথা ছিল না। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, এই পলাশী যুদ্ধে পলায়নপর নিরস্ত্র জনগোষ্ঠীকে হত্যা করে ছিল ইংরেজরা অত্যন্ত নৃশংসভাবে। যাদের সংখ্যা ছিল শত শত লেখকের ভাষায় হাজার হাজার। এটা শুধু একজন মাত্র ইংরেজ লেখকই স্বীকার করেছেন। যা হোক এই জনগোষ্ঠীরই যারা সদস্য তারা গ্রাম ও শহরের দুই অংশের মানুষ ছিল। হ্যাঁ এরাই সেই নিরস্ত্র জনগোষ্ঠী। এদের একটি অংশ যুদ্ধস্থলে থাকতো লুটের অপেক্ষায়। লুটকে সেই সময় মন্দ ভাবা হতো না। একটি অংশ আবার গোপনে টাকা খেয়ে পক্ষকে সাপোর্ট দিতে যেত আর একটি অংশ দেশ প্রেমের জন্য যুদ্ধে যেত এবং ধর্ম দাস এ দলের ছিলেন। তবে সঠিকভাবে অস্ত্র চালাতে জানতো না কেউই। পলাশীতে এই ধরনের মৃত্যুর সংখ্যা শত শত। যা একটু আগেও উল্লেখ করেছি। এর মধ্যে দৌলতগঞ্জ থেকে পলাশী যুদ্ধে অংশ নিতে গিয়ে মারা গিয়েছিল আনুমানিক দশ-আগারো জন। জীবিত ফিরে এসেছিল বড়জোর একজন। লেখকদের ভাষায় সম্ভবত এরা লুটেরা ছিল। কারণ এরা কেউই নাকি দৌলতঞ্জের মূল অধিবাসী ছিল না। বলা যায় শিকড়হীন। দ্রুত ভাগ্য বদলাতে সেই সময় লুণ্ঠন ছাড়া অন্য কোনো সহজপথ তাদের সামনে খোলাও ছিল না। দৌলতগঞ্জের বাণিজ্যপুরীতে পলাশ যুদ্ধের অনেক আগাম খবর নিয়ে আলোচনা হত। উত্তেজনা সৃষ্টি হত। এ সসব খবর আসতো নৌমাঝিদের কাছ থেকে বেশি। যুদ্ধের পরের দিন দৌলতগঞ্জে উত্তেজনা ছিল সংঘর্ষ ছিল, কিন্তু কেউ নিহত হয়নি। যুদ্ধের আগের দিন মোসলমানরা ভয়ে দৌলতগঞ্জ ছেড়ে দূরে ভৈরবা এবং জিন্নানগর গ্রামে পালিয়ে যায় এবং যুদ্ধের পরে ফিরে আসেন।
দৌলৎগঞ্জে ১৭৬৪ সালে লর্ডক্লাইভের রাতি যাপন এবং মজাদার ঘটনা
১৭৬৪ সালে (ইং) বাংলা বিহার এবং উরিষ্যার শেষ নবাব মীর কাসিমের সঙ্গে যুদ্ধে ক্লাইভ জয়ী হন, সেই সঙ্গে বাংলা- বিহার এবং উড়িষ্যা ১৯০ বছরের জন্য বৃটিশদের হাতে চলে যায়। এই যুদ্ধের ছ’মাস পর ক্লাইভ এক সন্ধ্যায় ভৈরব নদী দিয়ে দৌলতগঞ্জে ধর্মদাসের বাড়িতে উঠেন। দ্বিতল ভবনের উপরের অংশ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় লর্ড ক্লাইভকে নিচে থাকতে দেওয়া হয়, তার সঙ্গে ছিল চার বৃটিশ। এ পরিবারের পক্ষ থেকে মদ এবং নারী দিয়ে ক্লাইভ অপ্যায়নের কথা ছিল কিন্তুু কর্ণেল ক্লাইভের সঙ্গের লোকজন বলে ছিল, ক্লাইভ এসব পছন্দ করেন না। কিন্তু ইতিহাস প্রেমিরা কি এটা বিশ্বাস করেন? পলাশি যুদ্ধের পর কোলকাতার ব্যবসায়ী এবং পলাশি অন্যতম ব্যক্তি নবকৃষ্ণ তার কোলকাতার বাড়িতে দুর্গাপূজা উৎসবে কি দিয়ে ক্লাইভকে আপ্যায়ন করে ছিলেন, অনেক ইতিহাস প্রেমিই তা জানেন। ক্লাইভ ধর্মদাসের বাড়িতে দু’দিন ছিলেন। ধর্মদাসের বড় ছেলে কালিকিংকর দত্ত নাকি ক্লাইভকে বলে ছিলেন, এ বাড়ির অনেক ইতিহাস আছে, যা এখন বলা যাবে না। ক্লাইভ একথা শুনে, অজানা ভয়ে সকালের দিকে দ্রুত নৌপথ দৌলৎগঞ্জ ত্যাগ করেন। কালিকিংকর ক্লাইভ কে সম্ভবত বলতে চেয়েছিল, এবাড়ি নবাব আলী বর্দীর দান এবং তার পিতা পলাশিযুদ্ধে সিরাজের পক্ষে নিহত হয়ে ছিলেন, ইত্যাদি। কিন্তু মোঘল বিরোধী এসব কথা তো কোনো ক্রমেই ক্লাইভকে বলা যাবে না। তাই বলেনও ওনি। কেউ বলেন, তিনি দৌলতগঞ্জে ভক্তদের সঙ্গে দেখা করতে এসে ছিলেন। এ ক্ষেত্রে লেখকদের বক্তব্য, ক্লাইভ কয়েকটি সম্ভাব্য কারণে দৌলৎগঞ্জে এসেছিলেন। যেমন গঞ্জের বাজারে ক্লাইভের নিজস্ব কাপড়ের ব্যবসার হালচাল দেখা, এবং অত্র এলাকায় নতুন ব্যবসার চিন্তা ভাবনা,এ অঞ্চলের মানুষ তাকে কতটা ভালো বাসে তা পরখকরা, সেই সঙ্গে দৌলৎগঞ্জে তার মিত্রদের সঙ্গে সাক্ষাতকরা। ধারণা করা হয় ধর্ম দাসের পরিবারের মধ্যেই ক্লাইভের মিত্র ছিল।
লেখক : কবি, সাংবাদিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।