বর্ষপূর্তির কবিতা
ভালোবাসো মন খুলেআ ল ম শা ম সবৈশাখী ঝড়ে উড়ে গেছে চালবর্ষার বৃষ্টিতে ডুবে গেছে ঘরভাদ্রের বন্যায় ভেসে গেছে বাড়ি।তুমি শুধু একা।ভয় শংকায় হারিয়ে গেছে
শাহনাজ বেগম
এমন একটা সময় ছিল যখন নারী-পুরুষের ব্যবধান ছিল অনেক। এখন আর সে অবস্থা নেই। নারী জয় করেছে হিমালয়ের চূড়া, রাজনীতিতে সক্রিয় অবদান রাখছে দেশ ছেড়ে বিদেশে। শাণিত কলমের ছোঁয়ায় হয়ে উঠেছেন সাহসী লেখিকা। জজ-ব্যারিস্টার হয়ে আসছেন বিদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে। রাষ্ট্র পরিচালনায়, সংসদে, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, যানবাহন তথা রেলগাড়ি চালনায়, পুলিশ, ট্রাফিক, ব্যবসায়Ñ কোথায় নেই নারীর অবাধ বিচরু। ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্র, রাজনীতিতে বা অর্থনৈতিক কর্মকা-ে সর্বত্র নারীর সরব উপস্থিতি বিদ্যমান। মেধা, বুদ্ধি-বিবেচনা দিয়ে পুরুষের পাশাপাশি নারীর এগিয়ে চলা এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। দৃশ্যত, নারী-পুরুষের ব্যবধান অনেকাংশেই কমছে, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও রয়ে গেছে। সব ছাপিয়েও শিক্ষিত, বুদ্ধিমতি, সাহসী হয়েও দূর হচ্ছে না নারী-পুরুষের বৈষম্য। পরিবারে, সমাজে বা রাষ্ট্রে সবখানেই পুরুষের সাথে একটা অলিখিত বৈষম্য রয়েই যায়। আবার এমনও দেখা যায়, শিক্ষিত হয়েও শহরের মেয়েরা যতটা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে গ্রামের মেয়েরা সে তুলনায় অনেক পিছিয়ে। লেখাপড়া শিখেও উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত সে সংখ্যাও কম নয়। আবার যেসব নারী কাজ করার সুযোগ পাচ্ছে তাদের কর্মক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ পুরুষ সহকর্মীর ভিতরে কোণঠাসা হতে হচ্ছে। সহযোগিতার অভাবে প্রতিবন্ধকতা চলে আসে সবক্ষেত্রে। নারী-পুরুষের বৈষম্য ভেদ করতে পারছে না নারী সমাজ। পরিবার থেকে সমাজে, কোথাও না কোথাও তাদের বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে। এর মধ্যে মজুরি বৈষম্য উল্লেখযোগ্য। দেখা যায়, পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করেন নারীরা। এসব দিক দিয়ে নারীর সঙ্গে পুরুষের নানা বৈষম্য দূর হলেও মজুরি পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি। মজুরিহীন কাজ থেকে মজুরি আছে এমন কাজে যোগ দিলে প্রথমে মজুরি কিছুটা কম পাওয়া যায়। এমন কাজে যোগদানকারীদের বেশিরভাগই নারী। সমান সময়ে সমান খাটুনি হলেও কেবল সমান নয় মজুরি। কোন কোন ক্ষেত্রে মজুরির ব্যাপারে তারা কিছুই জানেন না। কোন কোন ক্ষেত্রে নারী শ্রমিককে পুরুষের সহযোগী হিসেবে বিবেচনায় নেয়া হয়। আবার কম পয়সায় বেশি শ্রম পাওয়ায় মালিকরা নারী শ্রমিকদের নিয়োগ দেয়ায় বেশি আগ্রহ। তাই নারীর গড় মজুরি কমে গেছে।
সমাজে নারীর অধিকার ও মর্যাদা সমুন্নত রাখতে ইসলামে দিক-নির্দেশনা রয়েছে। মহানবী (সা.) নারী ও পুরুষের সমমর্যাদার কথা বলেছেন। ইসলাম পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীকে পুরুষের সমান মর্যাদার অধিকারী করেছে, অত্যন্ত সম্মানজনক মর্যাদা দিয়েছে। নবী করিম (সা.) স্বয়ং নারীদের শিক্ষা গ্রহণের গুরুত্বের প্রতি বিশেষভাবে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে নারীদের উদ্দেশে শিক্ষামূলক ভাষণ দিয়ে উদাত্ত কণ্ঠে বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য জ্ঞানার্জন করা ফরজ।’ (ইবনে মাজা) ইসলাম নারীদের আবশ্যিক শিক্ষা, ধর্মচিন্তা, কর্মের স্বাধীনতাসহ পাত্র নির্বাচন ও সম্মতি প্রদানের অধিকার দিয়েছে। এ সত্ত্ব¡ও কোন কোন ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের ব্যবধান সুস্পষ্ট।
কিন্তু নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দুই বছরে মাসিক মজুরি বা বেতন গড়ে মাত্র ৪৯ টাকা বেড়েছে। ২০১৩ সালে এর পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৪৯৩ টাকা। এ হিসাব মতে দেখা যাচ্ছে, পুরুষদের গড় মজুরি বাড়লেও নারীদের কমেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)’র ২০১৩ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, সে সময়ে একজন নারী কর্মী মাসে গড়ে ১১ হাজার ১৩৬ টাকা মজুরি পেতেন। পরের দুই বছর তাদের গড় মজুরি তো বাড়েইনি, বরং কমে ১০ হাজার ৮১৭ টাকা হয়েছে। অন্যদিকে, পুরুষেরা এখন মাসে গড়ে ১১ হাজার ৭৩৩ টাকা মজুরি পান। দুই বছর আগে তারা পেতেন ১১ হাজার ৬২১ টাকা। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) যে তথ্য পাওয়া গেছে তাতে দেখা যায়, বর্তমানে দেশের ২ কোটি ৩১ লাখ নারী-পুরুষ মজুরি বা বেতন পান। দুই বছর আগে এমন কর্মজীবীর সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৩৯ লাখ ৭০ হাজার। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) এর জরিপে মজুরি সমতার দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশি নারীরা। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী বছরে পুরুষদের গড় আয় ৩ লাখ ১৮ হাজার টাকা আর নারীদের গড় আয় ১ লাখ ৬৬ হাজার টাকা।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী পালিত হল মে দিবস। সাধারণভাবে আমরা জানি, মে দিবস শ্রমিকের অধিকার রক্ষার দিবস। ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে-মার্কেটে শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজের জন্য ধর্মঘট করেছিলেন, কিন্তু দুঃখজনকভাবে সেদিন পুলিশ ও শ্রমিকের সংঘর্ষে শ্রমিকদের প্রাণ দিতে হয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতারা এই বিষয়টি নিয়ে ১৮৯০ সালে প্যারিসে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছিলেন এবং মে মাসের প্রথম দিনকে শিকাগোর সংগ্রামী শ্রমিকদের স্মরণে নির্ধারণ করে দেন। যুগ যুগ পার হলেও এখনো শ্রমিকের অধিকারের সংগ্রাম খুব বেশি এগিয়েছে বলে মনে হয় না, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার অবনতি ঘটেছে। সেভাবে সচেতন নয় শ্রমিকরাও। এ দিনে শ্রমিকের কী অধিকার নিয়ে সংগ্রাম করতে হবে তা হয়তো বেশিরভাগ শ্রমিক জানেন না। শ্রমিকরা নিত্য সমস্যার মুখে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। শরীরের ঘাম ঝরিয়ে কাজ করলেও পারিশ্রমিক মিলছে না, তাদের স্বাস্থ্যকর বাসস্থানের অভাব, কোথাও ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হয়, চিকিৎসাসেবা নেই, মালিকের সদিচ্ছার অভাবে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
দেশের অর্থের একটা বড় অংশ এখন গার্মেন্টস শিল্পের উপর নির্ভরশীল। যার বেশিরভাগ শ্রমিক নারীকর্মী। সেজন্য অর্থনীতির উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে হলে, যেসব শ্রমিকরা নানাভাবে সমস্যায় জর্জরিত সে সমস্যাগুলো খুঁজে বের করে প্রতিকার করা উচিত। পাশাপাশি শ্রমিকের বেতন বৈষম্য ও কাজের পরিবেশের দিকে আরো গুরুত্ব দিতে হবে। সকল গার্মেন্টস শিল্পের মালিকদেরও সজাগ হওয়া দরকার। দেশের গার্মেন্টস শিল্পের স্বচ্ছতায় শ্রমিকরে জীবন মান উন্নয়ন সম্ভব।
আশার কথা, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যখাতে নারীর উন্নয়ন হয়েছে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যুর হার ২৫ শতাংশ কমিয়ে এনেছে। নারী-পুরুষের সমতা অর্জনের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় মাপকাঠি। প্রতিটি গ্রামে গ্রামে, তৃণমূলে, প্রান্তিক মানুষের হাতের নাগালে রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক। নারীরা খুব সহজে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন। এছাড়া প্রতিটি জেলায় নারীবান্ধব জেলা হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছে। এখানে নারীদের চিকিৎসায় আলাদা সেল রয়েছে। দেশব্যাপী ১২ হাজার ৯৫৬টি মাতৃসদন রয়েছে, যাতে স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন নারীরা। এছাড়াও বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় দুই ধাপ করে এগিয়েছে নারীর শিক্ষা ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে। শিক্ষায় অংশগ্রহণে এবার বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯তম, স্কোর ০.৯৪৮। গত বছরেরর মতো এবারও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বিশ্বে প্রথম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে উচ্চ শিক্ষায় নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে গতবছরের ১১৮তম অবস্থান থেকে পিছিয়ে এসেছে ১১৯তম অবস্থানে। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে গত বারের দশম থেকে এগিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান এবার অষ্টম। কমছে নারী ও পুরুষের লিঙ্গ বৈষম্য। সেইসঙ্গে পুরুষের উপর নারীর আর্থিক নির্ভরশীলতার হারও কমছে উল্লেখযোগ্য হারে।
বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালতে নারীরা যোগ্যতা ও মেধার গুণে নিজেদের কর্মসংস্থান করে নিচ্ছে, কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে না বা কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসদাচরণ রয়েই যায়। নারী সহকর্মীকে কোথাও সম্মান প্রদর্শনের মানসিকতা হারিয়ে তাদের ন্যায্য প্রাপ্য অধিকার পর্যন্ত ক্ষুণœ করা হয়, যা কর্মক্ষেত্রে নারীর উন্নয়ন ও অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করে। অথচ ইসলাম বিভিন্ন বিষয়ে সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে নারীর অধিকারকে সম্মানজনক মর্যাদায় উন্নীত করেছে। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের ন্যায্য অধিকার, প্রাপ্য সম্মান ও মর্যাদা না দেওয়া বা উপেক্ষা করার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। নারীদের কোণঠাসা করে না রেখে তাদের উচ্চতর শিক্ষা ও উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ অবারিত করে দেওয়া দরকার। এ জন্য নারী জাতির প্রাপ্য সম্মান, মর্যাদা ও ন্যায়সংগত অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে সবাইকে আন্তরিক হতে হবে।
লেখক : সাংবাদিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।