Inqilab Logo

রোববার, ১৬ জুন ২০২৪, ০২ আষাঢ় ১৪৩১, ০৯ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

ইসলাম ও চিন্তার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে

প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এবনে গোলাম সামাদ
ইসলাম শব্দটির উদ্ভব হয়েছে হিব্রু (এপরু) শব্দ ‘সালম’ থেকে। সালম শব্দের শব্দগত অর্থ শান্তি। ইসলাম হলো শান্তি প্রতিষ্ঠার ধর্ম। ইসলামের নবী কেবল একজন ধর্ম প্রবর্তক ছিলেন না, ছিলেন একজন রাষ্ট্রপ্রধান, দক্ষ প্রশাসক ও বিচারক। তিনি ভেবেছেন সুশাসন সম্পর্কে, চেয়েছেন মর্তে সুশাসন প্রতিষ্ঠার। মানুষ যাতে ইহজগতে শান্তিতে বসবাস করতে পারে। ইসলাম মূলত একটি ইহজাগতিক ধর্ম। মাটির পৃথিবীকে এই ধর্মে অস্বীকার করতে চাওয়া হয়নি। কিন্তু ইসলাম ও চিন্তা স্বাধীনতা নিয়ে আমাদের দেশে এখন অনেক কথা অনেকে বলতে চাচ্ছেন ইসলামী চিন্তার স্বাধীনতা স্বীকৃত নয়। অথচ বাস্তব সত্য হচ্ছে, ইসলাম ধর্মে মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা স্বীকৃত। আল কোরআনে বলা হয়েছে, ধর্মের নামে কোনো জবরদস্তি নেই (সুরা ২:২৫৬)। বলা হয়েছে, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে (সুরা ৪:১৭১)। বলা হয়েছে, মানুষকে যুক্তি দিয়ে ধর্মের উপযোগিতার কথা বুঝাতে (সুরা ১৬:১২৫)। আমাদের দেশে অনেকেই বলছেন ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা। ইসলাম হলো আসলে একটা ধর্মনিরপেক্ষ ধর্ম। কেননা এতে বলা হয়েছে, ধর্মের নামে কোনো জবরদস্তি নেই। অন্যদিকে মানুষকে বলা হয়েছে যুক্তিবাদী হতে। যুক্তিবাদ ইসলামে পেয়েছে বিশেষ স্বীকৃতি। ইসলাম ঠিক অন্য ধর্মের মতো নয়, এর মধ্যে নিহিত রয়েছে যুক্তিবাদের ধারণা। ইসলামে অন্য ধর্মের লোককে ঘৃণা করতে বলা হয়নি। আল কোরআনে বলা হয়েছে, “আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেনি তাদের সঙ্গে দয়া সুবিচার সম্মত ব্যবহার করতে, যারা তোমাদের সাথে ধর্মের ব্যাপারে যুদ্ধেরত নয় এবং যারা তোমাদের বহিষ্কার করেনি তোমাদের স্বদেশ ভূমি থেকে। কেননা যারা ন্যায়বান আল্লাহ তাদের সকলকেই সমানভাবে ভালোবেসে থাকেন” (সুরা ৬০:৮)।
মুসলিম বিশ্বে এক সময় উদ্ভব হয়েছিল মুর্যায়ি মতবাদের। মুর্যায়িরা মনে করতেন কে পাপী আর কে পাপী নয়। আর সে বিচার করবেন আল্লাহ। এক্ষেত্রে মানুষকে হতে হবে সহনশীল। বিরত থাকতে হবে কাউকে পাপী উপদেশ চূড়ান্ত সাক্ষী প্রদানে, কেননা আল কোরআনে বলা হয়েছে, সর্ব ও মতের সবকিছুর মালিক হলেন আল্লাহ। তিনি হলেন শেষ বিচারক। তিনি যাকে ক্ষমা করতে চান তাকে ক্ষমা করেন। তিনি যাকে শাস্তি দিতে চান দেন তাকে শাস্তি। তবে আল্লাহ প্রায়শই হলেন ক্ষমাশীল। কৃপাপরায়ণ (সুরা ৩: ১২৯)।
আমি এসব কথা বলছিÑ কারণ, বাংলাদেশে কয়েকজন তথাকথিত মুক্তচিন্তামনা ব্লগার খুন হয়েছেন। এরা খুন হতেন না, খুন হয়েছেন কেননা এরা কিন্তু ইসলামের নবী সম্পর্কে ব্লগবুকে এমনসব কুচ্ছিত মন্তব্য করেছেন, যা ক্ষুব্ধ করেছে মুসলিম জনমতকে। তারা যদি ভদ্র ভাষায় ইসলামের সমালোচনা করতেন তবে এ দেশের জনমত তাদের ওপর অতটা ক্ষুব্ধ হতো না। ব্লগাররা নিজেরাই ডেকে এনেছেন নিজেদের মৃত্যু। ইসলামের নবীকে অযথা অপমান করে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কিন্তু সেখানেও আছে ব্লাসফেমি আইন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খ্রিস্টধর্মের এমন কোনো সমালোচনা করা যায় না, যাতে সে দেশের সাধারণ শান্তি ভঙ্গ হতে পারে। বাংলাদেশে যা ঘটেছে তেমন কিছু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ঘটতে পারত যদি কেউ হযরত ঈসা (আ.) সম্পর্কে করতেন অনুরূপ কুচ্ছিত মন্তব্য। বাক-স্বাধীনতা যেমন স্বীকৃত গণতন্ত্রী দেশে, তেমনি আবার আইন রয়েছে বাক সংযমের। এদেশে ব্লগাররা অনুভব করেননি বাক সংযমের। তাদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ অশালীন আচরণ তাদেরকে ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুর পথে। দেশে এখন ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ দল। আওয়ামী লীগ কোনো ইসলামপন্থি দল নয়। কিন্তু অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, শেখ হাসিনাকেও বলতে হচ্ছে যে, এ ধরনের ইসলামবিরোধী প্রচারণা তিনি দেশে চলতে দেবেন না। এ থেকে অনুমান করা যাচ্ছে পরিস্থিতির গুরুত্ব। প্রশ্ন হলো, ব্লগাররা হঠাৎ কেন এ ধরনের প্রচারণায় সক্রিয় হয়ে উঠলেন? এর কারণ যতটা না মুক্তচিন্তার চর্চা তার চেয়ে বেশি হলো মানুষের মধ্যে ইসলাম সম্পর্কে বিভ্রান্তি জাগানো। বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে বাংলা ভাষী মুসলমান আছেন বলেই। বাংলা ভাষী হিন্দুরা কোনো দিনই চাননি একটি পৃথক স্বাধীন দেশ গড়তে। তারা চেয়েছেন, ভারতীয় মহাজাতির অংশ হয়ে বাস করতে। কিন্তু বাংলা ভাষী মুসলমানরা চেয়েছেন একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গড়তে। বাংলাদেশে বাংলা ভাষী মুসলমান কেবলমাত্র একটি ধর্ম সম্প্রদায় নয়। তারা হলেন এ দেশের বাস্তব ভিত্তি। তাই মনে করা হচ্ছে, তাদের যদি ইসলাম বিরূপ করে তোলা যায় তবে বাংলাদেশকে জুড়ে দেওয়া সম্ভব হতে পারবে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে। এই বিশেষ রাজনীতি কাবু করে তুলেছে এই উপমহাদেশের পূর্বাঞ্চলে। অন্যদিকে বাংলাদেশ হওয়ার পর উত্তর-পূর্ব ভারতের অঙ্গ রাজ্যগুলো স্বাধীন হতে চাচ্ছে, তাই বাংলাদেশ একটা পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিরাজ করুক সেটা চাচ্ছে না হিন্দুত্ববাদী ভারত। তাই এ দেশে ভারতপন্থিরা নেমেছে ইসলামবিরোধী প্রচারে। এর সঙ্গে এখন আবার যোগ দিয়েছে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল। ১৯৭১ সালে ভারতের মতো ইসরাইলও চেয়েছিল সাবেক পাকিস্তানকে ভেঙে দিতে। ভারতের পূর্ব কমান্ডের একজন জেনারেল, জেএফআর জ্যাকব ছিলেন ইহুদি। তিনি কেবল ইহুদি ছিলেন না, ছিলেন গোড়া জায়নবাদী। তিনি ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করেছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের সাথে। কিন্তু ইন্ধিরা গান্ধী এসময় চাননি, ইসরাইল সরাসরিভাবে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে সাহায্য করুক। জ্যাকব, যিনি পরে হন লেফটেন্যান্ট জেনারেল, তিনি জন্মেছিলেন কলকাতায়। তাই তিনি বাংলা ভালো জানতেন। অনেক বছর পরে বাংলাদেশ সরকার তাকে প্রদান করে বীরউত্তম উপাধি। তিনি রমনা ময়দানে অনুষ্ঠিত এই সম্মান নেয়ার সময় দাঁড়িয়ে জনতাকে সালাম দিয়ে বলেছিলেন ‘জয়বাংলা’। জ্যাকব এখন বেঁচে নেই কিন্তু কলকাতায় আছেন তার অনুসারী কিছুসংখ্যক ইহুদি। তারা নানাভাবে চাচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষের মুসলিম স্বাতন্ত্র্য চেতনাকে বিনষ্ট করতে। এ ছাড়া শোনা যাচ্ছে, ঢাকায় ইসরাইল থেকে বেশ কয়েকজন ইহুদি এসেছেন। এরা ঢাকায় বাস করছেন বেনামে। অর্থ নিয়োগ করতে চাচ্ছেন আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পে। ইহুদিরা প্রচুর অর্থ প্রদান করেছেন আমাদের একটি দৈনিক সংবাদপত্রকে। এই পত্রিকাটি চিন্তার স্বাধীনতার নামে সুকৌশলে ব্লগারদের সমর্থন করে চলেছে অর্থাৎ বাংলাদেশে ইসলামবিরোধী প্রচারণায় যেমন আছে এ দেশের ভারতপন্থিরা তেমনি আবার আছে ইসরাইলের অর্থপুষ্ট চক্র। এটা দুঃখজনক হলেও সত্য। কিন্তু আমরা যদি এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন না হই তবে আমাদের দেশে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব পড়তে পারে ঝুঁকির মধ্যে। ইসলামে মুক্তচিন্তার সুযোগ যথেষ্ট আছে অন্য ধর্মের তুলনায়, কিন্তু তথাপি বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে ইসলাম হলো একটি গোড়া বিজ্ঞানবিরোধী ধর্ম। অথচ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ইসলাম ও বিজ্ঞানের মধ্যে তেমন কোনো বিরোধ নেই। এই না থাকার কারণে এক সময় মুসলিম বিশ্বে হতো জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা। অনেকের জানা নেই যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে (যারা সরকারি অনুদান পায়) সেখানে ডারউইন এর বিবর্তনবাদকে এখনো সত্য বলে পড়ানো চলে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে শপথ নিতে হয় বাইবেল ছুঁয়ে, যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলো সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ। মানুষ নিয়েই রাষ্ট্র, কোনো রাষ্ট্রের মানুষ যদি ধর্মনিরপেক্ষ না হয় তবে রাষ্ট্র কখনই পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে না। তা তার সংবিধান যতই ধর্মনিরপেক্ষ হোক না কেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তা হতে পারেনি। বর্তমানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় ধর্ম হয়ে উঠেছে একটি বিশেষ ইস্যু। প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ট ট্রাম্প করছেন মুসলিমবিরোধী প্রচারণা আর এর জন্য তিনি পেতে পারছেন যথেষ্ট জনপ্রিয়তা।
হাওয়ায় অনেক কথা ভাসছে। আমরা জানি না বাংলাদেশের ভবিষ্যতে কী আছে। তবে আমরা নিশ্চয়ই চাইতে পারি না যে, বাংলাদেশে একটা দ্বিতীয় সিরিয়ার মতো কোনো অবস্থার সৃষ্টি হোক। বাংলাদেশে চিন্তার স্বাধীনতা চাই কিন্তু স্বাধীনতা কোনো ক্ষেত্রেই সীমাহীন হতে পারে না। ধর্ম বিশ্বাসকে চিন্তার স্বাধীনতার অযথা আঘাত করে বিশৃঙ্খলা আনার পক্ষে নই। আজ প্রায় হাজার বছর হলো ইসলাম বাংলাদেশে এসেছে, এর সঙ্গে জড়িত আমাদের জাতিসত্তার আবেগ। এ দেশে ইসলামের আছে একটি ভিন্ন পরিচয়। আমরা এ পরিচয় বজায় রাখার পক্ষে। কেননা ইসলাম আমাদের জাতীয় স্বাধীনতার রক্ষা কবজ।
আমাদের জীবনযাত্রার মান কেবলমাত্র অর্থনৈতিক দ্রব্য ও সেবার সরবরাহের পরিমাণের ওপর নির্ভরশীল নয়। নির্ভর করে আমরা কী ধরনের ধারণার ওপর ভিত্তি করে তাদের ব্যবহার করতে চাচ্ছি তার ওপরও। ধর্ম, অর্থাৎ ইসলাম এখনও হলো আমাদের মূল্য-চেতনার প্রধান উৎস। ধর্মীয় আবেগ নিয়ন্ত্রিত করে চলেছে আমাদের জীবন প্রবাহকে এটা ভুলে গেলে ভুল হয়। বড় রকমেরই ভুল করা হয়। ইসলাম ও চিন্তার স্বাধীনতাকে বিচার করতে হবে এই একই প্রেক্ষিতে।

লেখক : গবেষক ও সাবেক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইসলাম ও চিন্তার স্বাধীনতা প্রসঙ্গে
আরও পড়ুন