Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিচিত্র ধারার গানের স্রষ্টা নজরুল

প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মোবারক হোসেন খান
কাজী নজরুল ইসলাম তিন হাজারেরও বেশি গান রচনা করেছেন। গানের সুরের ভেতর তিনি আত্মস্থ হতে পেরেছিলেন বলেই তিনি এত গান রচনা করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি গানকে তার ‘আত্মার উপলব্ধি’ বলে প্রত্যয়-দৃঢ় কণ্ঠে বলতে পেরেছিলেন। গান রচনার ক্ষেত্রেই নজরুলের প্রতিভার পূর্ণ স্ফুরণ ঘটেছিল। তার গান বাণী সৌকর্যে আর সুরবৈচিত্র্যে বাংলা গানের ভুবনকে করেছিল সমৃদ্ধ। সাহিত্য ও সংগীতের মধ্যে তুলনা করে নজরুল নিজেই স্বীকার করেছেন যে, গানেই তিনি শ্রেষ্ঠ। তার এই শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ তিন হাজারের বেশি গান রচনা।
নজরুল-প্রতিভা মূলত সংগীতকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। তার মনের অভিব্যক্তি সংগীতেই প্রকাশিত হয়েছে ফোয়ারার মতো। সংগীত রচনার ক্ষেত্রে তার লেখনী ছিল অবারিত। কোনো কষ্টকল্পনা নয়, স্বতঃপ্রণোদিতভাবে গানের পর গান রচনা করেছেন। একে তার অলৌকিক প্রতিভা বলে নিঃসন্দেহে গণ্য করা যায়। তাই নজরুল আর গান একে অপরের পরিপূরক। গান আর নজরুল অবিভাজ্য। গান রচনার ক্ষেত্রে গানের ভুবনের নানা দুয়ার তিনি উন্মোচন করেছেন। নানা ধারার গান রচনা করে সংগীতে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী মাত্রা সংযোজন করতে পেরেছিলেন। বিচিত্র ধারার গান রচনা তার অপরিসীম মেধা ও প্রতিভার পরিব্যাপ্তির কথাই প্রমাণ করে। কখনো সুরকে আত্মস্থ করে সেই সুরের ওপর বাণী সংযোজন করেছেন, আবার কখনও বাণী রচনা করে তাকে সুরে বন্দি করেছেন। বাণী, সুর, গান, নজরুল এক এবং অদ্বিতীয়।
নজরুলের আহরণ বা চয়নের শক্তি ছিল খুবই প্রবল। ফলে লোকসংগীত, উচ্চাঙ্গ সংগীত, বিদেশি সংগীত, ইসলামী সংগীত সর্বপ্রকার সুর থেকে তিনি তার প্রতিভার গুণে সুর ও বাণী গ্রহণ করে নিজের গানের সুর ও বাণীকে সমৃদ্ধ করেছেন।
নজরুলের গানকে মূলত দেশাত্মবোধক, মানবিক প্রেম, ভক্তিমূলক, প্রকৃতি ও হাসির গানÑ এই পাঁচটি পর্বে বিভাজন করা হয়ে থাকে, কিন্তু তার গানের স্বরূপ বিশ্লেষণ করলে এই বিভাজনের পর্ব আরো বিস্তৃতি লাভ করবে। সংগীতের রাজ্যে তার বিচরণ এত অবাধ ছিল যে, যে কোনো সুরকেই তিনি অনায়াসে আত্মস্থ করে নিতে পারতেন। পরে সেই সুরকেই বাণী সম্পদ দিয়ে গানে রূপান্তর করতেন। এর ফলে বাংলা গানের মূল ভাব বা ধারা মোটেই ব্যাহত হতো না। বরং তার অবারিত রচনার গুণে গানের ভুবনই সমৃদ্ধ হয়েছিল। একথা স্মর্তব্য যে, বাংলা গান মূলত ভাবের প্রকাশ। এই প্রকাশের বাহন সুর। ভাবকে সুর সংযোজনের মাধ্যমে হৃদয়গ্রাহী করে তুলতে পারার মধ্যেই সুরকার ও রচয়িতার মুন্সিয়ানা। নজরুল ছিলেন ভাব ও সুর সংযোজনের এক অভূতপূর্ব ¯্রষ্টা। নজরুলের অসামান্য প্রতিভার বলে মনের ভাব গানের কথায় প্রকাশ পেত স্বচ্ছন্দে। সেই রচনা তার সুরে হয়ে উঠত বৈচিত্র্যময়। তার সৃজনশীল ভাব বাণীর রূপ ধরে কাব্যে প্রস্ফুটিত হয়েছে, গানের রূপে এসে ঘটেছে পরিণতি। কাব্য ও সংগীত তার প্রচ- প্রাণশক্তির উৎস। নজরুল ছিলেন রোমান্টিক। বিদ্রোহী তো ছিলেনই। তবে তার গানে রোমান্টিকতার যে অপূর্ব ধারা প্রতিফলিত তা ভাস্কর্যের রূপ ধরে চিরজাগরূক হয়ে রয়েছে। তাই উল্লেখ করা হয়েছে, ‘কাব্যের ক্ষেত্রে যে রোমান্টিক ভাবরাজ্যের উদ্দামদোলা সার্থক কাব্যসৃষ্টির বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাই স্বাভাবিক ছন্দে লীলায়িত হয়ে সংগীত রচনার প্রকৃত সহায়ক হয়ে উঠেছে। রোমান্টিক ভাবাবেগের গাঢ়তা ও প্রাবল্যের সঙ্গে গানের সুরের অত্যাশ্চর্য মিলনে নজরুলের সংগীতমূলক প্রতিভা এক অপূর্ব সুন্দর সার্থক সংগীতরূপে প্রকাশিত হয়েছে।’
গানে নজরুল ছিলেন স্বচ্ছন্দ। তার সহজাতপ্রবৃত্তি গান রচনার ক্ষেত্রে তাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। তার গানের প্রতি অনুরাগের প্রকাশ ঘটে শৈশবকাল থেকেই। নজরুলকে বলা হয় আধুনিক সংগীতের অন্যতম পথিকৃৎ। কারণ আধুনিক গানের বাণী ও সুরের কারুকার্য তার সংগীতকে বাঙ্ময় করে তুলেছে। শুধু তাই নয়, তিনি উচ্চাঙ্গ সংগীতের সঙ্গে আধুনিকতার রস মিশ্রণ করে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেন। সে জন্যই তিনি ছিলেন উচ্চাঙ্গ ও আধুনিক সংগীতের যুগসন্ধিক্ষণের কবি ও সুরকার। সংগীতকে নতুন রূপে-রসে-গন্ধে-মাধুর্যে ভরে তুলে আধুনিকতার পথে পরিচালিত করেছিলেন নজরুল।
নজরুলের সৃষ্টি বাংলা গানের ভা-ারকে করে তুলেছে ঐশ্বর্যম-িত। গান রচনার সাথে সাথে তিনি তাতে সুরারোপ করে ফেলতেন। বাউল-ভাটিয়ালি-মারফতি-মুর্শিদি সুরে তার গান আপন বৈশিষ্ট্যে ছিল পূর্ণ। উচ্চাঙ্গ সংগীতের বিভিন্ন রাগ-রাগিণীর সংমিশ্রণেও তিনি বহু গান রচনা করেছেন।
নজরুল ছিলেন এক ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিভা। দেশ-বিদেশে নানা সুরের সমন্বয় ঘটিয়েছেন তার গানে। ফলে, তার রচিত গান হয়ে ওঠে সুর বৈচিত্র্যে মহিমান্বিত। এ জন্য তাকে কোনো কৃত্রিমতার আশ্রয় নিতে হয়নি। কারণ দুটো রীতির সঙ্গে তার ছিল ঘনিষ্ঠ পরিচয়। তাই এদের মিলন স্বাভাবিক নিয়মে করতে পেরেছিলেন। দেশজ সুর ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, সারি, জারির সঙ্গে উচ্চাঙ্গ সংগীতের ইমন, বেলাবল, জয়জয়ন্তী, টোড়ী, বেহাগ, দরবারি, পিলু, ছায়ানট, খাম্বাজের সঙ্গে আরব্য-পারস্য সুর নজরুলের গানে মূর্ত হয়ে উঠেছে চিরন্তনী রূপ ধরে।
গজল, বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ আমির খসরু যার ¯্রষ্টা, নজরুলের হাতে সেই গজল রূপ পেল বাংলায়। গজলের সুরে নজরুল রচনা করলেন বহু গান। নায়ক-নায়িকার প্রেম-বিরহের মধুর-করুণ রসের অভিব্যক্তি নজরুল একই মর্মস্পর্শী আকুলতা ও ¯িœগ্ধ স্বাভাবিক রূপেই পরিস্ফুট করেছেন বাংলা গজলে।
গান ও সুরকে বৈচিত্র্যময় করে তোলাই ছিল নজরুলের প্রধান উদ্দেশ্য। আর এখানেই তার বিশেষত্ব, তার শ্রেষ্ঠত্ব বিভিন্ন রাগ-রাগিণীকে ভেঙে সংমিশ্রণ করে নতুন সুর সৃষ্টি করেন। নজরুল তার রচিত গানে সেই সকল সুর প্রয়োগ করেন। তাছাড়া, বিভিন্ন রাগের সুরেও কবি গান লিখেছেন। দরবারি কানাড়া, মালকোষ, হিন্দোল প্রভৃতি রাগে রচনা করেছেন অসংখ্য গান।
নজরুল তার সুরারোপিত গানের স্বরলিপি করে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করতেন। এমনকি, নিজের রচিত কবিতায়ও তিনি সুরারোপ করেছেন।
নজরুলের সংগীত-জীবন সম্পর্কে অনেক আলোচক বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের একটি তথ্য এ প্রসঙ্গে প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন, ‘তারপর নিজে সে (নজরুল) গান রচনা করতে আরম্ভ করে- নিজের দেওয়া সুরে সে যখন নিজের গানগুলি একটার পর একটা গেয়ে যেতো তখন সেখানে যে পরিবেশের সৃষ্টি হতো তার কথা মনে হলে এখনো আনন্দ হয়। ... তারপর বাংলাদেশে নজরুল গানের পুষ্পবৃষ্টি করে গেছে- সে নিজে একজন বিশিষ্ট সুরজ্ঞও ছিল, তাই তার গানে এমন পরিপূর্ণ প্রাণসঞ্চার করতে একদিন নজরুলের গানে বাংলাদেশ আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল-তার নব নব সুরের মাধুর্যে ও মূর্ছনায়।’
বাংলা গান মূলত বাণীপ্রধান। ফলে বাণীর ভাবকে সমুন্নত রেখে গানে সুরারোপ করতে হয়। বাণীর সঙ্গে সুরের মিলন হলে সে গান হয়ে ওঠে অনিবর্চনীয়। নজরুল সৃষ্ট বাংলা গানগুলো তাই ছিল সৃষ্টির মাহাত্ম্যে মহৎ। নজরুল বাংলা গানের ঐতিহ্যের প্রতি একনিষ্ঠ ছিলেন।
তার গানে বাংলার ঐতিহ্য রূপায়িত হয়েছে পরিপূর্ণ রূপ পরিগ্রহ করে। তাই নজরুলের গান একদিকে যেমন বাণী সম্পদে সমৃদ্ধ, অন্যদিকে তেমনি সুরৈশ্বর্যে অদ্বিতীয়।
ড. সুনীল কুমার গুপ্ত কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা এবং গানের বাণী ও সুরের ওপর নিরীক্ষা চালিয়ে দেখেছেন যে, তার ভাষায় নজরুলের অধিকাংশ গানই সহজ, সরল ও স্বতঃস্ফূর্ত, ছন্দের বৈচিত্র্য, মিলের অভিনবত্বে অলঙ্কারের কারুকার্যে গানগুলো মনোমুগ্ধকর। নজরুলের কবিমন দুরন্ত, দুর্বার ও উচ্ছল। তাই তার কবিতা ভাবাবেগের প্রাবল্যে সাধারণত দীর্ঘ হয়ে পড়ে। কিন্তু এই ভাবাবেগ আশ্চর্যভাবে সংহত হয়েছে তার গীতাবলিতে। তার গানের স্বল্প পরিসরে এসেছে কখনো চমক-লাগানো তীক্ষèতা, কখনো হৃদয়-হারানো গভীরতা, আবার কখনো বা মন-কেড়ে-নেওয়া উচ্ছলতা। নজরুল তার গানে মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত প্রভৃতি ছন্দ অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন।
নজরুলের গানের ভা-ার ছিল উন্মুক্ত। নানা ধরনের গানে ভা-ার হয়েছে সমৃদ্ধ। ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে তিনি গান রচনা করেছেন। ধর্মের কূপম-কতা তাকে গান রচনায় কোনোরূপ বাধা দিতে পারেনি।
নজরুল রচনা করেছেন অসংখ্য ধর্মীয় গান। ইসলাম ধর্মের সর্বজনীন রূপ ফুটে উঠেছে তার রচিত সেসব গানে। তিনি লিখেছেন অজ¯্র মারফতি, মুর্শিদি, মর্সিয়া, হামদ-নাত, হজ-জাকাত, নামাজ-রোজা ও ঈদের গান। তেমনি আবার লিখেছেন বহু শ্যামাসংগীত। গান রচনার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে।
বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে নজরুল ছিলেন সোচ্চার। বিদেশি শাসনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত মানুষের প্রাণে নজরুলের দেশাত্মবোধক গান এনে দিয়েছিল নতুন আশার বাণী। নতুন এক পথের দিশা। নিদ্রিত বাঙালি জাতি জেগে উঠেছিল তার ঘুম-ভাঙানিয়া গানে। তিনি তার লেখনী নিয়ে দাঁড়ালেন মুটে-মজুর-কুলি চাষির পাশে। অত্যাচার, অনাচার, উৎপীড়নের বিরুদ্ধে তার গান ছিল বজ্রকঠিন প্রতিবাদ। তাই নজরুল ‘বিদ্রোহী কবি’ নামে পরিচিত। একটি বলিষ্ঠ আত্মপ্রত্যয় জাতির ও সমাজের অন্যায়-অত্যাচার, কুসংস্কার-অনাচারের বিরুদ্ধে তাকে বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলতে বাধ্য করেছিল। তিনি সুন্দর একটা সমাজ গড়ার লক্ষ্যে বিদ্রোহে ফেটে পড়েছিলেন। তার নির্মম কঠোর আঘাতে রাজার প্রাসাদ কম্পিত হয়েছে, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। বাংলার অসম সাহসী তরুণের দল তার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়েই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পরাধীনতার গ্লানি থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার দুরূহ কাজে ব্রতী হয়েছিল। মরণপণ বাজি রেখে দেশের জন্য কেড়ে এনেছিল স্বাধীনতা। নজরুল তাই মানুষের কবি, নির্যাতিতের কবি, সর্বহারা বেদনা-বিদগ্ধ চারণ-কবি। নজরুল তাই আমাদের দেশের স্বাধীনতার কবি। বাংলাদেশের জাতীয় কবি।
নজরুলের গানে জাতীয়তাবোধের বাণী সোচ্চারিত। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় রচিত নজরুল ইসলামের কোরাস গান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জনগণের স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের আকাক্সক্ষা কোরাস গানে মূর্ত হয়ে উঠেছে। ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার’, ‘টলমল টলমল পদভরে’, ‘অগ্রপথিক হে সেনাদল’, ‘দুরন্ত দুর্মদ প্রাণ অফুরান’, ‘চল চল চল’, ‘এই শিকল-পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল’, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানগুলো মুক্তিসংগ্রামের উদ্দীপনার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তাই নজরুল জাগরণের কবি। তার অগ্নিঝরা লেখা ঝিমিয়ে পড়া তারুণ্যকে প্রচ- আঘাতে জাগ্রত করেছে। বলিষ্ঠ ও বেপরোয়া জীবনের প্রতীক যেমন গীতিকার নজরুল, বেহিসাবী ও অবারিত যৌবনের প্রতীকও তেমনি নজরুল। দেশ ও সমাজের বুক থেকে সকল অন্যায়-অবিচারকে ভস্মীভূত করার জন্যই তিনি অগ্নিবীণা আর বিষের বাঁশিতে সুরের আগুন জ্বেলেছিলেন।
নজরুলের জীবন, সাহিত্য আর গান একসূত্রে গাথা। নিজের আদর্শ ও চিন্তা-ভাবনাকে সমগ্র জীবনের মাধ্যমে রূপায়িত করার এমন সার্থক প্রয়াস দুনিয়ার আর কোনো কবির মধ্যে পাওয়া যায় না। দেশের প্রতি ভালোবাসা কবিকে বিদ্রোহী করে তুলেছে। স্বাধীনতার জয়গান তার গান কাব্যসাহিত্যকে মহীয়ান করেছে। স্বদেশ প্রেমের জ্বলন্ত স্বাক্ষর তার জীবনের উজ্জ্বল ও দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। বাংলা মায়ের আদর্শ রূপ তার গানে রূপায়িত হয়েছে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে। দেশভক্তির প্রতিচ্ছবি তার গানে তিনি রূপ দিয়েছেন নিষ্ঠার সাথে। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত : ‘আমার শ্যামলাবরণ বাংলা মায়ের রূপ দেখে যা, আয়রে আয়’। তিনি মিশ্র সুরে লিখেছেন, ‘জননী জন্মভূমি, তোমার পায়ে নোয়াই মাথা।’ আমার দেশের মাটি বাউল গানটিতে দেশপ্রেমের কথা কবি বলেছেন, ‘আমার দেশের মাটি, ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি’।
নজরুল দিলেন বিদ্রোহের মন্ত্র। বিদ্রোহের অগ্নিস্ফুলিঙ্গে তিনি দেশের প্রতিটি নারী-পুুুরুষকে জাগিয়ে তোলার ব্রত নিয়েছিলেন। নতুন ঢংয়ে গান লিখে সৈনিকের পায়ের তালের ছন্দ তুলে মার্চের সুরে সেই গান সুরারোপিত করেছেন। বাংলাদেশ তার রচিত সেই ‘চল চল চল’ গানটিকে রণসংগীতের মর্যাদা দিয়েছে।
কাজী নজরুল ইসলাম গান লেখার জন্য একটা প্রবল তাগিদ অনুভব করতেন। তাই তিনি যখনই কলম ধরেছেন আপনগতিতে গান রচিত হয়েছে। গল্প মজলিসের আসরে, হট্টগোলের মাঝে, গ্রামাফোন কোম্পানির রেকর্ডিংয়ের স্টুডিওতে বসে যখন যেভাবে ফরমায়েশ পেয়েছেন গান লিখে দিয়েছেন দুহাত উজাড় করে। তার হাতে যেন জাদু ছিল। যা স্পর্শ করেছেন গানের সোনা হয়ে গেছে। নজরুল সম্পর্কে নারায়ণ চৌধুরী যথার্থই লিখেছেন, ‘নজরুল সত্তায় যেন এক অফুরন্ত সৃষ্টির সঞ্চয় লুকানো ছিল, রূপকথার কল্পবৃক্ষে ঝাড়া দিলে যেমন তার থেকে সোনা রূপা ঝরে পড়ত, তেমনি তার গানের গাছে নাড়া দিলেই চাইতে না চাইতে রকমারি গানের ফল টুপ করে খসে পড়ত। সংগীতের ক্ষেত্রে নজরুল এক অদ্ভুত সৃষ্টিশীল প্রতিভা। নব নবোন্মেষশলিনী সুর সৃজনের প্রতিভায় তার তুলনা, তার আর কোনো দোসর নেই।’
নজরুলের সৃজনশীল প্রতিভা তাকে নব নব সৃষ্টিতে অনুপ্রেরণা জোগাতো। সেই অনুপ্রেরণাতেই তিনি সংগীতের ভুবনে এক সম্পূর্ণ নতুন ধারা গানের প্রবর্তন করেন। তিনি ইসলামী সংগীতের ধারা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে সংগীতের ভা-ারকে সমৃদ্ধ করেছেন। বাণী আর সুরেরর ঐশ্বর্যে তার রচিত ইসলামী গান অনন্য। আর এ গানের ভেতর দিয়েই তিনি ঘুমন্ত বাঙালি-মুসলমানদের নিদ্রা ভাঙিয়ে নতুন জাতীয় ও অগ্রগতির অনুপ্রেরণা ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।
নজরুল হাসির গান রচনায় ছিলেন খুবই সিদ্ধহস্ত। তার হাসির গানগুলো দারুণ উপভোগ্য। গান গাওয়ার সুরে সুরে যেন হাসিটি ফুটে উঠেছে জ্যান্ত হয়ে। প্রাণবন্ত এই গান ঢংয়ের দিক থেকে একেবারে আনকোরা নজরুলের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যম-িত।
ব্যঙ্গাত্মক গান রচনাতেও নজরুল ছিলেন অদ্বিতীয়। রাজনীতিক ও সমাজচেতনামূলক গানের বাণী ও সুর নজরুলকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল। তার গানে স্যাটায়ার, আইরনি, ফান এবং উইট ছিল খুবই উপভোগ্য। কৌতুক, রঙ্গরস, শ্লেষ, তামাশা তার গানগুলোকে প্রাণরসে সিঞ্চিত করেছে। নজরুলের রচনা-দক্ষতার গুণেই তা সম্ভব হয়েছিল।
মানবিক প্রেম সম্পর্কিত গান রচনায় নজরুল ছিলেন অতুলনীয়। প্রেমের বিরহ, ব্যর্থতা, আশা, নিরাশার অনুভূতি প্রকাশে নজরুলের জুড়ি ছিল না। প্রেমের বিরহের বিচিত্র অভিব্যক্তি প্রতিফলনে তিনি ছিলেন অবিসংবাদিরূপে কৃতিত্বের অধিকারী। ‘নিরালা কানন পথে কে তুমি চলো একেলা’, ‘গানগুলি মোর আহত পাখির সম’, ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি’, ‘পাষাণের ভাঙালে ঘুম কে তুমি সোনার ছোঁওয়ায়’ গানগুলো বাণী ও সুরৈশ্বর্যে অনবদ্য। প্রেম-সংগীত রচনাতেও নজরুল ছিলেন সমান পারদর্শী। গজল গানে তো ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। নজরুলের প্রেমের গানগুলো কাব্যগীতিধর্মী।
নজরুলের প্রেম সংগীত পার্থিব প্রেম-বিরহ, আনন্দ-বেদনা জাগতিক গুণে সমৃদ্ধ। তাই তার প্রেম সংগীত পরিপূর্ণরূপে তরতাজা নরনারীর প্রেমকাব্য। তার প্রেম সংগীতের কয়েকটা নমুনা উদ্ধৃত করা হলো : ‘কে এলে মোর ব্যথার গানে’, ‘অয়ি চঞ্চল লীলায়িত দেহ’, ‘জানি জানি প্রিয় এ জীবনে মিটিবে না সাধ’, ‘বিদায়ের বেলা ঘনায়ে আসে’ ইত্যাদি
নতুন সৃষ্টির মহান ব্রত গ্রহণ করেছিলেন নজরুল। নির্ঝরিণী, বেনুকা, মিনাক্ষী, বনকুন্তলা, সন্ধ্যামালতি, দোলনচাঁপা প্রভৃতি রাগ সৃষ্টি তার ¯্রষ্টা মনের পরিচয়ই বহন করে। এ প্রসঙ্গে কবির মন্তব্য উদ্ধৃত করা হলো : ‘বেনুকা’ ও ‘দোলনচাঁপা’ দুটি রাগ আমার সৃষ্টি। ... কোনো রাগ বা রাগিনীর সঙ্গে অন্য রাগ বা রাগিনীর মিশ্রণ ঘটাতে হলে সংগীতশাস্ত্রে সূক্ষ্ম জ্ঞান বা রসবোধের প্রয়োজন। রাগ-রাগিনী যদি তার গ্রহ ও ন্যাস এবং বাদী-বিবাদী ও সমবাদী মেনে নিয়ে সেই রাস্তায় চলে তাহলে তাতে কখনো সুরের সামঞ্জস্যের অভাব বোধ হবে না। তিনি আরো বলেছেন, ‘ক্ল্যাসিকাল ও উচ্চাঙ্গ সংগীতে যে অভিনব রসসৃষ্টি হতে পারে, মানুষের মনকে ‘মহতো মহিয়ান’ করতে পারে তা আধুনিক সুরের একঘেয়ে চপলতায় সম্ভব হতে পারে না। আর যারা মনে করেন হিন্দি ছাড়া বাংলা ভাষায় খেয়াল ধ্রুপদ ইত্যাদি গান হতে পারে না, আমার এই গান দুটির স্বরসমাবেশ ও তালের লয়ের ও ছন্দের ‘কর্তব্য’ তাদের সে ধারণা বদলে দেবে। গানের ‘আঙ্গিক’ বা মিউজিক্যাল টেকনিক বজায় রেখেও এই শ্রেণীর গান কত মধুর হতে পারে আশা করি আমার এই গান দুটিই তা প্রমাণ করবে।’ ‘বেণুকা’ রাগে তার রচিত গানের কলি : ‘বেণুকা ও কে বাজায় মহুয়া বনে’, ‘কেন ঝড় তোলে তার সুর আমার মনে’। এবং ‘দোলনচাঁপা’ রাগে রচিত গানের কলি : ‘দোলনচাঁপা বনে দোলে, দোল-পূর্ণিমা রাতে চাঁদের সাথে/শ্যাম পল্লব-কোলে যেন দোলে রাধা, লতার দোলনাতে’।
নজরুল অনেক গান নিজের কণ্ঠে রেকর্ড করেছেন। এত গান রেকর্ড করতে অতীতে কোনো কবি পারেননি। নজরুল তার সমসাময়িক যে কোনো কবির চেয়ে অনেক বেশি গান রচনা করেছেন।
নজরুলের জীবন ছিল অত্যন্ত পরিপূর্ণ। তার বৈচিত্র্যময় জীবনের মতোই সংগীত-ভা-ারকেও তিনি এক বিচিত্র সমাহারে উদ্ভাসিত করে তুলেছিলেন। তাই সংগীত জগতে নজরুল অনন্য ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। গান সম্পর্কে নজরুলের সুস্পষ্ট মন্তব্যই তার প্রমাণ : ‘আপনারা আমার কবিতা সম্পর্কে যা ইচ্ছা হয় বলুন কিন্তু গান সম্পর্কে নয়। গান আমার আত্মার উপলব্ধি।’
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিচিত্র ধারার গানের স্রষ্টা নজরুল
আরও পড়ুন