বর্ষপূর্তির কবিতা
ভালোবাসো মন খুলেআ ল ম শা ম সবৈশাখী ঝড়ে উড়ে গেছে চালবর্ষার বৃষ্টিতে ডুবে গেছে ঘরভাদ্রের বন্যায় ভেসে গেছে বাড়ি।তুমি শুধু একা।ভয় শংকায় হারিয়ে গেছে
আ. শ. ম. বাবর আলী
বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে কাজী নজরুল ইসলামের আগমন তখনই, যখন গোটা বাংলা সাহিত্য রবীন্দ্র প্রভাবে প্রভাবিত। সে প্রভাব কাটিয়ে নতুন কোনো প্রতিভার বিকাশ তখন ছিল রীতিমতো অসম্ভব ব্যাপার। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বকবি। অথচ এই বিশ্বেরই একটি উল্লেখযোগ্য এবং সম্মানিত জাতি মুসলমান তার সাহিত্যে তেমন উল্লেখযোগ্যভাবে স্থান পায়নি।
মুসলমানদের, বিশেষ করে বাংলার মুসলমানদের এক দুর্যোগময় অসহায়ত্বের দিনে বাংলা সাহিত্যের আকাশে ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ঘটল কাজী নজরুল ইসলামের। সর্বহারা মুসলমানদের অভয়মন্ত্র সাথে নিয়ে তিনি এলেন বাংলার মুসলিম ভুবনে। শোনালেন জাগরণী গান।
কিন্তু বাংলা সাহিত্যে নজরুলের এ দিগি¦জয়ী আগমন অনেকেই সহ্য করতে পারল না। অনেকের কাছেই তিনি হলেন চক্ষুশূল। তৎকালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকাটি যেন জীবনপণ করে লেগে গেল নজরুলের বিরুদ্ধে। সে সময় দেখা গেছে, পত্রিকাটির এমন কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে, যাতে শুধু নজরুলের শাপান্ত ছাড়া আর কিছু থাকত না।
তার লেখা প্রথম ইসলামী গান ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’ এবং ‘ইসলামের ওই সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর’ যখন মরমী শিল্পী আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে গ্রামোফোনে রেকর্ড হয়ে বাজারে বের হলো, তখন বাঙালি মুসলমানদের মনে সে কী প্রাণের জোয়ার! দীর্ঘদিনের ঘুমন্ত নির্জীব মুসলমানরা যেন হঠাৎ করে জেগে উঠল নতুন কোনো এক জীয়নকাঠির পরশে। অনেক প্রতীক্ষার পর অনেক ক্লান্তি শেষে তারা যেন কাছে পেল তাদের নব মুক্তিদাতাকে।
নজরুলের লেখা যে ইসলামী গান গোটা বাঙালি মুসলমানদের প্রাণে এমন করে সাড়া জাগাল, তার সে গান রেকর্ডিং করতে প্রবলভাবে আপত্তি জানালো কোম্পানি। তাদের কৈফিয়ৎ, এদেশের মুসলমানরা গান শোনে কম। গ্রামোফোনের সংখ্যাও তাদের কম। তাই তাদের কাছে রেকর্ড বিক্রি করে যে টাকা আসবে, তাতে গ্রামোফোন কোম্পানির পোষাবে না। তাকে প্রথমে হিন্দু সমাজে জনপ্রিয় হতে হবে। তাই তিনি শুরু করলেন কীর্তন আর প্রেমের গান লিখতে। তার লেখা অধিকাংশ প্রেমের গান রেকর্ড হতে থাকল আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে।
কিন্তু এখানেও হিন্দু সমাজের আপত্তি। নজরুলের এসব গানকে তারা মনে-প্রাণে গ্রহণ করলেও তাদের আপত্তিÑ ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ নামের একজন মুসলমান গীতিকার এবং ‘আব্বাসউদ্দীন আহমদ’ নামের একজন গায়ককে নিয়ে।
এবারও নজরুলের অন্য পথ। গীতিকারের নাম রাখা হলো গোপন। নিজের রচিত গান গাওয়াতে থাকলেন তিনি কাশেম মল্লিককে দিয়ে। কিন্তু কে. মল্লিক নামে। তৎকালীন হিন্দু শ্রোতারা কে. মল্লিক বলতে কুমুদ মল্লিক বলেই জানত। এতে করে নজরুলের গান জনপ্রিয়তার শীর্ষে। কে. মল্লিক সবচেয়ে প্রিয় শিল্পী।
এবার পথ খুঁজে পেলেন নজরুল। একটা দুটো করে ইসলামী গান গাওয়াতে শুরু করলেন কে. মল্লিককে দিয়ে। প্রথমে বে-নামে। পরে স্বনামে। এমনিভাবে ক্রমে ক্রমে একদিন নজরুল দারুণভাবে পরিচিত হয়ে উঠলেন গোটা বাঙালি সমাজে।
নজরুল ইসলাম গজল বা ইসলামী গান লিখেছেন অসংখ্য। এগুলোর শ্রেষ্ঠত্ব যেমন রচনাশৈলীতে, তেমনি এর বিষয়বস্তুতে। বস্তুত এমন মর্মস্পর্শী আত্মনিবেদিত গজল আজও পর্যন্ত আর একটিও সৃষ্টি হয়নি দ্বিতীয় কোনো রচয়িতার হাতে। তার লেখা অসংখ্য গজল গানের মধ্যে সর্বপ্রথম উল্লেখ্য হাম্দসমূহ। পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে নিবেদিত এই হাম্দগুলোর তুলনা নেই। এগুলোতে আল্লাহর ওপর তার একান্ত নির্ভরশীলতার স্বাক্ষর রয়েছে। তার লেখা ‘রোজ হাশরে আল্লাহ আমার করো না বিচার’, ‘যে পেয়েছে আল্লাহর নাম’, ‘অন্তরে তুমি আছো চিরদিন’, ‘তুমি অনেক দিলে খোদা’, ‘কারো ভরসা করিসনে তুই এক আল্লাহ ভরসা ছাড়া’, ‘মাগো আমায় শিখাইলি কেন আল্লাহর নাম? জপিলে আর হুঁশ থাকে না ভুলি সকল কাম’ প্রভৃতি হাম্দগুলো যখন আমরা শুনি, তখন গোটা প্রাণটাই উদ্বেলিত হয়ে ওঠে পরম প্রভুর প্রতি আত্মসমর্পণের আকুলতায়।
এরপর না’ত। বিশ্বনবী হযরত রাসূলে আকরম (সা.)কে নিয়ে অসংখ্য গজল তিনি লিখেছেন। এগুলোতে রাসূলের (সা.) প্রতি তার প্রবল মহব্বতের স্বাক্ষর বর্তমান। তার লেখা ‘আমার ধ্যানের ছবি হযরত’, ‘শরণ নিলাম নবীজির মোবারক পায়’,‘দূর আরবের স্বপন দেখি’, ‘মদিনায় যাবি কে আয়’, ‘রাসূল নামের ফুল এনেছি গাঁথবি মালা কে?’, ‘এ কোন মধুর শরাব দিলে আল-আরাবি সাকী’ ইত্যাদি না’তগুলোর তুলনা বাংলা কেন, বিশ্বের কোনো সাহিত্যে নেই।
এ ছাড়াও তিনি লিখেছেন অজ¯্র মুর্শিদী, মারফতি গান।
কাজী নজরুল ইসলাম নিজে একজন মুসলমান। এটা তার অমিত গর্ব। তাই নিজের গর্বিত লেখনীতে তিনি বললেনÑ ‘ধর্মের পথে শহীদ যাহারা, আমরা সেই সে জাতি’। এ গর্ব নিয়ে কবি অযুত শক্তিতে বলীয়ান। বিশ্বের সকল শক্তির মধ্যে শ্রেষ্ঠ শক্তিধর তিনি। তার এ পরাক্রমী শক্তির উৎস সম্পর্কে তিনি বলেনÑ ‘আল্লাহ আমার মাথার মুকুট, নবী গলার হার’। কবি জন্মসূত্রে যেমন মুসলমান, তেমনি মুসলমান হিসেবেই তিনি মৃত্যুবরণ করতে চান। এমনকি মরণের পরেও চান ইসলামের পরশ নিয়ে ভূলুণ্ঠিত হতে। তাই তার একান্ত আর্তিÑ ‘মসজিদের পাশে আমার কবর দিও ভাই, যেন গোরের মাঝে থেকেও আমি মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।’ অর্থাৎ কবি জীবনে ও মরণে ইসলামকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চান।
কিন্তু মুসলমানদের অধঃপতন দেখে কবিচিত্ত দারুণভাবে ব্যথিত। ইসলামের এ অবমাননা কবির কাছে চরম শংকাজনক। তাই শংকিত ও ব্যথিত কণ্ঠে কবির প্রশ্ন- ‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান?’ আল্লাহর প্রতি ঈমানের অভাবই মুসলমান সমাজকে আজ দুর্বল করে দিয়েছে। কিন্তু এ দুর্বলতা থেকে মুক্তির কি কোনো পথ নেই? কবি নিজেই সে পথের সন্ধান দিয়েছেন। তিনি বলেনÑ ‘সোজা পথে চলোরে ভাই, ঈমান রাখো ধরে’, ‘নামাজ পড়ো, রোজা রাখো, কলেমা পড়ো ভাই’, ‘দে যাকাত দে’Ñ ইসলামের এসব মূল আদর্শকে পুনরায় আঁকড়ে ধরতে পারলেই মুসলিম পুনর্জাগরণ সম্ভব।
মুসলমানরা একদিন ছিল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাতি। অনেক বড় বড় ত্যাগী মুসলিম বীর পুরুষের সাধনায় এ শ্রেষ্ঠত্ব এসেছিল। অর্থাৎ মুসলমানদের রয়েছে অনেক গর্বিত ঐতিহ্য। নজরুল ইসলাম উপলব্ধি করলেন, আজকের অধঃপতিত মুসলমান সমাজকে জাগিয়ে তোলার জন্য প্রয়োজন সেইসব ঐতিহ্য সৃষ্টিকারী মহাপুরুষদের বীরত্বব্যঞ্জক কাহিনীকে তাদের সামনে নতুন করে তুলে ধরা।
তাই বজ্র প্রত্যয়ে তিনি লিখলেনÑ ‘খালেদ’, ‘উমর ফারুক’, ‘চিরঞ্জীব জগলুল’, ‘আনোয়ার পাশা’, ‘শাত-ইল আরব’ প্রভৃতি কবিতা। বলাবাহুল্য, তার এ প্রয়াস সার্থক হয়েছিল। এ কবিতাগুলো তৎকালীন মুসলিম সমাজে এক দৃঢ় সঞ্জীবনী সৃষ্টি করেছিল।
ইসলাম ধর্মের প্রতি অকৃত্রিম মমত্ববোধের ফলে তার হাতে ‘রুবায়াত-ই-উমর খৈয়াম’, ‘দেওয়ান-ই-হাফিজ’ আর ‘কাব্যে আমপারা’র মতো এমন সার্থক অনুবাদকর্ম সম্ভব হয়েছে।
কবিতার ভাষাতেও নজরুলের ইসলামী মানসিকতার স্বাক্ষর বর্তমান। তৎকালে ফার্সি ছিল মুসলমানদের ভাষা। নজরুল ইসলামই সর্বপ্রথম বাংলা কবিতায় এই ফার্সি ও আরবি শব্দের ব্যবহার প্রবর্তন করেন। আর তা অতি দক্ষতাপূর্ণ এবং সার্থকভাবেই।
আরব দেশ বিশ্ব মুসলিমদের ধর্মীয় চিন্তার কেন্দ্রভূমি। আরব দেশের কৃষ্টিও তিনি আমদানি করলেন বাংলার মুসলমান সমাজে। বাংলার সংস্কৃতি অঙ্গনে তিনিই প্রথম রচনা করলেন আরবি নৃত্যসঙ্গীতের ছন্দে ‘মোমের পুতুল মোমের দেশের মেয়ে নেচে যায়’, ‘শুকনো পাতার নূপুর বাজে দুরন্ত ঘূর্ণিবায়, ‘রুম ঝুম ঝুম, রুম ঝুম ঝুম’ প্রভৃতি নৃত্যসঙ্গীত।
অর্থাৎ বাঙালি মুসলিম সমাজকে পুনর্জাগরণের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তার সব কিছুই তিনি করেছেন অতি দক্ষতা, নিষ্ঠা এবং আন্তরিকতার সাথে। সম্পূর্ণ প্রতিকূল পরিম-লের মধ্যে থেকে ইসলাম ধর্মের পুনর্জাগরণে এ যে তার কত বড় কঠিন ও সার্থক সংগ্রাম ছিল, তা ভাবলে অবাক হতে হয়!
নজরুলের সমসাময়িক এক শ্রেণির কিছু সংখ্যক আলেম ব্যক্তি প্রথমে তাকে ‘কাফের’ বলে আখ্যায়িত করলেও পরে তার লেখা ইসলামী কবিতা পড়ে তাদের সে ভুল ভেঙে যায়। তার ওপর ক্ষিপ্ত একদল উগ্র আলেম তো তার মুখে তার লেখা ‘মহররম’ কবিতার আবৃত্তি শুনে কেদে জারজার হয়েছিলেন। এমনকি তার কাছে এসে ক্ষমা চেয়ে তাকে ধর্মগুরু বলে স্বীকারও করেছিলেন। সত্য কখনো চাপা থাকে না। সান্ত¦না এটাই।
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের জন্য কী দিয়ে গেছেন, তার হিসেব না করেও শুধু বাংলার মুসলমানদের জন্য তিনি যা দিয়েছেন, তারই হিসেব যদি আমরা করি, তবে তাতেই তিনি বাঙালি মুসলমানদের কাছে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।