Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নজরুলের পিতৃতুল্য ছিলেন অনল প্রবাহের কবি শিরাজী

প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

সৈয়দ শামীম শিরাজী
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম একজন নতুন রূপের, নতুন চরিত্রের, নতুন ছন্দধ্বনি, রূপকল্প, ভাবকল্প ও চিত্রকল্পের কবি। সুতরাং নজরুল ইসলামের সঙ্গে তুলনামূলক সাহিত্য বিচারে তার পাশে বাঙালি কবিদের মধ্যে কারও দাঁড় করানো খুবই কঠিন। তাহলে প্রশ্ন আসে নজরুল ইসলামের কি কোনো সাহিত্যিক পূর্বসূরি ছিলেন না, যার কাছে তিনি প্রত্যক্ষভাবে ঋণী? জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম যেহেতু রবীন্দ্রনাথকে কবিগুরু বলে উল্লেখ করতেন বা করেছেন বলে কেউ কেউ মনে করেন, নজরুলের কবিতায় রবীন্দ্রনাথের সুস্পষ্ট প্রভাব আছে; কিন্তু বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণী দৃষ্টি প্রয়োগ করলে নজরুলের কাব্যের বিষয় ও আঙ্গিকে রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ প্রভাব খুব কমই দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের একটা মিল ছিল, নজরুল রবীন্দ্রনাথের মতো বিরাট বৈচিত্র্যধর্মী প্রতিভা। তিনি রবীন্দ্রনাথের মতো কবিতা লিখেছেন, গান লিখেছেন, উপন্যাস ও ছোট গল্প রচনা করেছেন, প্রবন্ধ ও নাটক লিখেছেন, সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন এবং তিনি রবীন্দ্রনাথের মতো গায়ক এবং অভিনেতা। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার অন্য মিলÑ তিনি তারই মতো রোমান্টিক ও বিশ্বাসী। কিন্তু স্বভাব ও চরিত্রধর্মে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার গরমিলও অনেক। এ ক্ষেত্রে নজরুল জীবনের সঙ্গে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কিছু মিল পাওয়া যায়।
বলাবাহুল্য, কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তার পূর্বসূরি একজন মুসলিম মনীষী, সাহিত্যিক ও কবির অনেকখানি চারিত্র-সাদৃশ্য ও সামান্য বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। তিনি ‘অনল প্রবাহের’ কবি গাজী সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী। ‘নজরুল ইসলামের সাহিত্য ও কাব্য সৃষ্টির এবং কাব্য শিল্পরূপ নির্মাণের সার্থকতা ইসমাইল হোসেন শিরাজীকে অন্বেষণ করলে আমরা ব্যর্থ হব। কিন্তু নজরুলের কাব্যের ওজস্বিতা, জাগরণস্পৃহার উদ্দীপনা, বীররস সৃষ্টির প্রয়াস মুসলিম কবিদের মধ্যে আমরা ইসমাইল হোসেন শিরাজীর মধ্যেই প্রথম লক্ষ্য করি। নজরুলের সঙ্গে ইসমাইল হোসেন শিরাজীর প্রকৃত মিল উভয়ের বীর হৃদয়ের সাহসিকতার, ভাবোচ্ছ্বাসের এবং চারিত্রিক স্বভাবের। ইসমাইল হোসেন শিরাজী দেশপ্রেমিক, জাতিপ্রেমিক, স্বাধীনতাপ্রেমিক এবং ইসলামপ্রেমিক। ইসমাইল হোসেন শিরাজী ভাবোদ্দীপকমূলক সাহিত্য ও কাব্য সৃষ্টির দ্বারা বাঙালি মুসলমানকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আমরা নজরুল ইসলামকে অধিকতর উজ্জ্বলরূপে হলেও একই মানসচরিত্র নিয়ে আবির্ভূত হতে দেখি। গাজী শিরাজীর মানস-পুত্র যেমন নজরুল, তেমনি নজরুলের ভাষায় শিরাজী আমার পিতৃত্যুল।
১৮৮০ সালে শিরাজীর জন্মের ১৯ বছর পর অনিবার্যভাবেই যেন জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। আবার নজরুল যে বছর জন্মগ্রহণ করেন (১৮৯৯) সে বছরই কাকতালীয়ভাবে হলেও ‘অনল প্রবাহ’ প্রকাশিত হয়। নজরুল সদাসর্বদা সশ্রদ্ধ ছিলেন শিরাজী সাহেবের ওপর; ‘শিরাজী সাহেব ছিলেন আমার পিতৃত্যুল। ...তার সমগ্র জীবনই ছিল ‘অনল প্রবাহ’। আমার রচনায় সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গের প্রকাশ।’ এই অকৃত্রিম শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্যেও ফুটে উঠেছে এই দুই যুগনায়কের মানসলোক। আবার দুজনেরই প্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন প্যান ইসলামী আন্দোলনের প্রবক্তা সৈয়দ জামালউদ্দীন আফগানী। দুজনই তুরস্ক নিয়ে কাজ করেছেন। ইসমাইল শিরাজী বলকান যুদ্ধের সৈনিকদেও সেবা দেয়ার জন্য ছুটে গেছেন তুরস্কে। ফিরে এসে লিখেছেন গ্রন্থ ‘তুরস্ক ভ্রমণ’ (১৯১৩), প্রবন্ধগ্রন্থ ‘তুর্কি নারী জীবন’ (১৯২০), নজরুলও তুরস্ক নিয়ে কাজ করেছেন। লিখেছেন ‘তুর্ক নারীর ঘোমটা খোলা’ প্রবন্ধ। তার কবিতার নায়ক হয়ে এসেছেন ‘কামাল পাশা’, ‘আনোয়ার পাশা’। আবার গাজী শিরাজী সাংবাদিকতা করেছিলেন, নজরুলও একই পথে হেঁটেছিলেন। উভয়েই পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন, সম্পাদকও হয়েছিলেন।
দুই কবিই আবার লড়েছেন জাতির ভাগ্যোন্নয়নের জন্য। সর্বত্র ত্যাগ করেছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য। আবার কবিতা লেখার জন্য শিরাজীই আমাদের প্রথম কবি, যিনি ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন, কারাবরণ করেছেন (১৯১০)। রাজনৈতিক কারণে একজন জননেতা হিসেবে দ্বিতীয়বার জেলে গেছেন (১৯৩০)। নজরুলও শিরাজীর পরে আমাদের দ্বিতীয় প্রথম কবি যিনি কবিতার দায়ে জেল খেটেছেন। শিরাজীর অনল প্রবাহ বাজেয়াপ্ত করেছিলেন ব্রিটিশ সরকার, নজরুলেরও অনেক বই বাজেয়াপ্ত হয়েছে একই সরকার দ্বারা।
এই দুই যুগন্ধর কবির মিলের দিকটা শুরু বহিরঙ্গে নয়, অন্তরঙ্গের। দুজনেরই চেতনালোক উদ্ভাসিত হয়েছে পরিষ্কার রৌদ্র দ্বারা। আপসহীনতা তাদের রক্তে মাংসে। নজরুল যেমন সর্বদা শিরাজী অনুরাগী ছিলেন, শিরাজীও তেমনই কলম ধরেছেন নজরুলের পক্ষে। নজরুল লিখেছেনÑ সেই ঘোর দুর্দিনে শিরাজী সাহেব তাহাকে আশীর্বাদ করে অর্থোপহার পাঠিয়েছিলেন মানিঅর্ডার করে। নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দিন আহমদ লিখেছেনÑ ‘সকল বাঙালি মুসলমানের মতো ইসমাইল হোসেন শিরাজীর মানসপুত্র যে নজরুল ইসলাম ছিলেন সেটা মেনে নিতে কারও দ্বিধা থাকার কথা নয়। নজরুলের আবির্ভাবে শিরাজী উৎফুল্ল ও আনন্দিত হন। তার প্রতীভাকে অভিনন্দিত করতে তিনি তখনকার দিনের দশ টাকা পুরস্কারই শুধু পাঠাননি, শুধু বলেননি তার থাকলে তিনি তাকে (তখনকার সময়ের) দশ হাজার টাকা পুরস্কার দিতেনÑ নজরুলকে যখন ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে সংবর্ধনাদানের প্রচেষ্টা হয় এবং তাতে বাধা দেওয়ার দারুণ ষড়যন্ত্র চলে, তখন ইসমাইল হোসেন শিরাজী নজরুলকে সমর্থন করে ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের কার্তিকের ‘সওগাত’-এ মোহাম্মদী পত্রিকায় নজরুলকে সমর্থন করে যে পত্র লেখেন এবং তীব্র প্রতিবাদ জানান তাও অনুধাবনযোগ্য।
শাহাবুদ্দীন আহমদ যে পত্রের উল্লেখ করেছেন সেই পত্রের শেষাংশে শিরাজী লেখেন; ... ‘আমি অসুস্থ এবং বহু ছাত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তির সাহায্যের জন্য অনেক ঋণগ্রস্ত হইয়াছি। বড় দুঃখ আজ যদি টাকা থাকিত, তাহা হইলে কবিকে স্বর্ণমুকুটে সাজাইয়া আনন্দ লাভ করিতাম।’Ñ এই কথা বলে কবি শিরাজী নজরুল প্রতিভা অর্জনে নিজের সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম সমাজে হৃদয় অবস্থিত গভীর আনন্দে কথায় ব্যক্ত করেছেন। এই চিঠি অবশ্য নজরুলের চোখে পড়েছিল এবং তিনি জেনেছিলেন, তার পিতৃতুল্য পূর্বসূরি তাকে কি গভীর ¯েœহে গ্রহণ করেছিলেন। এ ¯েœহের ঋণ নজরুল ততধিক বিনয় ও কৃতজ্ঞতার মাধ্যমে যে পরিশোধ করার চেষ্টা করেছেন তার আলো-দৃপ্ত ভাষণটি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ‘... এ যেন হজ করিতে আসিয়া কাবা শরিফ না দেখিয়া ফিরিয়া যাওয়া’। বলাবাহুল্য, এই ঋণ পরিশোধের ঔধার্যের যে স্বভাব তারও সঙ্গে শিরাজীর ও নজরুলের মিল ও অভিন্নতা কারও দৃষ্টি এড়ায় না। শিরাজীর এই বক্তব্য কোনো সাধারণ মানুষের নয়। নজরুলের উদ্দেশে শিরাজীর হৃদয়োৎসারিত ভালোবাসা। এই ভালোবাসার মূলে রয়েছে দুজনের চেতনাগত, বিশ্বাসগত, লক্ষ্যগত মিলের দিকটি। সেজন্যই বলা খুব অপ্রাসঙ্গিক হবে না, শিরাজীর চেতনারই যেন বিকশিত রূপ আমরা দেখতে চাই নজরুলের মধ্যে।
গাজী শিরাজী ও নজরুলের কবিতার মধ্যেও দুজনের প্রায় একই রকম আবেদন দেখতে পাই। শিরাজীর বিখ্যাত কবিতা ‘অনল প্রবাহে’ লিখলেন,
আর ঘুমিও না নয়ন মেলিয়া,
উঠ রে মোসলেম উঠ রে জাগিয়া
আলস্য জড়তা পায়েতে ঠেলিয়া
পূত বিভু নাম স্মরণ করি।
শিরাজীর এই সরাসরি আবেদন নজরুলও প্রতীক (স্যাম্বল) ব্যবহার করে শিশু-কিশোরদের দিয়ে তিনি একই আবেদন জানালেন এভাবেÑ
ভোর হলো দোর খোল, খুকুমনি ওঠরে
ঐ ডাকে জুই শাঁখে, ফুল খুকি ছোট রে।
খুলি হাল তুলি পাল, ঐ তরী চলল
এই বার এই বার, খুকু চোখ খুলল।
আমরা অনেকেই কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা শুনেছি ও পড়েছি। কিন্তু একই আবেদনে লেখা শিরাজীর ‘পরিচয়’ কবিতা পড়িনি। নজরুলের বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতা যেমন সকলকে আলোড়িত, উত্তেজিত, অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করে, একইভাবে শিরাজীর ‘পরিচয়’ কবিতা বাক্য বিন্যাসে, ছন্দে, আবেগে, উচ্ছ্বাসে সকলের দৃষ্টি কাড়ে। এ কবিতায় শব্দের ঝংকার ছন্দ চয়ন কঠিনতম ভাষার উচ্চারণ ভাব এবং আবেদন প্রায় একইভাবে যেন প্রকাশ পায়। যতদূর জানা যায়, শিরাজীর ‘পরিচয়’ কবিতাটির পর নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি লেখা হয়েছে। যেটা অনেকেরই অজানা রয়ে গেছে। প্রায় আড়াইশত লাইনের এই ‘পরিচয়’ কবিতাটি মুখবন্ধক হলোÑ
বল ধীর, উদাত্ত কণ্ঠে আমি বীর মোছলমান,
আল্লাহ, ভিন্ন মানিনা অন্য আমি চির নির্ভীক প্রাণ।
আমি মৃত্যুর মাঝে চিরদিন খুঁজি নব জীবনের সন্ধান
আমি আগুনের হুল্কা, ঘূর্ণিত উল্কা খোদাই তেজে তেজীয়ান
বজ্র আমার কণ্ঠধ্বনি, বিদ্যুৎ আমার কণ্ঠহার,
অন্ধকারে আলোক আমি সমর ক্ষেত্রে সংহার।
ঝঞ্ঝার মাঝে ছুটি যাই আমি উড়ায়ে জয় নিশান
হিমাচল করি জলধিমগ্ন বাজায়ে প্রবলয় বিষাণ।
আমি সত্যের সেবক চির হক্্ দোস্ত,
ন্যায়ের মহাদ- মম করে ন্যস্ত।
সাধনা আমার অখিলের কল্যাণ
কামনা আমার বিশ্বের পরিত্রাণ।...
নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শুরু যেন একইভাবে।
বল বীর,
চির উন্নত মম শির,
শির নেহারী আমারই নত শির
ঐ শিখরই হিমাদ্রির ...
এরপর শুধু বলা যায়, দুজনই ছিলেন সৈনিক, দুজনই নারী শিক্ষার জন্য নিরন্তর কাজ করে গেছেন। শিরাজী ইসলামকে নারীর মুক্তিদাতা হিসেবে দেখেছেন এবং সে জন্যই মুসলিম নারীদের শিক্ষার জন্য তিনি বক্তৃতা দিয়েছেন, ওজস্বিনী ভাষায় প্রবন্ধ লিখেছেন এবং তাকে বাস্তবায়িত করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। স্ত্রী শিক্ষার ব্যাপারে ইসমাইল হোসেন শিরাজীর অভিমত ছিল : ‘এই পতিত জাতি বিশ্বনবীর নির্দেশ মতো যে পর্যন্ত না প্রতিটি নর-নারীকে শিক্ষিত করে তুলবে, সে পর্যন্ত এ জাতি পতনের অন্ধকার গহর থেকে উঠতে সমর্থ হবে না। কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলিম জাতিকে আরো অধঃপতনে ঠেলে দিচ্ছেন একশ্রেণীর তথাকথিত মোল্লা।’ শিরাজী স্মৃতি : আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ। এই দৃষ্টিভঙ্গির উত্তরাধিকার নজরুল যে পেয়েছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নজরুল ইসলামও যে একই ধরনের মনোভাব পোষণ করতেন তা তার নি¤েœাক্ত ভাষণ থেকে বোঝা যায় :
‘কন্যাকে পুত্রের মতোই শিক্ষা দেওয়া যে আমাদের ধর্মের আদেশ তাহা মনেও করিতে পারি না। আমাদের কন্যা-জায়া-জননীদের শুধু অবরোধের অন্ধকারে রাখিয়াই ক্ষান্ত হই নাই, অশিক্ষার গভীরতার কুপে ফেলিয়া হতভাগিনীদের চিরবন্দিনী করিয়া রাখিয়াছি।’ ... খোদার রাজ্যে পুরুষ আজ জালিম, নারী আজ মজলুম। ইহাদের ফরিয়াদে আমাদের এই দুর্দশা, আমাদের এই হীনবীর্য সন্তানের জন্ম। [অভিভাষণ : সিরাজগঞ্জের নাট্যভবন : ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৫ ও ৬ নভেম্বর।]
‘শিরাজীর মতো নজরুল ইসলামও জানতেন : ইসলাম নারীকে সম্মান দিয়েছে, মর্যাদা দিয়েছে, অত্যাচারী পুরুষের নিপীড়ন থেকে রক্ষা করেছে। বলদর্পী পুরুষের স্বার্থপরতা দিয়ে গড়া নির্যাতনের কারাগার থেকে তাকে মুক্তি দিয়েছে। সে জন্যই নজরুল ইসলাম লিখেছেন’Ñ
নারীরে প্রথম দিয়াছ মুক্তি সব সম অধিকার
পুরুষের গড়া প্রাচীর ভাঙিয়া করিয়াছ একাকার।
ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক তার ‘মুসলিম বাংলা সাহিত্য’-এ ইসমাইল হোসেন শিরাজীর পরিচয় দিতে গিয়ে এক স্থানে লিখেছেন, ‘স্ত্রী শিক্ষার জন্য তিনি জীবনপাত করিয়াছেন। তাহার ‘স্ত্রীর শিক্ষা’ জ্ঞানীর কল্পনা বিলাস নহে।’
ইসমাইল হোসেন শিরাজীর আর একটি মানসিক প্রবণতার সঙ্গে নজরুলের সাদৃশ্য আছে। সঙ্গীত পেয়েছিল দুজনকেই। সঙ্গীত শিরাজকে তেমন প্রতিষ্ঠা না দিলেও নজরুলকে দিয়েছিল শ্রেষ্ঠত্বের মহিমা। সাধারণ ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে ইসলাম সঙ্গীত হারাম। কিন্তু ইসমাইল হোসেন শিরাজী তা মনে করতেন না। ফলে তিনি নিজে সঙ্গীত রচনা করেছেন এবং সঙ্গীত শিক্ষার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন। আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ‘শিরাজী স্মৃতি’-তে লিখেছেন, “আলেম সমাজ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ফতোয়ার মারফত সৌন্দর্যের জন্য, আনন্দ উপভোগের জন্য মানুষের হৃদয়ের সহজাত আকাক্সক্ষার টুঁটি টিপে ধরেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে সে সুর মানুষের আত্মার খোরাকÑ সেই সুর সঙ্গীতকেই তারা হারাম বলে ফতোয়ার পর ফতোয়া জারি করেছে। অথচ আল্লাহর কেতাব আল-কোরআন সপ্তসুরে পাঠ করার ব্যবস্থা রয়েছে। শিরাজী সাহেব সঙ্গীত প্রচলনের জন্য আজীবন চেষ্টা করে গেছেন। তিনি শুধু তাই নয়, নিজ কন্যা সৈয়দা ফেরদৌস মহল শিরাজীকেও তিনি সঙ্গীত বিদ্যা শিক্ষা দিয়েছিলেন। সিরাজগঞ্জের কোন কোন বড় সভায় তাকে দিয়ে উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করাতেন। কোন কোন সভাতে তিনি নিজেও স্বরচিত সঙ্গীত গেয়ে তার বক্তব্যের অনুকূলে শ্রোতাদের উত্তেজিত করে তুলতেন।”
সুর সম্পর্কে নজরুলের বক্তব্য হলো : সুর কখনও খারাপ হয় না। খারাপ মানের পাত্রে পানি রাখলে সে পানি হয়তো দূষিত হয়, কিন্তু তাই বলে পানিকে দোষ দেওয়া যায় না। পানি মানুষের তৃষ্ণা মিটায়, মানুষের জীবন বাঁচায়; আবার বন্যা হয়ে মানুষের ধ্বংসও আনয়ন করে; তাই বলে পানিকে তো আমরা খারাপ বলতে পারিনে।... মানুষের মারফতে দুনিয়ার বুকে আল্লাহর রহম নিয়ে এসেছে। সুরও আল্লাহর রহমরূপে দুনিয়ায় নাজেল হয়েছে। [উস্তাদ জমীর উদ্দীন খাঁ]। অথচ এই সুরের বিরুদ্ধে সাধারণ মৌলভী মোলানারা ‘কুফরীর ফতোয়া’ দেন। নজরুল ইসলাম বলেন, ‘সঙ্গীত শিল্পের বিরুদ্ধে মোল্লাদের সৃষ্ট এই লোকমতকে বদলাইতে তরুণদের আপ্রাণ চেষ্টা করিতে হইবে।’
শিরাজীর সঙ্গে নজরুলের আরও একটি মিল হলো জাতীয় দুর্দিনে জাতির প্রতি একজন লেখকের দায়িত্ব-সচেতনতা। সুতরাং, আমরা দেখতে পাচ্ছি, মুসলিম জাগরণ, স্বাধীনতা আন্দোলন, কঠোর অবরোধ প্রথা-বিরোধিতা, নারী শিক্ষায় উৎসাহ-দান, সৈনিকত্ব গ্রহণ, সঙ্গীত ও সাহিত্যচর্চায় আত্মনিবেদন ও মুসলিম সমাজে সঙ্গীতচর্চা বর্ধনের চেষ্টাকরণ, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদান ও কবিতা লিখে কারাবরণ, বস্তনিষ্ঠ সাংবাদিকতা ইত্যাদি বিষয়ে নজরুল ইসলামের সঙ্গে তার জীবন চরিত্র ও আদর্শের সাদৃশ্য আছে এবং এসব ব্যাপারে তিনি নজরুলের প্রেরণাসঞ্চারী পূর্বসূরিও বটে।
নতুন সৃষ্টি প্রতিভা নিয়ে তার থেকে বেরিয়ে যেতে যারা সক্ষম হননি ইসমাইল হোসেন শিরাজী তাদেরই একজন। কিন্তু নজরুল ইসলাম সে ক্ষেত্রে একজন ক্ষমতাবান কাব্য আঙ্গিকের নতুন যুগের ¯্রষ্টা। তিনি শুধু প্রতাপশালী মধুসূদনের বিশাল ইন্দ্রজালকে ছিন্ন করেননি, পরাক্রমশালী রবীন্দ্র-মোহজালকেও ছিন্ন করে নিজস্ব সৌরম-ল সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। ইসমাইল হোসেন শিরাজীর বক্তব্য ছিল, কিন্তু সাহিত্যে নতুন যুগনির্মাতা হওয়ার শিল্পপ্রতিভা ছিল না। নজরুলের ছিল সেই অমর শিল্প-নির্মাণের প্রতিভা। ইসমাইল হোসেন শিরাজীর অনেক সাদৃশ্যের সঙ্গে নজরুল ইসলামের পার্থক্য শুধু একটাই। তাই শিরাজীর ‘সমগ্র জীবন তার কোনো একটি বিশিষ্ট এলাকার কীর্তির চেয়ে মহৎ ছিল’Ñ এ কথা দ্বিধাহীনচিত্তে মনে করা যেতে পারে।
লেখক : সাংবাদিক, কণ্ঠশিল্পী



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নজরুলের পিতৃতুল্য ছিলেন অনল প্রবাহের কবি শিরাজী
আরও পড়ুন