বর্ষপূর্তির কবিতা
ভালোবাসো মন খুলেআ ল ম শা ম সবৈশাখী ঝড়ে উড়ে গেছে চালবর্ষার বৃষ্টিতে ডুবে গেছে ঘরভাদ্রের বন্যায় ভেসে গেছে বাড়ি।তুমি শুধু একা।ভয় শংকায় হারিয়ে গেছে
জুবাইদা গুলশান আরা
কবি নজরুল এক জ্বলন্ত অগ্নিশিখা। শক্তির পরিপূর্ণতায় উজ্জ্বল এক মশাল। তার জীবন যেমন আকস্মিকতায় ভরা ছিলো শৈশব থেকেই, তেমনই ছিলো বিস্ময়কর। তার কবিত্বের আত্মপ্রকাশ ছিলো বৈপ্লবিক ও শক্তিমত্তার প্রতীক। তিনি যেন যৌবরাজ্যের রাজাধিরাজ।
বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামের খোলা প্রান্তর শৈশবের দারিদ্র্যপীড়িত জীবন যাপন। শিক্ষা ক্ষেত্রে বারবার স্থান বদল ছিলো তার ভাগ্যের লিখন। তার সম্পর্কে পরিবর্তন ছিলো এক অমোঘ সত্য। শৈশবে মাদ্রাসা-মক্তবে শিক্ষা গ্রহণ করেন তিনি। পরে অভাবের তাড়নায় মক্তবের শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করতে হয়। কাজী ফজলে আহম্মদের নির্দেশে লেটো দলের জন্য পালা গান লিখতেন কিশোর নজরুল। এ সব বিষয়ে তার কৃতিত্ব তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলো। নজরুলের স্বভাবজাত গুণ তাকে সবার কাছে স্নেহের পাত্র করেছিলো। মাথরুন হাইস্কুল এবং সিয়ারসোল হাইস্কুলে ছাত্র থাকাকালীন ১৯১৭ সালে ব্রিটিশদের বাঙালী পল্টনে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। কবির নিজের কথায়Ñ আমি ছিলাম স্কুলের ফার্স্ট বয়, হেড মাস্টারের আশা ছিলো, আমি স্কুলের গৌরব বাড়াবো। কিন্তু এ সময়ে এলো ইউরোপে মহাযুদ্ধ। একদিন দেখলাম এ দেশ থেকে পল্টন যাচ্ছে যুদ্ধে। আমিও যোগ দিলাম এই পল্টন দলে। বাঙালী পল্টনে যোগ দিয়ে কবিকে লাহোর হয়ে নৌশেরা যেতে হয়। কোয়েটা, করাচীর সেনা নিবাসে তার জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা তার অন্তর্লোকের সঙ্গে বাইরের বিশাল পৃথিবীর সঙ্গে তাকে পরিচয় ঘটিয়ে দেয়। উর্দু ফার্সী ভাষা তিনি আগেও জানতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তার জ্ঞানের পরিধি অনেক বেড়ে যায়। বিশ্বজনীন চেতনায় তার জ্ঞানপিপাসা যেন পথ খুঁজতে থাকে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তিনি স্বদেশে লেখা পাঠাতেন। তার রচিত বাংলা সাহিত্যের সম্ভবত প্রথম পত্রোপন্যাস বাঁধনহারা ঐ সময়েই রচনা করেন। তার পরিচয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে তিনি যুদ্ধশেষে দেশে ফেরার পরে। তিনি তখন লক্ষ্য করেন, বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে সারা বিশ্ব তখন অশান্ত। পরাধীন ভারতবর্ষ তখন স্বাধীনতার আকাক্সক্ষায় উদ্বেলিত, বিশ্ব জুড়ে হানাহানি চলছেÑ যে মুক্তি মানুষ চায় তার পথ কারো জানা ছিল না। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-বিক্ষোভ ও সন্ত্রাস কণ্টকিত সারা পৃথিবী। সৃষ্টি আবেগের কবি প্রথমে পত্রিকায় হাত দেন। পরবর্তীতে ১৯২১ সালে তার অন্তর্লোকের আবেগ ও শক্তির প্রবণতা নিয়ে বিদ্রোহী কবিতাটি রচিত হয়। সময়টা ছিলো ডিসেম্বর মাসের কোন এক সময়ে। বিজলী পত্রিকায় প্রকাশিত বিদ্রোহী কবিতা যেন এক অভূতপূর্ব বিদ্রোহের বার্তা নিয়ে সেই সময়ের যুব সমাজের সামনে উপস্থিত হয়। তখন সাহিত্য চর্চা ও গণজাগরণ ছিলো শক্তির আকাক্সক্ষায় উন্মুখ। প্রকৃত পক্ষে নজরুলের কাব্য, কবিতা, রাজনৈতিক মুক্তি-সংগ্রামের পথে যে প্রগাঢ় আবেগ সৃষ্টি করেছিলো, তা ছিলো অভাবিত। তার চিত্তে যে প্রবল শক্তির প্রকাশ ঘটে, তারই আহ্বান তখনকার যুব সমাজকে জাগিয়ে দেয়। “আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদচিহ্ন” এই প্রচ- বিদ্রোহ তার বিদ্রোহী কবিতায় যাত্রা শুরু করে সর্বস্তরের মানুষকে চমকিত করে। মানুষের প্রতি তার ভালবাসা বিশ্বমানবতার সঙ্গে এক অসামান্য আত্মীয়তা খুঁজে পায়। কবির যে সৈনিক জীবন, তার পটভূমিতে বিচার করলে দেখা যায়, কবি বিশ্বজুড়ে মানবতার আকাক্সক্ষার যে উত্থান, তা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সৈনিক জীবনের মধ্যে এক পাঞ্জাবী মৌলানার সঙ্গে পরিচয়ের মধ্য দিয়ে তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে হাফিজের কাব্যের। ফার্সী ভাষায় তার আকর্ষণের পাশাপাশি বিশ্বের মানবতাবাদী বহু কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে সাহিত্য পাঠের মধ্য দিয়ে পরিচয় ঘটে বৃহৎ বিশ্বের। রবীন্দ্রনাথ, ইয়েটস, গোর্কি, টলস্টয়, মাও সে তুং, লেনিন, বার্নার্ডশ’, বোনাভাঁতে অন্যদিকে ওমর খৈয়াম, রূমী, জামী, হাফিজ, ইকবাল ও অগ্রগণ্য মানবতাবাদী কবি-সাহিত্যিক ও দার্শনিকদের চিন্তা-চেতনা ও রচনার সঙ্গে তার পরিচয় ব্যাপকতর হয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাকে স্নেহ সম্ভাষণে ধন্য করেছিলেন। এই নজরুল শুধু বিদ্রোহী হয়ে ওঠেননি, সারা বিশ্ব, তথা তৎকালীন ভারতবর্ষের জীবন যাত্রার মধ্যে যে ধর্মান্ধতা, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও মনুষ্যত্বের অবমাননা চলছিলো, তার বিরুদ্ধে তিনি যেন নতুন করে সাহিত্য যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
‘‘বাজিছে দামামা, বাঁধরে আমামা
শির উঁচু করি মুসলমান,
দাওয়াত এসেছে নয়া জামানার,
ভাঙা কেল্লায় ওড়ে নিশান।”
একদিকে ভারতবর্ষের নবজাগরণের জন্য তার আহ্বান, অন্যদিকে জাতি-ভেদ, গোঁড়ামী ও সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে তার আহ্বানÑ
‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার
..........................
হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন?
কা-ারী বল, ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র।’
(খেয়া পারের তরণী)
যে মুহূর্তে নজরুল তার নিজেকে বিশ্বমানবতার প্রতীক মনে করেছিলেন, সেই মুহূর্তে তার মধ্যে দেখা দেয় সংকীর্ণতামুক্ত এক অপূর্ব বিশ্বপ্রেম সত্তার। তিনি নিজে বলেছিলেন- ‘‘আমাকে কেবল মুসলমান বলে দেখবে না। যদি আসি, আসবো হিন্দু-মুসলমান সকল জাতির ঊর্ধ্বে যিনি একমেবাদ্বিতীয়ম, তারই দাস হয়ে।” [১৯৪১ সালে কলকাতায় মুসলিম ইনস্টিটিউটের বার্ষিক সম্মেলনে বক্তব্য প্রদানকালে কবির বক্তব্য।] তিনি যে শুধু সকল সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করেছিলেন, তা নয়। কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের কাছে জাগরণের বাণী পৌঁছে দেবার জন্য তিনি ১৯২৭, ১৯২৮, ১৯২৯ সালে কুষ্টিয়া সফরে যান। বিভিন্ন সভা-সমিতিতে গিয়ে কৃষক-শ্রমিক ও তরুণদের উজ্জীবিত করা ও সংগঠিত করা ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। ভারতের স্বাধীনতা ও কৃষক শ্রমিকের মুক্তি সম্বন্ধে বক্তৃতা করেন হেমন্ত কুমার সরকার, ফিলিপ স্প্যাট প্রমুখ। নজরুল এই সম্মেলনে জাতীয় জাগরণমূলক সঙ্গীত পরিবেশন করেন। সম্মেলনে উপস্থিত প্রায় এক হাজার লোক নজরুলের গানে স্বাধীনতা সংগ্রামে উজ্জীবিত হন।২ (প্রমীলা নজরুল, নজরুল স্মৃতি বিজড়িত কুষ্টিয়া অধ্যায়, পৃষ্ঠা-৩৬। লেখক মুহাম্মদ আসাদ থেকে সংগৃহীত।) এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, কুষ্টিয়া পৌরসভার পক্ষ থেকে স্থানীয় যতীন্দ্রমোহন হলে এক গণসম্বর্ধনা দেয়া হয়। নজরুল ওই সময়ে কুমারখালীতে বিপ্লবী সাহিত্য সাধক কাঙাল হরিনাথের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। নজরুল যখন যেখানেই গিয়েছেন, সে জায়গা লোকে লোকারণ্য হয়ে যেতো। তিনিও গানে, আবৃত্তিতে কথায় কাউকে বিমুখ করেননি। এখানে পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, কবি শুধু কবিতার মধ্য দিয়ে জীবনকে নতুন করে উপলব্ধি করেননি, জনমানসের সঙ্গে তার ছিলো গভীর সংযোগ। ১৯২২ সালে তার পত্রিকা ধূমকেতুতে প্রকাশিত “আনন্দময়ীর আগমনে’’ কবিতার জন্য নজরুলকে কারাবরণ করতে হয়। হুগলী জেলে বন্দীদের প্রতি অমানবিক আচরণ ও নিম্নমানের খাদ্য পরিবেশনের প্রতিবাদে কবি আমরণ অনশন শুরু করেন। সারা দেশ বিচলিত বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ টেলিগ্রাম পাঠানÑ ‘‘এরাব ঁঢ় যঁহমবৎ ংঃৎরশব, ড়ঁৎ ষরঃধৎধঃঁৎব পষধরসং ুড়ঁ” প্রায় ৩৯ দিন পরে কবি শ্রদ্ধেয়া মা বিরজা সুন্দরীর কাছে অনশন ভঙ্গ করেন। পরে তাকে বিশেষ ব্যবস্থায় বহরমপুর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। কবির জীবন নানা অসুবিধার কারণে কখনই মসৃণ গতিতে চলেনি। তবুও স্ত্রী-পুত্র নিয়ে তিনি কখনও কুমিল্লা, মানিকগঞ্জ ছাড়াও চুয়াডাঙ্গা, কৃষ্ণনগরে গিয়েছেন ও বাস করেছেন। অর্থাভাব তার সবসময়েই ছিলো। কিন্তু তাতে করে কবি দুঃখ পেলেও কখনও ভেঙে পড়েননি। ওই সময়ে সামাজিক বিধি-নিষেধও ছিল প্রচুর। কিন্তু কবি তার মধ্য দিয়ে সাবলীলভাবে সাহিত্য সাধনা চালিয়েছেন।
কবি নজরুল সারা জীবন ধরে যে বিচিত্র সৃষ্টির ফসল রেখে গেছেন তা বিস্ময়কর। সমাজের প্রতিটি স্তরে তার বিচরণ তার সৃষ্টিতে এনেছে বিষয় বৈচিত্র্য। কখনও ক্রুদ্ধ-ঋষি, দুর্বাষা,কখনও বাঁধন হারা সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে ওঠা যৌবরাজ্যের যুবরাজ। কখনও বা নারীর প্রতি প্রেমে ও বিরহের অমিয়ধারার প্রবাহিত বেদনার অশ্রুত ক্রন্দন। এ সবই পেয়েছি কবি নজরুলের জীবনেতিহাসের মধ্যে। ধর্মাধর্ম ও ভেদজ্ঞানে জর্জরিত সেকালের সমাজজীবনে প্রায়শই নিন্দিত হয়েছেন কবি নজরুল। তার কাব্যে বেদ, বাইবেল, মহাভারত ও মহত্তম গ্রন্থ কোরআন থেকে উদ্ধৃত হয়েছে সত্যের স্বরূপ। ১৯৪০ সালে ২৩ শে ডিসেম্বর কোলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে মুসলিম ছাত্র সম্মিলনে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমি সর্ব বন্ধন মুক্ত সব সংস্কার মুক্ত, সর্ব ভেদাভেদ জ্ঞান মুক্ত না হলে সেই পরম নিবারণ, পরম মুক্ত আল্লাহকে পাব না আমার শক্তিতে।” এত বড় সাহসী উচ্চারণ একমাত্র কবি নজরুলকেই মানায়।
একদিন এক কিশোর তার জীবনের সব বন্ধন ছিন্ন করে সৈনিক হয়েছিলো। পৃথিবীর সব অসাম্য, দীনতা ও হীনতাকে জয় করে সে হয়ে উঠেছিলো মানুষের কবি। বিশ্বমানবতার স্বপ্ন নিয়ে সে সময়ের সব পরীক্ষা অতিক্রম করে অযুত হৃদয়ের অধীশ্বর হয়ে উঠেছে। জীবনের সব বিষ জ্বালা বুকে নিয়ে শ্রান্ত ক্লান্ত পরিতৃপ্ত হৃদয়ে সে ঠাঁই নিয়েছে আমার দেশের সবুজ শ্যামল জমিনে। তার প্রতি আমার সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাই, অভিবাদন জানাই আমাদের জাতীয় কবিকে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।