Inqilab Logo

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ

প্রকাশের সময় : ৪ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

এমাজউদ্দীন আহমদ
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী? এ সম্পর্কে কিছু বলার আগে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ইতিহাস স্মরণ করা প্রয়োজন। আজকে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের প্রসার যেভাবে ঘটেছে তাতে উল্লসিত হওয়ার কারণ রয়েছে বটে, কিন্তু গণতন্ত্রের ইতিহাসের প্রতি বাঁকে রয়েছে হতাশা এবং ব্যর্থতার অসংখ্য বালুচর। ইতিহাসের দীর্ঘকালীন পরিসরে, বিশেষ করে আঠারো শতকের শেষ প্রান্তে ফরাসি বিপ্লব থেকে শুরু করে বিশ শতকের মাঝামাঝির একদলীয় ব্যবস্থা পর্যন্ত হিসাব করলে দেখা যায়, গণতান্ত্রিক সরকার সংখ্যার দিক থেকে যেমন স্বল্প, সময়ের দিক থেকেও তেমনি স্বল্পকালীন। অধ্যাপক ফিনের (Chaster E. Finn)  কথায়,  ‘গণতন্ত্রের ধারণা দীর্ঘকালীন ঠিকই, কিন্তু এর কার্যকারিতা অনিশ্চিত’। [The idea of democracy is durable, but its practice is precarious.]  অধ্যাপক ফিনের বক্তব্য প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। গত সত্তর বছরের গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর দিকে তাকালেই চলবে। জার্মানি, অস্ট্রিয়ার মতো বহু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র একদলীয় ব্যবস্থার কঠোর নিয়ন্ত্রণে এসেছে। অন্যদিকে ঔপনিবেশিকতার নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে বহু জনপদ গণতন্ত্রের মিছিলে শামিল হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা মাথায় নিয়ে যাত্রা শুরু করে অনেক রাষ্ট্র প্রবেশ করেছে স্বৈরাচারী শাসনের অচলায়তনে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ইতিহাসও তেমনি হতাশাব্যঞ্জক। গত চল্লিশ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশ লাভ করেছে মাত্র ২৭ বছরের গণতান্ত্রিক শাসন। আর রয়েছে ছয় বছরের আধাসামরিক এবং ৯ বছরের সামরিক শাসন। এখানে গণতন্ত্র বিধ্বস্ত হয়েছে যেমন সামরিক কর্মকর্তাদের দ্বারা, তেমনি নির্বাসিত হয়েছে নির্বাচিত জননেতা কর্তৃকও। গণতন্ত্রের বিদায় ক্ষণে সমাজের প্রভাবশালীদের তেমন হা-হুতাশ করতেও দেখা যায়নি।
গণতন্ত্র শুধু শাসন পদ্ধতি নয়, গণতন্ত্র সামাজিক নর্ম এবং রীতিনীতিও। গণতন্ত্র এক ধরনের সমষ্টিগত সংস্কৃতিও।  কোনো জনপদে গণতন্ত্রের পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শুধু কাঠামোগত পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়, এ জন্য প্রয়োজন রাজনীতিকদের চিন্তন-মননে গভীর পরিবর্তন। প্রয়োজন সামাজিক ব্যবস্থার সঠিক বিন্যাস। প্রয়োজন সামাজিক কার্যক্রমে নাগরিকদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মনমানসিকতা। ডায়ান রেভিচের কথায়, ‘গণতন্ত্র একগুচ্ছ প্রতিষ্ঠানের সমষ্টি মাত্র নয়। গণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্য অনেকাংশে নির্ভর করে গণতান্ত্রিক পৌর সংস্কৃতির বিকাশের ওপর।’
(Democracy is more than the sum of the institutions. A healthy democracy depends in large part on the development of a democratic civic culture.’)  সংস্কৃতি চেতনা প্রাণবন্ত না হলে গণতন্ত্র লাভ করে না তার কাক্সিক্ষত উচ্চতা। সংস্কৃতিবোধ জীবন্ত না হলে প্রবেশ করে না সমাজ জীবনের গভীরে। জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা ধারণ করে তাদের নিজস্ব কর্মধারায় প্রতিফলিত হয় না। সংস্কৃতি যেমন ব্যক্তিকে ছাপিয়ে সমগ্রের হয়ে ওঠে এক পরিচয়, গণতন্ত্রও তেমনি ব্যক্তিকে কেন্দ্র করেই রূপান্তরিত হয় সামষ্টিক কর্মপ্রবাহে। সংস্কৃতি দেয় পরিশীলিত এক দৃষ্টিভঙ্গি। গণতন্ত্র আনে সমাজ জীবনে সৃজনশীলতার এক দুর্বার প্রাণবন্যা। দুই-ই চলে পাশাপাশি, হাত ধরাধরি করে। একটি পিছিয়ে পড়লে অন্যটি হাত বাড়ায় সহায়তার। হাত ধরে টেনে তোলে। পরস্পর পরস্পরের আলোয় পথ চলে। দৈহিক বলের পরিবর্তে যুক্তি যখন কার্যকর হয় তখনই দেখা দেয় সংস্কৃতি চেতনা। পেশির পরিবর্তে মন যখন হয়েছে চালিকাশক্তি তখনই সংস্কৃতির সূচনা হয়। দৈহিক বল আক্রমণ করে, অপরকে দূরে সরিয়ে রাখে। মন কিন্তু কাছে টানে। অপরকে আকর্ষণ করে। অপরের কাছে ছুটে যায়। এভাবে সংস্কৃতিবোধের নব নব পর্যায়ে মানবের সংঘবদ্ধ জীবনের সূত্রপাত হয়। গড়ে ওঠে পরিবার, গোত্র, গোষ্ঠী, সংঘ এবং একপর্যায়ে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের জন্ম ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় তারও পরে। সংস্কৃতি তখন উঠে এসেছে পরিণত পর্যায়ে।
সংস্কৃতি এবং গণতন্ত্র দুয়েরই শুরু ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। ব্যক্তি জীবনকে সুন্দর ও সুরুচিসম্পন্ন করেই সংস্কৃতি হয়েছে অর্থপূর্ণ। ব্যক্তিত্বের সুষম বিকাশ ঘটিয়ে ব্যক্তিকে সংকীর্ণতার অন্ধকার থেকে মুক্তি দিয়ে সবার সঙ্গে চলার এবং বলার উপযোগী করে সংস্কৃতিই ব্যক্তির সামনে সম্ভাবনাময় উন্নত সামাজিক জীবনের সিংহদ্বার উন্মুক্ত করেছে। তেমনি গণতন্ত্রও ব্যক্তিকে তার অহংবোধের সংকীর্ণ গুহা থেকে টেনে এনে  মিলিয়েছে সমাজের বিস্তীর্ণ উদার উপত্যকায়। তাই দেখা যায়, উন্নত সংস্কৃতির ঘাটেই ভিড়েছে সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব ও স্বাধীনতার পণ্যবাহী গণতন্ত্রের সোনার তরী। যে সমাজে সংস্কৃতির মান এখনো উন্নত হয়নি সেখানে গণতন্ত্রের যাত্রাপথ এখনো রয়েছে বন্ধুর। এখনো ভীষণ পিচ্ছিল।
বাংলাদেশের সমাজে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির মান অনেক অবনত। পারস্পরিক সন্দেহ এবং অবিশ্বাস জমাটবাঁধা পাথরের মতো আগলে রেখেছে সমষ্টিগত জীবনের মহামিলনের উৎসবকে। ব্যক্তিগত এবং গোষ্ঠীগত স্বার্থের অন্ধকারে নিমজ্জিত সামগ্রিক স্বার্থের চেতনা। পেশির সর্বগ্রাসী দাপটে নিস্তেজ হয়ে রয়েছে অন্তঃকরণের কল্যাণময়ী প্রত্যয়। আবেগের প্রবল ¯্রােতে ভেসে যাচ্ছে যুক্তিবাদিতার গণমুখী ভাবনা, সৃজনশীলতার সার্বিক কলাকৌশল। সবকিছু ভাঙার প্রবণতা নিঃশেষ করেছে গড়ার প্রতিভাকে। ‘আমার’ সুকৌশলী চিন্তাসূত্র প্রতিনিয়ত ছিন্ন করেছে ‘আমাদের’ ব্যাপকভিত্তিক কল্যাণবোধকে। এই অবস্থা আর যাই হোক স্থিতিশীল গণতন্ত্রের জন্য উপযোগী নয়।
গণতন্ত্রের জন্য তাই ভাঙতে হবে সংকীর্ণতার দেয়াল। আত্মস্বার্থকে প্রক্ষিপ্ত করতে হবে সমগ্র সমাজের বৃহত্তর ক্ষেত্রে। গড়ে তুলতে হবে আত্মস্বার্থের ভিত্তিতে সামগ্রিক স্বার্থের উচ্চতর সৌধ। পথ কিন্তু অত্যন্ত বন্ধুর। সুশিক্ষা হয়তো এ পথের  দিশারী হতে পারে, তাও কিন্তু এ সমাজে স্বল্পসংখ্যক জনসমষ্টির আয়ত্তে। সুশিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত সমাজের বৃহত্তর অংশ। টমাস জেফারসন লিখেছেন, ‘কোনো জাতি অজ্ঞতা দূর না করে মুক্ত হতে চাইলে চূড়ান্ত পর্যায়ে হতাশ হতে বাধ্য। সভ্যতার বৃহত্তর অঙ্গনে তা কখনো ঘটেনি, ভবিষ্যতেও ঘটবে না।’  [If a nation expects to be ignorant and free, in a state of civilization it expects what never was and never will be.]
যে শিক্ষা ব্যবস্থা বাংলাদেশ সমাজে প্রচলিত রয়েছে তাও গণতান্ত্রিক চেতনার উন্মেষের জন্য উপযোগী নয়। উপযোগী নয় বিশ্লেষণাত্মক মন রচনার, নয় যুক্তিবাদী, আবেগবর্জিত পরিবেশে ব্যাখ্যাদানের। গণতন্ত্র কিন্তু চর্চার বিষয়। প্রতিনিয়ত পর্যালোচনার মাধ্যমেই গণতন্ত্রের শ্রীবৃদ্ধি হয়। অধ্যাপক ফিনের (ঋরহহ) কথায়, ‘ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যের স্পৃহা নিয়েই মানুষ জন্মলাভ করে, কিন্তু যে সামাজিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা দীর্ঘকালীন পরিসরে ব্যক্তি ও তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতাকে অর্থপূর্ণ করে তোলে তার জ্ঞান নিয়ে মানুষ জন্মে না। মানুষকে তা অর্জন করতে হয়। তাকে শিখতে হয়।’  [People are born with an appetite for personal freedom but they are not born with knowledge about the social and political arrangement that make freedom possible overtime for themselves and their children. Such things must be achieved. They must be learned.]  
শুধু সাধারণ শিক্ষা নয়, নিজেদের প্রবণতা ও প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণে আনার শিক্ষারও প্রয়োজন। হাজারো স্ববিরোধিতায় ভরা মানুষের মন। ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যকে সে যেটুকু ভালোবাসে, ঠিক ততটুকু আগ্রহী সামাজিক সাম্যের জন্য। স্বাধীনতা উপভোগ করতে যতটুকু আগ্রহী, দায়িত্ব পালনে ঠিক তেমনি অনীহা। একদিকে সে চায় নিরাপত্তা, অন্যদিকে অন্যের নিরাপত্তা সম্পর্কে সে উদাসীন। তাই দেখা যায়, সমাজ জীবনের প্রতি ঘাটে জমেছে সংঘাত আর দ্বন্দ্ব। এ দুয়ের সমন্বয় সাধন করতেই হবে। গণতন্ত্রের স্বার্থে সামাজিক দ্বন্দ্বকে রাখতে হবে সুনির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে। বিভিন্ন সামাজিক শক্তিগুলো (ঝড়পরধষ ঋড়ৎপবং) যদি দাবি উপস্থাপন ও দাবি আদায়ের মাধ্যম মনে করে তাহলে অভ্যন্তর থেকেই গণতান্ত্রিক সমাজ ধসে পড়বে। অন্যদিকে সমাজে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার যদি গণকণ্ঠ রুদ্ধ করে অত্যধিক চাপ সৃষ্টি করে তাহলেও গণতন্ত্র ভেঙে পড়বে বাইরের চাপে। গণতান্ত্রিক সমাজ এমন যান্ত্রিক নয় যে, একবার নীতি এবং প্রক্রিয়া রচিত হয়ে গেলে আপনা-আপনি চলতে থাকবে। গণতান্ত্রিক সমাজ প্রাণবন্ত থাকে যদি নাগরিকরা আন্তরিকতার সঙ্গে বিশ্বাস করে দ্বন্দ্ব যেমন অপরিহার্য, দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য ধৈর্য এবং সহনশীলতাও তেমনি অপরিহার্য। ব্যক্তি এবং ব্যক্তি সমন্বয়ে সংঘটিত বিভিন্ন গ্রুপকে স্মরণ রাখতে হবে, অন্যের অধিকার এবং বক্তব্যও যথার্থ। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি এ ধরনের সহনশীলতা এবং উদার মনোভাবের সৃষ্টি করে। তাই বলা হয়, গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি।
উন্নত গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি যে কোনো গণতান্ত্রিক সমাজের বিশিষ্ট অর্জন। বাংলাদেশের সংস্কৃতি কিন্তু এ পর্যায়ে উন্নীত হয়নি। এদেশে গণতন্ত্র সবাইকে দিয়েছে দাবি উত্থাপনের অধিকার এবং সরকারকে দিয়েছে যা খুশি করার অধিকার। এ দেশে গণতন্ত্র শুধু আত্মস্বার্থের প্রতীক। সমষ্টিগত স্বার্থ আমাদের গণতন্ত্রে কোনো স্থান পায়নি। সবাই নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে সমস্যা অবলোকন করে। অন্যের বক্তব্য যে যথার্থ হতে পারে তা কেউ ভাবে না। এমনি পরিস্থিতিতে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছে এ দেশে। চলতে গিয়ে তাই হোঁচট খাচ্ছে বার বার।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রকৃত শাসন হলো আইনের শাসন। কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের শাসন নয়। এক্ষেত্রে আইনের প্রাধান্যই বড় কথা। আইন প্রণয়ন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সম্পন্ন হয় জনপ্রতিনিধি কর্তৃক, সংসদে। প্রণীত আইন মেনে চলা সবার জন্য বাধ্যতামূলক। কোনো আইন মন্দ হলেও তা মেনে চলতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত তা পরির্বতন না হচ্ছে। অন্য কথায়, আইন হলো সমাজে সবকিছুর নিয়ামক। সমাজে সব শ্রেণী এবং গ্রুপের স্বার্থ সংরক্ষণ করে আইন। পুরস্কার বা বঞ্চনা, পদোন্নতি বা পদচ্যুতি, লাভ বা লোকসান-সবকিছুর নিয়ন্ত্রক আইন। গণতন্ত্রে ব্যক্তি, তা তিনি যত উঁচু পদে থাকুন না কেন, কাউকে কিছু দিতেও পারেন না বা কারো কোনো ক্ষতি করতেও পারেন না। মোট কথা, গণতান্ত্রিক সমাজে শাসন হলো আইনের শাসন।
তাছাড়া পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক সমাজের দিকে তাকালে আর একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয় এবং তা হলো, সেখানে সামাজিক উপত্যকা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে জারিত। সামাজিক উপত্যকা মোটামুটিভাবে সমতল। পীড়নমূলক স্তর বিন্যাসে সমাজ জীবন তেমন পীড়িত নয়। তাই একজন অন্যজনকে ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা করে। একজন অন্যের মতকে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করে, যদিও তা তার মত থেকে ভিন্ন। গণতান্ত্রিক সমাজে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা এমনভাবে বিন্যস্ত যে, সমাজে সব শ্রেণী বা গ্রুপ জীবনের সর্বনি¤œ প্রয়োজন সম্পর্কে নিশ্চিত। ধনী-নির্ধন, বড়-ছোটর মধ্যে ব্যবধান রয়েছে বটে, কিন্তু জীবনযাত্রার ন্যূনতম প্রয়োজন সম্পর্কে জনসমষ্টির বৃহত্তর অংশ নিশ্চিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক সমাজে কাউকে মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হতে হয় না। এদিক থেকে বলা যায়, গণতন্ত্রের সাফল্যের মূলে যেসব শর্ত অপরিহার্য তার অধিকাংশই সামাজিক। প্রকৃতপক্ষে, পাশ্চাত্যে গণতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছে  প্রথমে  সামাজিক ব্যবস্থা রূপে। বহু দিনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সমাজ থেকে গণতন্ত্র এসেছে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে কিন্তু গণতন্ত্রের প্রয়োগ হয়েছে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, যদিও এই সমাজে বিদ্যমান রয়েছে অসহনীয় অসাম্য, নির্মম বঞ্চনা, ব্যক্তি ও শ্রেণীর মধ্যে অসম ব্যবধান। উঁচু-নিচুর মধ্যে অসহনীয় পার্থক্য। শুধু তাই নয়, গণতন্ত্রের প্রয়োগ হচ্ছে শুধু কেন্দ্রীয় পর্যায়ে, স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কারণে তা যেমন অসম্পূর্ণ, তেমনি অর্থহীন। বাংলাদেশ সমাজে, তাছাড়া গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশ এখনো হয়নি। সূচিত হয়নি আইনের প্রতি আনুগত্য। কোনো কিছু পেতে হলে এখনো ব্যক্তি তাকায় ক্ষমতাশীল ব্যক্তির দিকে। আইনের দিকে নয়। সহনশীলতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এ সমাজে এখনো অত্যন্ত দুর্লভ গুণ।
গণতন্ত্রের প্রতি এ সমাজে সাধারণ মানুষের রয়েছে এক ধরনের দুর্বলতা, কিন্তু সমাজের এলিট গোষ্ঠীর মন-মানসিকতা এখন পর্যন্ত সামন্তবাদী। গণতন্ত্রের জন্য যে মন এবং মননশীলতা প্রয়োজন এদেশের রাজনীতিকদের অধিকাংশের মধ্যে তার বিকাশ ঘটেনি। তার পরেও বলব, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে আশাবাদী দুটি কারণেÑ এক. বাংলাদেশে গণতন্ত্রের শত্রু অনেক হলেও সাধারণ মানুষ কিন্তু এর অকৃত্রিম বন্ধু। গণতন্ত্রের জন্য তারা সংগ্রাম করেছে। গণতন্ত্রের মিছিলের অগ্রভাগেই তাদের দেখা যায়। তারা এখনো বিশ্বাস করে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ ঘটলে তারা লাভবান হবে। গণতন্ত্রেই তারা তাদের অধিকার ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হবে। দুই. এদেশের তরুণরা সম্প্রতি বাংলাদেশ ছাড়িয়ে যেভাবে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে একটু সচ্ছল জীবিকার প্রয়োজনে এবং কার্যোপলক্ষে,  গণতান্ত্রিক ও অগণতান্ত্রিক দেশগুলোতে অভিজ্ঞতার যে মনিকাঞ্চন প্রতিনিয়ত সংগ্রহ করছে তারও প্রভাব নিজের দেশে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে। কয়েক দিন আগে লন্ডনের ইকোনমিকস পত্রিকায় যে সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যায়, ১৬৭টি দেশের মধ্যে এ বছরে বাংলাদেশের  অবস্থান ৮৩, যদিও ২০০৮ সালে তা ছিল ৯১। পরিবর্তনের ধারা অতি মন্থর হলেও তা ইতিবাচক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ
আরও পড়ুন