Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মধুবালা যখন মধুমালা

আসামে বিদেশি বাছতে গিয়ে হেনস্থার শিকার ভারতীয়রা

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৯ জুন, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

ভারতের আসামে মধুবালা মন্ডল নামে এক নারীকে ‘বাংলাদেশি’ বলে তিন বছর ডিটেনশন সেন্টারে আটকে রাখার পর অবশেষে পুলিশ ভুল স্বীকার করে তাকে মুক্তি দিয়েছে। আসামের চিরাং জেলার বিষ্ণুপুর গ্রামের বাসিন্দা ৫৯ বছরের মুধবালা যখন বাড়ি ফেরেন তখন তার মেয়ে আর নাতনি চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলেন না। ২০১৪ সালে ভারতের ক্ষমতায় আসার পর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অনুপ্রবেশকারী বাছাইয়ের কাজে শুরু করে নরেন্দ্র মোদি সরকার। তখন দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছিল, অনুপ্রেবশকারীদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান রয়েছে যে রাজ্যে সেই আসাম থেকেই এই বাছাইয়ের কাজ শুরু করা হবে। সে অনুযায়ী আসামে নাগরিকপঞ্জির তৈরির কাজ শুরু হয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ওই নাগরিকপঞ্জির খসড়া প্রকাশের পর দেখা যায় সেখানে মাত্র এক কোটি ৮০ লাখ মানুষের ঠাঁই হয়েছে। যা নিয়ে সমালোচনা ও বিতর্কের পর জুলাইয়ে দ্বিতীয় খসড়া তালিকা প্রকাশ করা হয়। সেখানে নাগরিক হিসেবে দুই কোটি ৮৯ লাখ মানুষের নাম তালিকায় দেখা যায়। অথচ আবেদন করেছিলেন তিন কোটি ২৯ লাখ মানুষ। আসামে এই অনুপ্রবেশকারী বাছতে গিয়ে নিজ দেশেই বহু মানুষকে হেনেস্থার শিকার হতে হচ্ছে, যাদের একজন মধুবালা। ২০১৬ সালে আসাম পুলিশ মধুবালাকে ‘বিদেশি’ বলে আটক করে। যদিও পুলিশ আসলে মধুমালা দাসকে খুঁজছিলেন, যিনি প্রায় ২০ বছর আগে মারা গেছেন। নানা ভাবে চেষ্টা করেও মধুবালা মন্ডল নিজেকে ভারতীয় প্রমাণ করতে পারেননি। অবশেষ পুলিশ তাদের ভুল বুঝতে পারে এবং মুক্তি মেলে মধুবালা মন্ডলের। মুক্তি পাওয়ার পর এনডিটিভিকে মধুবালা বলেন, “পুলিশ আসার পর আমি তাদের বার বার বলেছিলাম আমি মধুবালা, মধুমালা নই। তাছাড়া আমার টাইটেল মন্ডল, দাস নয়। কিন্তু তারা আমার কোনো কথা না শুনে ধরে নিয়ে যায়। ডিটেনশন সেন্টারে তিন বছর আমি অনেক কষ্ট করেছি।” প্রায় ২২ বছর আগে স্বামীর মৃত্যুর পর মধুবালাই তার তিন সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। তার মেয়ে ফুলমালা (৩৪) বোবা হওয়ায় আট বছর আগে স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে একমাত্র মেয়ে জয়ন্তী (১২) কে নিয়ে মায়ের বাড়িতে বসবাস শুরু করেন। ডিটেনশন সেন্টারের বর্ণনা দিতে দিয়ে মধুবালা বলেন, “সেখানে জীবন যাপন ভয়াবহ। শত শত মানুষের সঙ্গে সেখানে অমানবিক ব্যবহার করা হয়। আমি মুক্তি আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। আমাকে ছাড়া আমার মেয়ে আর নাতনির কী হবে সেটা ভেবে আমি কষ্ট পেতাম। “আমাদের সেখানে সবজি খেতে দেওয়া হত। মাঝে মধ্যে ভাত ও ডাল, যার সবই আধাসিদ্ধ থাকতো। সেখানে তরুণ-বৃদ্ধ অনেক মানুষকে আটকে রাখা হয়েছে যারা আসলে ভারতীয়। আমি নিজে সেখানে মুক্তির অপেক্ষায় থাকা দুইজনকে মরে যেতে দেখেছি।” মধুবালাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর ফুলমালা ও তার মেয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। তবে ভাগ্য ভালো, কয়েকজন গ্রামবাসী তাদের পাশে দাঁড়ায়। এক প্রতিবেশী বলেন, “জয়ন্তী স্কুল ছেড়ে দিয়েছিল। আর ফুলমালা মায়ের খোঁজে পুরো গ্রাম পাগলের মত দৌড়ে আর চিৎকার করে বেড়াত। আমি মাঝে মধ্যে তাদের ধরে খাবার দিতাম।” মধুবালার পরিবার বা তার গ্রামের মানুষের পক্ষে তাকে মুক্তির উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব ছিল না। ডিটেনশন সেন্টারেই হয়তো মধুবালার জীবন শেষ হয়ে যেত যদি না স্থানীয় সমাজকর্মী অজয় কুমার রায় তার সাহায্যে এগিয়ে আসতেন। তিনি মধুবালার ভারতীয় হওয়ার প্রমাণ জোগাড় করেন এবং সেগুলো পুলিশকে দেন।“আমি সব প্রমাণ পুলিশের এসপিকে দেই এবং বলি ‘আরো একবার গ্রামে এসে প্রকৃত সত্য অনুসন্ধান করতে’। সানাউল্লাহ নামে আরো এক ব্যক্তি ডিটেনশন সেন্টার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আমি মধুবালার বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের সাহায্য চাই এবং এটা নিয়ে হইচই শুরু হয়।” আসামের খসড়া নাগরিকপঞ্জিতে মধুবালার পুরো পরিবারের নাম আছে। এ বিষয়ে চিরাং পুলিশের এসপি সুধাকর সিং বলেন, “তদন্তে আমরা পরিচয় সনাক্তে ভুল হওয়ার বিষয়টি বুঝতে পেরে আদালতে আমাদের প্রতিবেদন পাঠাই এবং তিনি মুক্তি পান।” মাত্র একমাস আগে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সেনা মোহাম্মদ সানাউল্লাকে ‘অবৈধ অভিবাসী’ বলে ১২ দিন ডিটেনশন সেন্টারে আটকে রাখার ঘটনা নিয়ে ভারত জুড়ে হইচই পড়ে গিয়েছিল। অশ্রুসিক্ত চোখে মধুবালা বলেন, “তাদের ভুলের জন্য আমার পরিবার এবং আমার শরীর ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি তো এখন কাজও করতে পারবো না, আমি এখন কিভাবে বেঁচে থাকবো? আমার এখন সরকার থেকে ক্ষতিপূরণ চাই। আমাকে যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ কী তারা দিতে পারবে? তারা আমাকে বলেছে আমি বাংলাদেশি এবং আমাকে সেখানে ফেরত পাঠানো হবে। আমি বলেছি, আমি একজন গর্বিত ভারতীয় হিসেবে মরবো।” এনডিটিভি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ