যেভাবে ৫০০
ক্লাব ফুটবলে গোলের প্রায় সব রেকর্ডই তার দখলে। এবার সেই লিওনেল মেসি উঠে গেলেন আরেক উচ্চতায়। বার্সেলোনার জার্সি গায়ে ৫০০ গোলের মাইলফলক স্পর্শ করেছেন মেসি।
মো. জোবায়ের আলী জুয়েল : বিশ্বব্যাপী অসম্ভব জনপ্রিয় খেলা হলো ফুটবল। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। পঞ্চাশ, ষাট দশক ছিল এদেশে ফুটবলের স্বর্ণযুগ। ব্রিটিশ আমলে আমাদের এদেশে অনেক ভালো ভালো খেলোয়াড়ের উত্থান ঘটেছিল। গোষ্ঠপাল, শিশির ঘোষ, শৈলেন মান্না, সামাদ, আব্বাস মির্জা, মোস্তফা, নূর মোহাম্মদ, তাজ মোহাম্মদ, হাফেজ রশীদ, মোহিনী ব্যানার্জী, জুম্মা খান, তসলীম সেকালের বিশ্ব বিখ্যাত ফুটবলার ছিলেন।
আজ যার কথা লিখতে বসেছি তিনি ছিলেন অধুনালুপ্ত পাক-ভারত উপমহাদেশের ফুটবলের কিংবদন্তির মহানায়ক “সৈয়দ আব্দুস সামাদ”। বিস্ময়কর ক্রীড়া নৈপুণ্য, কঠোর অধ্যবসায়, আসাধারণ কলাকৌশলের জন্য তৎকালীন তিনি “ফুটবলের যাদুকর” উপাধিতে ভূষিত হন। ফুটবলের “স্বর্ণযুগ” ব্রিটিশ আমলে সামাদ তার ৩০ বছরের খেলোয়াড়ি জীবনে এমনসব অসাধারণ ও বিস্ময়কর ক্রীড়া নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন যা মানুষের হৃদয়ে আজও চির অম্লান, চিরভাস্মর ও অভাবনীয় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। চোখ ধাঁধানো ড্রিবলিং, বল নিয়ন্ত্রণের অপূর্ব ক্ষমতা, প্রতিপক্ষের জালে গোল করার কৃতিত্ব প্রভৃতিতে তিনি ছিলেন কিংবদন্তির নায়ক।
সর্বকালের ফুটবলের ইতিহাসে এমন বল নিয়ন্ত্রণের কায়দা, গোল করার দক্ষতা, কৌশল আর বুদ্ধির চকিত দীপ্তিতে আক্রমণের ধারা মুহুর্মুহু পরিবর্তনে সামাদের জুড়ি আর কখনও হবে কিনা জানি না।
পশ্চিমবঙ্গের পুর্ণিয়া জেলায় ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে “ফুটবল যাদুকর সামাদ” জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল সৈয়দ ফজলুল বারী। সামাদের বাল্যকাল সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তার পিতার আর্থিক অবস্থা মোটেও সচ্ছল ছিল না। সামাদের ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের প্রতি ছিল একান্ত অনুরাগ। তারই ফলে লেখাপড়া তার সপ্তম শ্রেণীতেই শেষ হয়ে যায়। তবে ছোটবেলা থেকেই সামাদ অত্যন্ত চটপটে ও বুদ্ধিমান ছিলেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে সামাদ তার অসাধারণ ক্রীড়া নৈপুণ্য ও কলাকৌশল প্রদর্শনের মাধ্যমে অবিভক্ত ভারতের ক্রীড়ামোদিদের নয়নমণি হয়ে ওঠেন।
১৯১২ খ্রিস্টাব্দে সামাদ কোলকাতার “মেইন টাউন ক্লাবের” পক্ষ হয়ে সর্বপ্রথম ফুটবল খেলা শুরু করেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। রংপুরের তাজহাটের প্রখ্যাত সেন্টার ফরওয়ার্ড রাজা গোপাল রায় ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত তাজহাট ফুটবল দল গঠন করেন। এ দলের বিখ্যাত খেলোয়াড় ছিলেন যাদুকর সামাদ।
রংপুরের তাজহাটের রাজ দরবারের সিঁড়ি বেয়েই সর্বপ্রথম সামাদ কোলকাতায় এসেছিলেন। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে কোলকাতার “এরিয়ান্স ক্লাবের সদস্য” ও ১৯২১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে টিমে খেলেন। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় দলে যোগ দিয়ে সামাদ মিয়ানমার, চীন, ইন্দোনেশিয়া ও যুক্তরাজ্য সফর করেন। উল্লেখ করা যেতে পারে অবিভক্ত ভারতীয় জাতীয় দলের ফুটবলে এটাই সর্বপ্রথম বিদেশ যাত্রা। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে সামাদ অবিভক্ত ভারতে ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে শ্রীলঙ্কায় ফুটবল খেলতে যান। ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি কোলকাতার বিখ্যাত “মোহামেডান স্পোর্টিং” ক্লাবে যোগদান করেন এবং ঐ বছরেই তাকে ফুটবলে অসাধারণ ক্রীড়া নৈপূণ্য প্রদর্শনের জন্য তদানিন্তন আইএফএ (ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন) তাকে “হিরো অফ দি গেমস” সম্মানে ভূষিত করে।
সামাদের খেলোয়াড়ি জীবনে সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনাটি ঘটেছে খোদ “ইংল্যান্ডের মাঠে”। লন্ডনের ফুটবল মাঠে এক খেলায় সামাদের গোলে শর্ট করা বল, গোলের বার পোস্টে লেগে ফিরে এলে তিনি এই শর্টে গোল দাবি করে বসেন। তৎক্ষণাৎ রেফারিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে বলে ফেলেন “গোলবার” উচ্চতায় ছোট আছে। আমার শর্টের মাপ কখনোই ভুল হতে পারে না। অনেক বাক-বিত-ার পরে “গোলবার” মাপার পরে দেখা গেলো, সত্যি “গোলবার” দেড় ইঞ্চি ছোট। সামাদের কথাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। অবশেষে বাতিল গোলটি, গোল হিসেবে গণ্য করেন রেফারি। এমনই নির্ভুল শর্ট এবং চ্যালেঞ্জ করার মতো ফুটবলার বাংলাদেশ তথা বিশ্বের ফুটবল ইতিহাসে আজও জন্মায়নি। তৎকালীন লন্ডনের ফুটবল মাঠের সেই অভাবনীয় খেলার ঘটনা থেকেই তিনি পরবর্তীতে ইংরেজ দর্শকের কাছ থেকেই পেয়েছিলেন “ফুটবল যাদুকর” খেতাবটি। সামাদের খেলোয়াড়ি জীবনে এমনই বহু চিত্তাকর্ষক ঘটনা ও কাহিনী দেশে-বিদেশে অনেক ক্রীড়ামোদী মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে সর্বত্রই। সামাদ ছিলেন ফুটবল যাদুকর, তথা ফুটবল খেলার ইতিহাসের কিংবদন্তি। ফুটবল খেলার নিজস্ব টেকনিকে সামাদ ছিলেন অগ্রগণ্য।
এমনই বহু ইতিহাস তিনি সৃষ্টি করেছেন। আসমুদ্র হিমাচলের মতো সব মাঠে ছড়িয়ে আছে সে ইতিহাস মিয়ানমার, সিঙ্গাপুর, সুমাত্রা, জাভা, বোর্নিও আর চীনে।
খেলা চলাকালীন সময়ে মাঠে পায়চারী করা, সুযোগ মতো পায়ে বল পেয়ে হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে প্রতিপক্ষের গোলমুখে ছোটা। পাঁচজন প্রতিপক্ষও খেলার মাঠে তাকে আটকিয়ে রাখতে পারতো না। গোলকিপারকে কাটিয়ে গিয়ে কোন কোন সময় গোলের জালে গোল না দিয়েও ফিরে আসতেন তিনি। অর্থবাজি ধরেও গোল দিতেন। এ যুগের পেলে, ম্যারাডোনা, বেকহ্যাম, রোলানদিনহোও তার খেলা দেখলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতো। এমনই অবাক করা কিংবদন্তি ফুটবলার ছিলেন যাদুকর সামাদ।
সামাদের পারিবারিক জীবনের ইতিহাস খুব একটা পাওয়া যয় না। সম্ভবত সামাদের দ্বিতীয় স্ত্রী ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতে ইন্তেকাল করেন। সৈয়দপুরে বসবাসরত সামাদের কন্যার নাম জমিলা খাতুন চামেলী।
সামাদের পুত্র সন্তান সৈয়দ গোলাম হোসেন ভারতে বসবাসরত এবং সেখানেই তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরিরত আছেন।
দিনাজপুর শহরের বড় মাঠ প্রাঙ্গণে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে সামাদের শেষ খেলাটি অনুষ্ঠিত হয়। এরপরে সামাদ সম্ভবত ফুটবল খেলা থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশ বিভাগের কিছুদিন পরেই “যাদুকর সামাদ” ভারত থেকে সপরিবারে এদেশে চলে আসেন এবং দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি পার্বতীপুরে রেলওয়ে ডিপার্টমেন্টে ইন্সপেক্টর পদে সরকারি চাকরি করতেন। পরবর্তীতেই এই পার্বতীপুর রেলস্টেশন থেকেই তিনি চাকরিতে অবসর গ্রহণ করেন ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে। অবসর গ্রহণের পরপরই তিনি কিছুদিনের জন্য ঢাকা ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের অধীনে ফুটবল কোচের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন।
আজকের যারা তরুণ প্রজন্মের ফুটবলার তাদের অনেকেই ফুটবল যাদুকর সামাদ সম্পর্কে কিছুই জানেন না।
সে যুগে কোন টেলিভিশন বা সংবাদপত্রের এত ছড়াছড়ি ছিল না। ফলে সামাদ সম্পর্কে আমরা তার গৌরবোজ্জ্বল খেলোয়াড়ি জীবনের অনেক অজানা কথাই জানতে পারি না, ইতিহাসের মহাকলের গহ্বরে সব হারিয়ে গেছে সেসব কথা।
সামাদ যদি অবাঙালি না হতেন তাহলে হয়তো তার সম্পর্কে অনেক বই-পুস্তক পাওয়া যেতো। পাওয়া যেতো তার খেলোয়াড়ি জীবনের অজানা নানা তথ্য ও ছবি। তার সংগৃহীত দুর্লভ উপহার সামগ্রী ও নথিপত্র স্বাধীনতা যুদ্ধে তার বাসভবন পার্বতীপুর অফিসার্স রেলওয়ে কলোনি থেকে লুটপাট হয়ে যায়। ফলে ফুটবল যাদুকর সামাদ সম্পর্কে যেসব অজানা কাহিনী শোনা যায় তার মধ্যে রয়েছে যথেষ্ট বিভ্রান্তি ও অসামঞ্জস্য। পার্বতীপুরের সাহেবপাড়া কলোনিতে রেলওয়ে বিভাগের মাঝারি ধরনের একটা বাসা তার বসবাসের জন্য বরাদ্দ ছিল। শেষ জীবনে সামাদ এই পার্বতীপুরের বাসাতেই তার অতীত দিনের স্মৃতিচারণ করে সময় কাটাতেন। এই বাসাতেই এককালের ফুটবলের এই মুকুটহীন স¤্রাট, ফুটবল যাদুকর সামাদ ২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর।
কিংবদন্তি এই ফুটবল যাদুকরের বিরল প্রতিভার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তার স্মৃতি চিরভাস্মর ও স্মরণীয় করে ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশ ডাকবিভাগ সামাদের মৃত্যুর ২৯ বছর পরে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের ২ ফেব্রুয়ারি তার স্মরণে একটি স্মারক ডাকটিকেট ও উদ্বোধনী খাম প্রকাশ করে। ২৯ বছর পরে হলেও বাংলাদেশ ডাকবিভাগের এটি একটি মহৎ কাজ।
এ যুগের মানুষ তাদের অতীত ইতিহাসকে মনে রাখে না। সবাই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যস্ত। আমাদের অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ফুটবলের ইতিহাসের দিকে মানুষের দৃষ্টি ফেরাতে হবে। এখনও আমাদের দেশে দু’য়েকজন মানুষ হয়তো জীবিত থাকতে পারেন, যারা ফুটবল যাদুকর সামাদের খেলা স্বচক্ষে দেখেছেন। তার ¯েœহ, সান্নিধ্য পেয়েছেন। তারা যদি আমাদের অতীত দিনের সেই গৌরবোজ্জ্বল ফুটবলের স্মৃতিকথা লিখে রেখে যান বা অন্য কাউকে লেখার জন্য সহযোগিতা করেন, তবে অবশ্যই ফুটবল যাদুকর সামাদ সম্পর্কে তার অতীত ইতিহাসের খেলোয়াড়ি জীবনের চিত্র কিছুটা হলেও একালের ফুটবল প্রেমিক ক্রীড়ামোদি মানুষরা অবশ্যই উপকৃত হবেন বলে আমরা প্রবল আশাবাদী। সুতরাং আর সময় নষ্ট না করে সে কাজে এখনই আমাদের সক্রিয়ভাবে আত্মনিয়োগ করা উচিত। তা না হলে একটি জাতি তার অতীত ইতিহাসের ফুটবলের গৌরবোজ্জ্বল ভা-ার থেকে চিরকালের মতোই বঞ্চিত হবে। যা আর কোনকালেই পূরণ হবার নয়।
সামাদের মৃত্যুর পর তার বরাদ্দকৃত বাসাটিও বেদখল হয়ে যায়। পরবর্তীতে তার কবরের উপর পাকা ছাউনি ছাড়া পার্বতীপুরে সামাদের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তার যেটুকু স্মৃতি গল্প-কাহিনী হিসেবে আছে তাও আজ বিস্মৃত-প্রায়। দিনাজপুর জেলা প্রশাসন বিগত প্রায় দেড় যুগ আগে ৫৪ হাজার টাকা ব্যয়ে পার্বতীপুরে সামাদের কবরটি পাকা করে, কবরের অনেক কাজ এখনও অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।
সামাদের ব্যবহার্য আসবাবপত্র, উপহারসামগ্রী ও তার দুর্লভ প্রাইজসমূহ সংগ্রহ করে পার্বতীপুরে সামাদের এই বরাদ্দকৃত ঐতিহাসিক ভবনটি অনায়াসেই সামাদ স্মৃতি যাদুঘর করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে আমাদের দেশের নিবেদিত ফুটবল ক্রীড়ামোদি ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যারা রয়েছেন তারা অবশ্যই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসবেন। আজ সামাদের ৫২তম মৃত্যুবার্ষিকীতে (২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু) তাকে জানাই হৃদয়ের অফুরন্ত ভালোবাসা। তার আত্মার শান্তি কামনা করছি।
লেখক : গবেষণা সম্পাদক, অভিযাত্রিক সাহিত্য সংসদ, রংপুর।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।