Inqilab Logo

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ফিরতে শুরু করেছে সোনালী আঁশের পুরোনো ঐতিহ্য

প্রকাশের সময় : ২ জুন, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নুরুল আলম বাকু, দামুড়হুদা (চুয়াডাঙ্গা) থেকে : চলতি মৌসুমে দামুড়হুদায় পাটের আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। বেশ ক’বছর ধরে এ খাতের নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও প্রতিক‚ল আবহাওয়াসহ পাট চাষ করে দাম না পেয়ে কৃষকের লোকসানের কারণে পাট চাষের পরিমাণ কমে গিয়েছিল। সম্প্রতি সরকার পাটের হারানো ঐতিহ্য ফেরাতে সেইসাথে পরিবেশ রক্ষায় পাট উৎপাদন ও পলিথিন, সিন্থেটিকের পরিবর্তে পাটের ব্যবহারের প্রতি গুরুত্বারোপ করে দেশে উৎপাদিত সার, চাল, চিনি, সিমেন্ট, ফসলের বীজসহ বিভিন্ন পণ্য বাজারজাত করতে পাটের তৈরি ব্যাগ ব্যবহারের উপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করে আইন পাস করে। প্রশাসনিকভাবে আইনের প্রয়োগ শুরু করায় মানুষ পাটের ব্যাগ ব্যবহারের প্রতি উৎসাহিত হচ্ছে। বর্তমানের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারলে আবারও পাটের হরানো ঐতিহ্য কিছুটা হলেও ফিরে আসবে বলে অভিমত অনেকের। জানা যায়, চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলায় এক সময় দেশের প্রথম সারির অর্থকরী ফসল সোনালী আঁশ খ্যাত পাটের ব্যাপক আবাদ হত। দামুড়হুদায় উৎপন্ন পাটের মান অত্যন্ত ভাল হওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকায় এর ব্যাপক চাহিদা ছিল। দামুড়হুদার হাট-বাজার ও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খুলনা, যশোর নওয়াপাড়া, দৌলতপুর, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, নারায়ণগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাট চালান হত। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বেপারীরা এসে দামুড়হুদার বিভিন্ন মোকাম থেকে পাট কিনে নিয়ে যেত। এক কথায় দামুড়হুদা তথা চুয়াডাঙ্গার পাটের ব্যাপক চাহিদা ছিল। কারণ হিসেবে জানা যায়, এ অঞ্চলের মাটি ও পানি পাট চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। দামুড়হুদার বটতলীর বিল, ভৈরব নদ, দলকা বিল, রায়সা বিলের পানিতে জাগ দেয়া পাটের আঁশ এবং রং ভাল হওয়ায় তুলনামূলকভাবে এ পাটের চাহিদা ভাল। অনান্য স্থানের পাটের তুলনায় দামও প্রতি মণে ২৫/৩০ টাকা বেশি। উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে উপজেলায় পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৭হাজার ২৫০ হেক্টর জমি। সেক্ষেত্রে অর্জিত হয়েছে ১০হাজার ৪৫০হেক্টর জমি। যা গত বছরের তুলনায় ৩হাজার ২শ’ হেক্টর বেশি। বিগত বছরগুলোতে পাট আবাদে সার, বীজ, কীটনাশক, সেচ, শ্রমিকের মজুরী বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি সেইসাথে উৎপাদিত পাটের বাজারদর না পাওয়ায় এবং অন্যান্য ফসলের আবাদ করে পাটের তুলনায় লাভবান হওয়ায় কৃষকরা পাটের আবাদ ভুলতে বসেছিল। গত বছর সরকার দেশে পাটের ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিত ও আবাদের প্রতি গুরুত্ব দেয়ায় পাটের বাজারদর ভাল অবস্থায় পৌঁছায়। ফলে পাটের ভাল বাজারদর পেয়ে লাভবান হওয়ায় এলাকার চাষিরা এবার ব্যাপকভাবে পাটের আবাদে ঝুঁকে পড়ে। তারই ফলশ্রæতিতে বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ৩ হাজার ২শ’ হেক্টর বেশি জমিতে পাটের আবাদ হয়েছে। উপজেলার পাটচাষি গোপালপুর গ্রামের শরিফ উদ্দীন বলেন, জমির ভূট্টা তুলে পাট বপনের জন্য ২ বিঘা জমিতে চাষ দিয়ে রেখেছিলাম। মৌসুমের শুরুর আগেই আগাম বৃষ্টিপাত হওয়ায় জমিতে জো আসার সাথে সাথে পাট বুনানি করেছিলাম। মাটিতে জো থাকায় চারাও ভাল গজায়। এরপর কিছুদিন প্রচÐ খরার কবলে পড়ে পাটের গাছ শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। দীর্ঘ খরার পর সম্প্রতি বৃষ্টিপাত হওয়ায় বর্তমানে পাট ক্ষেতের চেহারা ভাল। নিড়ানিসহ পরিচর্যা চলছে। আবহাওয়া ভাল থাকলে ভাল ফলন হবে আশা করছি। নাস্তিপুর গ্রামের পাটচাষি জাকির চৌধুরী বলেন, কয়েক বছর পাটের আবাদ করে দাম ভাল না পওয়ায় লোকসান হয়েছে। গত বছর দুই বিঘা জমিতে পাট চাষ করে ভাল বাজারদর পেয়েছিলাম। তাই এবার ৪বিঘা জমিতে পাটের আবাদ করেছি। এছাড়া গত বারের তুলনায় এলাকার সব মাঠেই পাটের আবাদ বেশি। বর্তমানে যে বাজারদর আছে পাট ওঠা পর্যন্ত এ বাজারদর থাকলে আবার মানুষ আগের মত পাটচাষের দিকে ঝুঁকে পড়বে। উপজেলার দর্শনা বাজারের পাট ব্যবসায়ী আঃ রহমান, আমিরুল ইসলাম, নাসির উদ্দীন খেদু বলেন, বর্তমানে বাজারে প্রতিমণ পাট ২১শ’ টাকা থেকে ২২শ’ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এবার পাটের চাহিদাও ভাল। বাজারদর ও চাহিদা ভাল থাকায় চাষিদের পাশাপাশি এবার পাটের ব্যবসা করে ব্যবসায়ীরাও লাভবান হয়েছে। বাজারদর এভাবে থাকলে আবারও এলাকার মানুষ পাট চাষে আগ্রহী হয়ে উঠবে। ব্যবসায়ীরা জানান, বিগত বছরগুলোতে সস্তায় পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর পলিব্যাগের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে দেশে পাটের তৈরি ব্যাগের চাহিতা কমতে কমতে একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। ফলে পাটের ব্যবহার কমে গিয়ে ও সেই সাথে বিদেশে পাট রপ্তানি কমে যাওয়ায় পাটের বাজারে ধস নামে। ভাটা পড়ে পাঠের আবাদে। সম্প্রতি সরকার সার, চাল, চিনি, সিমেন্ট, ফসলের বীজসহ বিভিন্ন পণ্য বাজারজাত করতে পাটের তৈরি ব্যাগ ব্যবহারের উপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করায় ও সেইসাথে পাটচাষের প্রতি গুরুত্ব দেয়ায় আবারও পাটের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের এক সময়ের রপ্তানিপণ্যের তালিকায় শীর্ষে থাকা সোনালি আঁশ পাট আবারও তার ঐতিহ্য ফিরে পাবে। সোনালী আঁশ খ্যাত পাটের পুরোনো ঐতিহ্য ফেরাতে এ খাতের নানা অনিয়ম দূর করে দেশে পাটজাত পণ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতকরণসহ সরকারি-বেসরকারিভাবে বিদেশে কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া প্রযোজন। এ উদ্যোগ সফল হলে আবারও “বাংলার সোনালি আঁশ” পাট তার ঐতিহ্য ফিরে পাবে। সেইসাথে একদিকে যেমন দেশের লক্ষ লক্ষ কৃষক পাটচাষ করে লাভবান হতে পারবে অপর দিকে পাট ও পাটজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে দেশ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ফিরতে শুরু করেছে সোনালী আঁশের পুরোনো ঐতিহ্য
আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ