Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মিথ্যা ঘোষণায় রাজস্বহানি

শফিউল আলম | প্রকাশের সময় : ১৮ জুন, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

আমদানি ডকুমেন্টে গোঁজামিল চট্টগ্রাম বন্দর কাস্টমসে অসৎ চক্রের যোগসাজশ : নেপথ্যে জড়িত রুই-কাতলা : সরকারের হার্ডলাইন


মিথ্যা ঘোষণায় রাজস্বহানি হচ্ছে ব্যাপক। নেপথ্যে তৎপর রাজস্ব ফাঁকিবাজ রুই-কাতলারা। প্রধান সমুদ্র বন্দরভিত্তিক দেশের একক বৃহৎ রাজস্ব প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস ঘিরে চলছে রাজস্ব ফাঁকিবাজদের অদৃশ্য দাপট। সরকারের শুল্ক-কর নিয়মমাফিক পরিশোধ করেও নানামুখী হয়রানি জটিলতার কারণে ফতুর হতে হচ্ছে চট্টগ্রাম ও ঢাকার প্রকৃত, সৎ, ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়ী-শিল্প মালিকদের। আর রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে রাজস্ব ফাঁকিবাজ চক্রটি। শুল্ক-কর রাজস্বহানির পরিণতিতে সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ব্যাহত। সরকার বিশেষ করে অর্থ মন্ত্রণালয় আসছে ২০১৯-২০ অর্থবছরে মিথ্যা ঘোষণায় এহেন রাজস্ব ফাঁকি রোধে হার্ড লাইনে যাচ্ছে। একথা জানা গেছে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র থেকে। এরজন্য অনিয়মের তাবৎ ফাঁক-ফোঁকড় বন্ধ করা এবং চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস পূর্ণাঙ্গ অটোমেশনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানায়, আমদানি বাণিজ্যে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট বা কাগজপত্রে কারসাজি-কারচুপি গোঁজামিলসহ হরেক উপায়ে শুল্ক-কর ফাঁকি দেয়া হচ্ছে। মিথ্যা ঘোষণায় রাজস্ব ফাঁকির প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর পেছনে চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হাউসে একটি অসৎ সিন্ডিকেটের প্রত্যক্ষ যোগসাজশ রয়েছে। এর মাধ্যমে ঘাট পার হয়ে যায় বহু চালান। আর ধরা পড়ে প্রকৃত মিথ্যা ঘোষণায় আনীত চালানগুলোর আংশিকমাত্র। তাছাড়া রফতানির ক্ষেত্রেও কোনো কোনো সময়ে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য পার পেয়ে যাচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাজার ও দেশের সুনাম।

মিথ্যা ঘোষণায় রাজস্ব ফাঁকি রোধসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যর্থতার জন্য বাজেট ঘোষণার ঠিক আগেই চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের শীর্ষ পর্যায়ে ‘আকস্মিক’ রদবদল আনা হয়েছে। গত ৯ জুন কাস্টম হাউসের নয়া কমিশনার মোহাম্মদ ফখরুল আলম দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দেশের সর্ববৃহৎ এ কাস্টমসের টপ টু বটম পর্যায়ে আরও ব্যাপক ধরনের পরিবর্তনের চিন্তা-ভাবনা করছে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। তাছাড়া অতি সম্প্রতি মিথ্যা ঘোষণায় ডকুমেন্ট জালিয়াতির মাধ্যমে প্লাস্টিক দানার পরিবর্তে আনীত ৩০ কন্টেইনার ভর্তি সিমেন্টের চালান কাস্টমসের হাতে ধরা পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে। যাতে রয়েছে বড় ধরনের শুভঙ্করের ফাঁকি।

প্রাণ গ্রæপের নামে আনীত এই চালানে রাজস্ব ফাঁকির হেরফের বিশাল। কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, প্লাস্টিক দানা আর সিমেন্টের শুল্ক-করে পার্থক্য হয় ৩ কোটি টাকারও বেশি। মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি মূল্যের বাড়তি অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে কিনা কর্তৃপক্ষ তা খতিয়ে দেখছে। প্রাণ গ্রæপের আমদানি ডকুমেন্ট অনুযায়ী শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত প্লাস্টিক দানা হিসাবে শুল্ক-করের পরিমান ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা। কিন্তু সিমেন্টের হিসাবে শুল্ক-কর আসে ৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এ ব্যাপারে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ মামলা দায়েরের পর আরও তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে আমদানি বাণিজ্যে মিথ্যা ঘোষণা, ডকুমেন্টে কারসাজি ও গোঁজামিলের মাধ্যমে পণ্যসামগ্রীর অবৈধ আমদানি এবং রাজস্ব ফাঁকি ঠেকানো যাচ্ছেই না। বন্দর-কাস্টমস, সিএন্ডএফ ও আমদানিকারকের সংঘবদ্ধ একটি অসৎ চক্রের যোগসাজশে ‘ঘাট’ পার হয়ে যায় অনেক চালান। তাছাড়া চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের জনবল, দক্ষতা, প্রশিক্ষণ, আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তির ঘাটতিও রয়েছে। বিভিন্ন কৌশলে মিথ্যা ঘোষণায় আসছে অবৈধ পণ্যের চালান। আমদানি নিষিদ্ধ মালামালও আসছে।

কাস্টম হাউসে দাখিল করা আমদানি সংক্রান্ত কাগজপত্রে ঘোষণা দেয়া হয় একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর পণ্যের। কিন্তু বাস্তবে আনা হয় আরেক পণ্য। অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসজাত পণ্য, মদ, সিগারেট এমনকি বালি, মাটি, সিমেন্ট, কাদামাটি, পাথর, তাস প্রভৃতি আনা হয়েছে ধরা পড়া বিভিন্ন আমদানি চালানে। কোনো কোনো পণ্যসামগ্রী আমদানিকারক দীর্ঘদিন ধরে খালাস ও ডেলিভারি না নেয়ার কারণে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ শতভাগ কায়িক পরীক্ষা করতে গিয়ে গোঁজামিল ধরা পড়ছে। এর মধ্যদিয়ে শুল্ক-কর তথা রাজস্ব হারের বড় ধরনের তারতম্য ঘটছে। একশ্রেণির অসৎ ব্যবসায়ী-আমদানিকারক, সিএন্ডএফ এজেন্টের ধূর্ততার কৌশলের কারণে অনেক চালান ধরা পড়েনা। আমদানি গোঁজামিল ও মিথ্যা ঘোষণায় সরকারের কোটি কোটি টাকার রাজস্বহানি ঘটছে। আর তা গিলছে রুই-কাতলারা।

ডকুমেন্টে গোঁজামিল ও মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে পণ্য আমদানি করে শুল্ক-করের ব্যাপক মাত্রায় তারতম্য বা হেরফের ঘটিয়ে রাজস্ব ফাঁকির প্রবণতা চলে আসছে দীর্ঘদিন যাবত। জাল, ভুয়া অথবা মিথ্যা ঘোষণায় শিল্পের যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ, শিল্প কাঁচামাল, ভোগ্যপণ্য প্রভৃতি আমদানির নামে ঘোষণা বহির্ভূত অন্য কোনো ধরনের মালামাল আমদানি করা হয়। আনীত সেসব পণ্যসামগ্রী দেশে অবৈধভাবে বাজারজাত করা হয়। আবার প্রতিবেশী দেশেও পাচার হচ্ছে। এতে করেই ফাঁকি দেয়া হচ্ছে বিপুল অংকের রাজস্ব। মিথ্যা ঘোষণায় আনীত পণ্যের পেছনে ব্যাপকভাবে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশীয় শিল্প-কারখানা হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত।

উচ্চহারে শুল্কায়ন যোগ্য পণ্যকে কম শুল্কহারের পণ্য হিসেবে দেখিয়ে এবং নিম্নতম শুল্ক-করের শ্রেণির এমনকি নামমাত্র ও শূণ্য শুল্কহারের পণ্য হিসেবে আমদানির মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অসৎ সিন্ডিকেট ঘোষণা বহির্ভূত পণ্য আমদানি করছে। ডকুমেন্টে এক পণ্যের নামে আরেক শ্রেণির পণ্যের ঘোষণা দেয়ার কারণেই শুল্ককর হারে ব্যাপক তারতম্য ঘটছে। রাজস্ব ফাঁকি হচ্ছে বিপুল পরিমানে। এ ধরনের ঘটনা যখন শতভাগ কায়িক পরীক্ষায় ধরা পড়ে তখন কাস্টমস কর্তৃপক্ষ মামলা দায়ের এবং জরিমানাসহ বাড়তি শুল্ককর আদায়ের পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
আমদানি ডকুমেন্টের বিপরীতে মিথ্যা ঘোষণা ও জালিয়াতির মাধ্যমে প্লাস্টিক দানার পরিবর্তে সিমেন্ট আমদানি করায় চট্টগ্রাম বন্দরে প্রাণ গ্রæপের আনীত ৩০টি কন্টেইনারের বড়সড় চালান আটকে দেয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। চালানটি খালাস করে নেয়ার আগেই আটকে যায়। কাস্টমস কর্মকর্তারা গত ১১ জুন চট্টগ্রাম বন্দরের ইয়ার্ডে কন্টেইনারগুলোর কায়িক পরীক্ষা সম্পন্ন করার পর এ বিষয়টি ধরা পড়ে। প্লাস্টিক দানা ঘোষণা দিয়ে সউদি আরবের একটি ব্র্যান্ডের সিমেন্ট আমদানি করেই শুল্ক ফাঁকির অপচেষ্টা হয়। দুবাই বন্দর থেকে প্রাণ ডেইরি লিমিটেডের নামে ৩০টি কন্টেইনারে চালানটি গত ২৬ মে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। ওইদিনই চালান খালাসের জন্য ডকুমেন্ট জমা দেয় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। চালানে ৫ লাখ ৬৬ হাজার ডলার মূল্যের ৫১০ মেট্রিক টন প্লাস্টিক দানা আমদানির ঘোষণা ছিল। যা সাড়ে ৫ কোটি টাকা।

ঈদের ছুটির সময় ৬ জুন রাতে আমদানিকারকের পক্ষে কন্টেইনার খালাসের চেষ্টা হয়। এ সময় দুটি কন্টেইনার খুলে সিমেন্টের বস্তা দেখেন কর্তব্যরত কাস্টমস কর্মকর্তারা। তখন ৩০টি কন্টেইইনার লক করে সেগুলোর খালাস বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়। ঈদের ছুটি শেষে কায়িক পরীক্ষা সম্পন্ন হয়। ৩০টি কন্টেইনার খুলে দেখা যায়, চালানটিতে সউদি আরবের জেবেল আলী ব্র্যান্ডের সিমেন্টের বস্তায় ভর্তি। প্রতি বস্তায় ৫০ কেজি সিমেন্ট। একেকটি কন্টেইনারে ৩৪০টি করে বস্তা। ৩০টি কন্টেইনারে ১০ হাজার ২৫০টি বস্তায় মোট ৫১০ মেট্রিক টন সিমেন্ট। অথচ ডকুমেন্টে ঘোষণা অনুযায়ী প্লাস্টিক দানার হসিদ নেই কোথাও। প্লাস্টিক দানার শুল্ক-কর হার ৩২ শতাংশ। আর সিমেন্টের শুল্ককর ৯১ শতাংশ।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাজস্ব


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ