বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
মানুষের এ ক্ষণস্থায়ী জীবনে মানুষ কত কিছুরই তো নিশ্চয়তা দেয়। তিন মাস ছয় মাস থেকে শুরু করে পাঁচ-দশ-বিশ বছরের সেবার নিশ্চয়তাও দেয়া হয় বিভিন্ন পণ্যে।
মানুষের জীবনযাত্রা যত উন্নত হচ্ছে, এ নিশ্চয়তার পরিমাণও তত বাড়ছে। কিন্তু মানুষ কি কখনো জীবনের নিশ্চয়তা দিতে পেরেছে? এমনকি জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছে? সূর্যের আলোর মতোই স্পষ্ট কথা হলো- মানুষের জীবন ও মৃত্যু নিয়ে কেউ কখনোই কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। কে কতদিন বেঁচে থাকবে- এটা যেমন কখনো কারো পক্ষে বলে দেয়া সম্ভব হয়নি, তেমনি গুরুতর অসুস্থ কাউকে দেখে সে কখন এ দুনিয়া থেকে বিদায় নেবে- এটাও সুনিশ্চিত করে বলতে পারেনি কেউ। যা কিছু বলা হয় সবটাই অনুমাননির্ভর। এ অনুমান কখনো টেকে, কখনো টেকে না।
আর কথা কি, জীবনযাত্রা ও বিজ্ঞানের উন্নতির পথ ধরে মানুষের নিজের তৈরি পণ্যে নিশ্চয়তা প্রদান যেভাবে বাড়ছে, মানুষের নিজের জীবন যেন ততটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। আকস্মিক মৃত্যু কত রূপ নিয়ে এখন আমাদের সামনে হাজির হয়! অবশেষে কথা তো একটাই- ‘যখন তাদের নির্ধারিত (মৃত্যুর) সময় উপস্থিত হয় তখন তারা আর এক মুহূর্তও বিলম্ব করতে পারে না এবং এর চেয়ে একটু এগিয়েও আসতে পারে না।’ -সূরা ইউনুস (১০) : ৪৯
এ তো গেল জীবন-মৃত্যুর কথা। কিন্তু এ জীবনের শেষ পর্যন্তও যে সুখে-সাচ্ছন্দ্যে কাটবে, আরাম-আয়েশে কাটবে- এরই বা নিশ্চয়তা কোথায়! ‘নদীর এপার ভাঙে ওপার গড়ে এই তো নদীর খেলা/সকালবেলার ধনী রে তুই ফকির সন্ধ্যাবেলা’- এ তো রূপকথার কোনো গল্প নয়, বরং আমাদের চারপাশে ঘটতে থাকা বাস্তবতা।
সামান্য সময়ের ব্যবধানে সারাজীবনের উপার্জন হারিয়ে সহায়-সম্বল অর্থবিত্ত সব হারিয়ে কতজন নিঃস্ব হয়ে যায়! চোখের পলকে আকস্মিক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে যারা হাত-পা হারিয়েছে, কিংবা শরীরের অন্য কোনো অঙ্গ আহত হয়েছে, তাদের অবস্থাও তো একই রকম। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সবাইকে এমন বিপদ থেকে হেফাজত করুন। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : ‘সাতটি বিষয়ের পূর্বে তোমরা দ্রুত নেক আমল করো।
তোমরা কি এমন দারিদ্র্যের অপেক্ষা করছ, যা তোমাদের সবকিছু ভুলিয়ে দেবে? না ওই ঐশ্বর্যের, যা তোমাদেরকে দর্পিত বানিয়ে ছাড়বে? নাকি এমন রোগের, যার আঘাতে তোমরা জরাজীর্ণ হয়ে পড়বে? না সেই বার্ধক্যের, যা তোমাদের অথর্ব করে ছাড়বে? নাকি মৃত্যুর, যা আকস্মিক এসে পড়বে? নাকি দাজ্জালের, অনুপস্থিত যা কিছুর জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে, সে হচ্ছে সেসবের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট? না কিয়ামতের অপেক্ষা করছ, যে কিয়ামত কি না সর্বাপেক্ষা বিভীষিকাময় ও সর্বাপেক্ষা তিক্ত? -জামে তিরমিযী, হাদিস ২৩০৬
এই হাদিসে হযরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের উপরোক্ত বাস্তবতাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন। মানুষ যে কোনো মুহূর্তে চরম সঙ্কটের মুখে পড়তে পারে, কিংবা ঐশ্বর্যের ধাক্কায় সে অহঙ্কারী ও অবাধ্য হয়ে পড়তে পারে, তার সুস্থ দেহটি যে কোনো সময়ই অসুস্থতায় আক্রান্ত হতে পারে, বার্ধক্যের আঘাতে হারিয়ে যেতে পারে যৌবনের শক্তি-সামর্থ্য, অকস্মাৎ থাবা বিস্তার করতে পারে মৃত্যু, নেমে আসতে পারে দাজ্জালের ফেতনা কিংবা কিয়ামত।
তাই নেক কাজের জন্য কোনো অপেক্ষা নয়। হাদিসের শিক্ষা হচ্ছে- যখন তুমি যে অবস্থাতেই থাক, সাধ্যমতো নেক কাজ করতে থাক। অবস্থা পরিবর্তনের অপেক্ষায় থেকে সময় পার করে দিও না। আজ যে সচ্ছল, পকেটভর্তি যার টাকা-পয়সা, সে ভাবতে পারে- হাতে তো টাকা আছেই, যে কোনো সময় চাইলেই তো দানসদকা করা যাবে, অকাতরে বিলিয়ে দেয়া যাবে অর্থকড়ি। এখন তাড়াহুড়োর কী আছে? কিন্তু এ নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে কোথায়- আজ হাতে যে অর্থসম্পদ রয়েছে, তা চিরদিনই থেকে যাবে?
এ নিশ্চয়তা দেয়া তো কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। তাহলে হাতে টাকা-পয়সা থাকার পরও, দানসদকা করার মতো পর্যাপ্ত সুযোগ থাকার পরও আগামীকালের অপেক্ষায় আজকের দিনটি পার করে দেয়া কি দরিদ্রতা ও সঙ্কটের মুখে পড়ার অপেক্ষা নয়? সে সঙ্কটের আঘাতের তীব্রতায় হয়তো তুমি আল্লাহর কথাই ভুলে যাবে? দানের প্রশ্ন তো তখন বলাই বাহুল্য। তখন আক্ষেপ আর অনুশোচনা ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা থাকবে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।