বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
হজরত আমির খসরু ছিলেন হজরত খাজা নিজামউদ্দীন আওলিয়া এর প্রিয় মুরিদ এবং যুগের সেরা কবি। তার উপাধি ছিল ইয়ামিনুদ্দীন এবং কবি নাম খসরু। সুলতানগণের দরবারে ও নিজামী খানকাহ এর মধ্যে তার নাম, মর্যাদা, সম্মান ছিল। খাজা সাহেব তাকে ‘তুর্কুল্লাহ’ খেতাব দিয়েছিলেন এবং সংক্ষেপে ‘তুর্ক’ বলে ডাকতেন। তিনি প্রায় বলতেন ‘আমি নিজের অস্তিত্ব সম্পর্কে কখনো কখনো পেরেশান (চিন্তিত) হয়ে যাই, কিন্তু তুর্কের ব্যাপারে কখনো চিন্তিত হই না। কিয়ামত দিবসে যখন আমাকে প্রশ্ন করা হবে, আমালের তালিকা পেশ করো, তখন আমি তোমাকে পেশ করব।’ খাজা সাহেবের নিকট এমনি গুণাবলির অধিকারী আমির খসরু। তিনি যেহেতু রাজদরবারেও অনুরূপ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন, তাই কখনো কখনো বিশেষ প্রয়োজনে রাজ দরবার ও খানকার সাথে দূত হিসেবে উভয়ের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন।
চিশতি মাশায়েখের মধ্যে অনেকেই ছিলেন যারা রাজদরবারে গমন করা কিংবা সুলতান-বাদশাহগণের সাথে যোগাযোগ ও সম্পর্ক স্থাপন করতেন না। এমনকি তাদের দরবারে সুলতান-বাদশাহগণের আসা-যাওয়া হোক তাও চাইতেন না। খাজা নিজামউদ্দীন আওলিয়াও ছিলেন তাদের একজন। তিনিও কোনো রাজদরবারে গমন করেননি এবং তার দরবারে সুলতান-বাদশাহগণের আগমন হোক, তাও তিনি কামনা করেননি। বলতে গেলে তার দরবারে সুলতান-বাদশাহগণের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। এ জন্য তিনি কোনো কোনো সুলতান বা বাদশাহর বিরাগভাজনও হয়েছেন। তিনি কোনো কোনো বাদশাহর রোষানলেও পড়েছিলেন। এ পর্যায়ে কয়েকটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সুলতান আলাউদ্দীন খিলজী খাজা সাহেবের অত্যন্ত ভক্ত ছিলেন। তাঁর পুত্র খিজির খান খাজা সাহেবের মুরিদ ছিলেন। কুতুবুদ্দীন মোবারক শাহ খিজির খানকে হত্যা করে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর হজরত মাহবুবে এলাহীর প্রতি শত্রæতা আরম্ভ করেন। তিনি তার প্রতি নানাভাবে কষ্ট দিতেন। তবে তার দরবারের আমির ওমারা ও দরবারীদেরও ভয় করতেন। কেননা তারা সবাই ছিলেন খাজা সাহেবের মুরিদগণের অন্তর্ভুক্ত।
এক দিন মোবারক শাহ কাজী মোহাম্মদ গজনভীকে জিজ্ঞাসা করেন যে, ‘নিজামউদ্দীনের খানকাহয় দৈনিক যে খরচ হয় তা কোথা থেকে আসে, সূত্র কি?’ কাজী জবাবে বললেন, ‘হে সুলতান! এই খরচ আপনার আমির ওমারা ও কর্মচারীগণই তাকে নজরাজা হিসেবে পেশ করে।’ সে সময় খাজা সাহেবের শুধু লঙরখানার খরচ ছিল দৈনিক দুই হাজার ‘তংকা’ (প্রচলিত মুদ্রা) মোবারক শাহ ফরমান জারি করলেন যে, ‘শাহজাদা সর্দার, কর্মচারী এবং সুলতানী দরবারের সাথে সংশ্লিষ্টরা ব্যতীত সুলতানী শাসনের সাথে জড়িত যদি কোনো ব্যক্তি খাজা নিজামুদ্দীনের নিকট গমন করে অথবা তাকে নজরানা পেশ করে তাহলে তার সম্পত্তি জব্দ করা হবে। এতদ্ব্যতীত তার চাকরি যাবে এবং দরবার হতে বহিষ্কার করা হবে।’
এ ঘোষণার খবর খাজা সাহেব অবগত হন। তিনি তার ব্যক্তিগত খাদেমকে ডেকে নির্দেশ দিলেন, ‘আজ হতে লঙরখানার খরচ ‘চার হাজার টাকা’ দৈনিক হবে এবং দিল্লিতে ঘোষণা প্রচার করে দেয়া হোক, কোনো ব্যক্তি অভুক্ত শোবে না, যখন টাকার প্রয়োজন হবে আমাদের কক্ষের তাকে হাত বাড়িয়ে যত প্রয়োজন তাক হতে নিতে থাকবে।’ মোবারক শাহ এর খবরদাতাগণ তাকে এ ঘটনা শোনালে তিনি হতবাক হয়ে যান।
তিনি মাহবুবে এলাহীকে পয়গাম পাঠান যে, ‘শেখুল মাশায়েখ রোকুনুদ্দীন আবুল ফাতাহ আমার দরবারে আগমন করবেন, কিন্তু আপনি দিল্লিতে অবস্থান করা সত্তে¡ও কখনো আসেননি। আপনার কর্তব্য সপ্তাহে এক দিন দরবারে উপস্থিত হওয়া।’ খাজা সাহেব জবাব প্রেরণ করলেন, ‘আমাদের জীবনে তরিকা ছাড়া কখনো এই প্রথা ছিল না, তারা দরবারগুলোতে হাজির হওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। সুতরাং আমাকে এ হুকুম মেনে চলতে অক্ষম গণ্য করা হোক।’ মোবারক শাহ তার হঠকারিতায় অটল থাকেন যে, খাজা সাহেবকে দরবারে অবশ্যই হাজির হতে হবে। ঘটনাচক্রে কিছু দিন পর তার পীর শেখ শাহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী এর ইন্তেকাল হয়ে যায়। দ্বিতীয় দিন নেতৃস্থানীয় সকল মোবারক শাহের সঙ্গে ফাতেহাখানির জন্য উপস্থিত হন। বাদশাহ এর অংশগ্রহণের কারণে মাজারে আগতদের ভিড় জমে যায়। খাজা নিজামউদ্দীন আওলিয়াও সেখানে পৌঁছেন। মোবারক ব্যতীত প্রায় সকল লোক খাজা সাহেবকে দেখে তার সম্মানে দাঁড়িয়ে যায়। খাজা সাহেবের প্রতি এ সম্মান প্রদর্শন মোবারক শাহের পছন্দ হলো না। তিনি একজন আমিরকে ইশারা করলেন।
আমির খাজা সাহেবের সামনে গিয়ে বললেন, ‘শেখ! এই সমাবেশে মহামান্য বাদশাহ শুভাগম করেছেন। আপনি যদি সালাম পেশ করতে চান তা হলে খাদেমদের মাধ্যমে তাকে জানানো হবে।’ খাজা জবাব দিলেন : ‘দরবেশ এখানে একজন ফেরেশতা চরিত বুজর্গের আত্মার প্রতি ফাতেহা পাঠ করতে হাজির হয়েছেন। দিল্লির আসল বাদশাহ তো তিনিই ছিলেন, যিনি চলে গেছেন। এখন তুমি আমাদেরকে কোনো বাদশাহ এর কথা বলছ।’ এ কথা বলে তিনি ফাতেহা পাঠ করেন এবং চলে যান।
খাজা সাহেবকে দরবারমুখী করতে ব্যর্থ হয়ে মোবারক শাহ আরেকটি নতুন কৌশল অবলম্বন করেন। তিনি এবার নিজামী খানকাহর নামে সতর্কবাণী প্রেরণ করেন, যা ছিল এইরূপ : ‘খাজা নিজামউদ্দীন আওলিয়া যদি প্রতি সপ্তাহে একবার দরবারে আসতে না পারেন, আসবেন না, কিন্তু প্রতি মাসে একবার অবশ্যই আসতে হবে। তা না হলে আমি ভিন্ন পথ অনুসরণ করতে বাধ্য হব।’
যথারীতি খাজা সাহেব এ পয়গাম পেয়ে যান। তার প্রিয় মুরিদ আমির হাসান আল সাঞ্জাবী পরামর্শ দিলেন, ‘এই মাসের শেষ তারিখে কিছুক্ষণের জন্য রাজদরবারে গমন করলে আমার মতে অসুবিধার কিছু নেই।’ তিনি হেসে বললেন : ‘দেখ, কি ঘটে!’ বাক্যটিকে তার সম্মতি মনে করে সুলতানকে জানিয়ে দেয়া হলো যে, খাজা সাহেব আসবেন। এতে বাদশাহ খুব আনন্দিত হলেন।
২৭ শওয়াল তারিখে খাদেমরা বলল, তার চাঁদ রাতে রাজদরবারে পৌঁছার কথা। খাজা বিস্ময়ের সাথে জবাব দিলেন, ‘আমি কি দরবারে যাওয়ার কথা বলেছি! আমি শুধু বলেছিলাম দেখ, কি ঘটে?’ ২৯ তারিখ এশার সময় খাজা সাহেবের খানকাহয় খবর আসে যে, ‘মহল হাজার সতুন’ এ সুলতান কুতুবুদ্দীনকে তার বিশেষ গোলাম খসরু খান হত্য করেছে।
সুলতান গিয়াসউদ্দীন তোগলক খাজা সাহেবের বিরোধিতা আরম্ভ করেন। তিনি বাঙালার অভিযান শেষ করে দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করবেন। তিনি খাজা সাহেবের নামে এই নির্দেশ প্রেরণ করেন, ‘আমার দিল্লি পৌঁছার পূর্বেই তোমাকে চিরদিনের জন্য গিয়াসপুর ছেড়ে চলে যেতে হবে।’ খাজা অসুস্থ ছিলেন। তিনি সুলতানের নির্দেশ শুনে জবাব দিয়েছিলেন, ‘হনুজ দিল্লি দূরাস্ত”। অর্থাৎ, ‘দিলিী এখনো দূরে।’
সুলতান দিল্লির নিকট আফগান নামক স্থানে অবস্থান করছিলেন। ভোরে তার নদী পার হয়ে দিল্লিতে প্রবেশের কথা। এর এক রাত পরে তারই উত্তরসূরি ওলুগ খান তাকে একটি জাঁকজমক প্রাসাদে দাওয়াত করেন। প্রাসাদটি বিশেষভাবে তার জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল। সুলতান প্রাসাদে প্রবেশ করামাত্র অকস্মাত ছাদ ভেঙে তার মস্তকে পতিত হয় এবং সুলতান সঙ্গে সঙ্গে মারা যান। এরপর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র মোহাম্মদ তোগলক ক্ষমতাসীন হন এবং তিনি ছিলেন খাজা সাহেবের পরম ভক্ত।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।