Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শাহজাদা মোহাম্মদের সাথে বেশি কথা বলতেন ওবামা

আরবের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী শাসক-২

নিউ ইয়র্ক টাইমস | প্রকাশের সময় : ৯ জুন, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

বর্তমানে শাহজাদা মোহাম্মদের পক্ষে কাজ করা কমপক্ষে ৫ ব্যক্তি এ তদন্ত সংশ্লিষ্ট অপরাধ তদন্তের সম্মুখীন হয়েছেন। তিন দশক ধরে নিয়মিত যুক্তরাষ্ট্র সফরকারী শাহজাদা মোহাম্মদ গত দুই বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র সফর থেকে বিরত রয়েছেন। এর আংশিক কারণ এ আশংকা যে কৌঁসুলিরা তাকে বা তার সহযোগীদের প্রশ্ন করবেন। তবে তার ভাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রে ইউএই দূতাবাস এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছে। শাহজাদার বহু আমেরিকান সমর্থক বলেন যে মার্কিন নীতি রূপায়নে তার বিচক্ষণতার সহায়তা নেয়া মাত্র। বহু সরকারই এটা করে থাকে এবং তিনি তার হস্তক্ষেপকে আমেরিকার প্রত্যাহারের ক্ষতিপূরণ প্রচেষ্টা হিসেবেই দেখেন।

কিন্তু শাহজাদা মোহাম্মদের সমালোচকরা বলেন, তার উত্থান এক অনাকাক্সিক্ষত ফলাফলের অনুশীলন। এ অস্পষ্ট তরুণ শাহজাদা যাকে ওয়াশিংটন নমনীয় মিত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিল। এখন তিনি একটি পরিবর্তনশীল অঞ্চলে আগুনের শিখায় বাতাস দিচ্ছেন। পররাষ্ট্র দফতরের সাবেক কর্মকর্তা ও ব্রæকিংস ইনস্টিটিউশনের ফেলো তামারা কফম্যান উইটস বলেন, এ ধরনের অত্যাধুনিক নজরদারি প্রযুক্তি, কমান্ডো ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে সশস্ত্র করে তুলে আমরা একটি ক্ষুদ্র ফ্রাংকেনস্টাইন তৈরি করেছি।

অধিকাংশ আরব রাজপরিবারের সদস্যরাই স্ফীতোদর, একঘেয়ে, অতিথিদের অপেক্ষা করিয়ে রাখেন। কিন্তু শাহজাদা মোহাম্মদ সে দলের নন। তিনি ১৮ বছর বয়সে স্যান্ডহার্স্টে ব্রিটিশ অফিসারদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে স্নাতক হন। তিনি মেদহীন ও শারীরিকভাবে ফিট। তার কাছে আসা দর্শনার্থীদের যথাসময়ে সাক্ষাত করেন এবং কোনো সভায় কখনো দেরিতে যান না।

আমেরিকার কর্মকর্তারা সবাই তাকে সংযতবাক, অনুসন্ধিৎসু, এমনকি বিনয়ী বলেন। তিনি নিজের কফি নিজে ঢেলে খান। আমেরিকার প্রতি তার ভালোবাসা প্রকাশ করেন। কোনো কোনো সময় অতিথিদের বলেন যে তিনি ছদ্মবেশে নাতিকে ডিজনি ওয়ার্ল্ডে নিয়ে গিয়েছিলেন।

তিনি নীচু পদের আমেরিকান কর্মকর্তাদেরও সময় দেন ও বিশিষ্ট অতিথিদের বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানান। লাজুক হাসি দিয়ে তিনি তাদের তার দেশ ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানান। তারপর অতিথিদের দুবাই ও আবুধাবির আকাশচুম্বী ভবন ও লেগুনগুলোর উপর দিয়ে উড়িয়ে নিতে হেলিকপ্টারে ওঠেন।

ইউএই-তে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্সেল ওয়াহবা বলেন, এম.বি.জেড.-এর বেলায় সবসময়ই মজাদার কোনো অভিজ্ঞতা হয়। রাজধানী আবুধাবিতে একটি নির্মাণ কর্মকান্ড তদারক করেছেন যা আগের উপক‚ল রেখাকে মনুষ্য-নির্মিত দ্বীপগুলোর আড়ালে রেখেছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ওয়ালস্ট্রিটের মত একটি আর্থিক জেলা। আরেকটির মধ্যে রয়েছে নিউইয়র্ক বিশ^বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। লুভরের মত একটি স্থাপনা ও গুগেনহেইম জাদুঘরের একটি পরিকল্পিত সম্প্রসারণ।

আমেরিকানদের সাথে যখন তিনি সাক্ষাত করেন। শাহজাদা মোহাম্মদ যে বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেন তা হল প্রতিবেশিদের চেয়ে ইউএই অধিক উদার রাষ্ট্র। নারীদের অধিক সুযোগ সুবিধা রয়েছে। মন্ত্রিসভার এক তৃতীয়াংশ নারী। সউদী আরব অনুমোদন না করলেও সংযুক্ত আরব আমিরাত সেদেশে খ্রিস্টানদের গির্জা, হিন্দুদের মন্দির ও শিখদের গুরদোয়ারা প্রতিষ্ঠা অনুমোদন করেছে। সেখানে কর্মরত বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের স্বার্থে তা করা হয়েছে। (দেশটির আনুমানিক ৯০ লাখ অধিবাসীন মধ্যে ১০ লাখেরও কম হচ্ছে সে দেশের নাগরিক, বাকিরা বিদেশী শ্রমিক।)

এ বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে শাহজাদা গত বছর সহনশীলতা মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং এ বছরকে সহনশীলতার বছর ঘোষণা করেছেন। তিনি বিশেষ অলিম্পিক আয়োজন করেন ও পোপ ফ্রান্সিসকে স্বাগত জানান। আফগানিস্তানে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর সাবেক কমান্ডার, বর্তমানে ব্রæকিংস ইনস্টিটিউশনের প্রেসিডেন্ট (মাঝে ইউএই-র প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা) জেনারেল জন আর. অ্যালেন বলেন, আমি মনে করি তিনি প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। আর তা শুধু অর্থনীতি বহুমুখী করণের জন্যই নয়, জনগণের চিন্তা ব্যবস্থার বহুমুখীকরণও বটে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত হচ্ছে নগর রাষ্ট্রগুলোর ক্ষুদ্র ফেডারেশন। তবে আবুধাবি একা বিশে^র প্রমাণিত তেল মজুদের ৬ শতাংশের অধিকারী। যা তাকে বিরাট প্রতিবেশি ইরানের লোভনীয় লক্ষ্যে পরিণত করেছে। ১৯৭১ সালে ইউএই যখন বাহরাইনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে সে সময় ইরানের শাহ পারস্য উপসাগরের তিনটি দ্বীপ দখল করে নেন।

৯০ বছর আগে মিসরে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম ব্রাদারহুড বহু আরব দেশে প্রধান রাজনৈতিক দল হয়ে দাঁড়ায়। এ বিষয়ে শাহজাদা মোহাম্মদ বলেন, তার ভীতি অনেক বেশি ব্যক্তিগত। তার বাবা এক বিখ্যাত ব্রাদারহুড সদস্য এজ্জেদিন ইবরাহিমকে ছেলের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করেন। তিনি তাকে মতবাদে দীক্ষিত করার চেষ্টা করেন যা বিপরীত ফল প্রদান করে।

শাহজাদা মোহাম্মদ ২০০৭ সালে সফররত আমেরিকান ক‚টনীতিকদের বলেন, আমি একজন আরব, আমি একজন মুসলমান, আমি নামাজ পড়ি। আমার বিশ^াস, এ মানুষগুলোর কোনো কর্মসূচি আছে। তিনি তার দেশের মানুষের কাছে ইসলামী রাজনীতির আবেদনের ব্যাপারে শঙ্কিত। উইলিকসের প্রকাশিত এক কেবল বার্তা অনুযায়ী এক সময় তিনি আমেরিকান ক‚টনীতিকদের বলেছিলেন, তার সেনাবাহিনীর ৮০ শতাংশই ‘মক্কার এক পবিত্র ব্যক্তি’র ডাকে সাড়া দেবে।

ক‚টনীতিকরা বলেন, এ কারণে শাহজাদা মোহাম্মদ অনেক দিন থেকে যুক্তি দিয়ে আসছেন যে আরব বিশ^ গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত নয়। কোনো নির্বাচন হলে ইসলামপন্থীরা জয়ী হবে। ২০০৭ সালে আমেরিকান কর্মকর্তাদের সাথে এক সভায় তিনি বলেন, যে কোনো মুসলিম দেশেই আপনি একই ফল দেখতে পাবেন। মধ্যপ্রাচ্য ক্যালিফোর্নিয়া নয়।

১৯৯১ সালে উপসাগর যুদ্ধকালে ইউএই দেশের অভ্যন্তরের ঘাঁটিগুলো থেকে আমেরিকান বাহিনীকে অভিযান চালানোর অনুমতি দেয়। তারপর থেকে শাহজাদার কমান্ডো ও বিমান বাহিনীকে আমেরিকানদের সাথে কসোভো, সোমালিয়া, আফগানিস্তান ও লিবিয়ায় মোতায়েন করা হয়।

তিনি তার সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো পরিচালনার জন্য আমেরিকান কমান্ডারদের নিয়োগ করেন। তিনি অন্য ২০১০ সালের আগের ৪ বছরে বাকি ৫ উপসাগরীয় দেশের সম্মিলিত সংগ্রহের চেয়ে নিজে বেশি অস্ত্র সংগ্রহ করেন। তার মধ্যে ছিল ৮০টি এফ-১৬ জঙ্গি বিমান, ৩০টি অ্যাপাচি জঙ্গি হেলিকপ্টার ও ৬২টি ফরাসি মিরেজ জেট।

কিছু মার্কিন কর্মকর্তা ইউএইকে ‘লিটল স্পার্টা’ নামে আখ্যায়িত করেছেন। সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জেমস ম্যাটিস ও জেনারেল অ্যালেনসহ সাবেক শীর্ষ সামরিক কমান্ডারদের পরামর্শ মোতাবেক শাহজাদা মোহাম্মদ এমনকি আমিরাতি প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তোলেন। এ শিল্প দ্য বিস্ট নামে একটি উভয়চর সাঁজোয়া যানসহ অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম নির্মাণ করে। যেগুলো ইতোমধ্যেই লিবিয়া ও মিসরের মত ক্রেতাদেশগুলোর কাছে বিক্রি করা হয়েছে।

আমিরাত বিদ্রোাহ দমনের জন্য নিচু দিয়ে উড়তে সক্ষম একটি প্রপেলার চালিত বোমারু বিমান তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছে। ম্যাটিস বহুদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এ বিমান তৈরির সুপারিশ করলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। শাহজাদা মোহাম্মদ প্রায়ই আমেরিকান কর্মর্তাদের বলতেন যে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুড ও ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলকে একজন মিত্র হিসেবে দেখেন।

ওয়াশিংটনে অনেকের কাছে শাহজাদা মোহাম্মদ এ অঞ্চলে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ বন্ধুতে পরিণত হয়েছেন। তিনি একজন দায়িত্বশীল অংশীদার যাকে লেবাননে ইরানি প্রভাব বিস্তার মোকাবেলা থেকে ইরাকে নির্মাণ কাজে অর্থায়ন পর্যন্ত সব কিছুতে তার উপর নির্ভর করা হয়। ইউএই-তে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত রিচার্ড জি. অলসন বলেন, এটা সুবিদিত যে আপনার যদি মধ্যপ্রাচ্যে কিছু করা প্রয়োজন মনে হয় তাহলে আমিরাতিরা তা করবে।

হোয়াইট হাউসের সহযোগীরা জানান, ২০০৯ সালে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর শাহজাদা মোহাম্মদ একজন সমচেতনার মানুষ খুঁজে পান। উভয়েই ছিলেন আলাদা, বিশ্লেষক ও বড় প্রশ্নের ব্যাপারে অনুসন্ধিৎসু। এক সময় ওবামা অন্য যে কোনো বিদেশী নেতার চেয়ে শাহজাদা মোহাম্মদের সাথে ফোনে বেশি কথা বলতেন বলে কয়েকজন উর্ধতন হোয়াইট হাউস কর্মকর্তা জানান।

কিন্তু তাদের মধ্যে আসে আরব বসন্ত। এ অঞ্চলে গণঅভ্যুত্থান ছড়িয়ে পড়ে। মুসলিম ব্রাদারহুড নির্বাচনে জয়ী হতে থাকে। ওবামা গণতন্ত্রের দাবি সমর্থন করেন বলেই মনে করা হয় যদিও সিরিয়ায়, যেখানে গণ অভ্যুত্থান আমিরাতের শত্রæর জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছিল, ওবামা সামরিক পদক্ষেপ এড়িয়ে যান। (চলবে)



 

Show all comments
  • Sajid Hussain ৯ জুন, ২০১৯, ১:২৪ এএম says : 0
    তথ্যবহুল লেখা, ধন্যবাদ ইনকিলাবকে
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammed Khan ৯ জুন, ২০১৯, ১:২৫ এএম says : 0
    বাংলাদেশের উচিত মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াকে নিয়ে মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্র বিকাশে কাজ করে যাওয়া।
    Total Reply(0) Reply
  • মাইন ৯ জুন, ২০১৯, ১:২৫ এএম says : 0
    লেখাটি পড়ে অকে কিছু জানতে পারলাম, ধন্যবাদ
    Total Reply(0) Reply
  • Monir mamun ৯ জুন, ২০১৯, ১:২৬ এএম says : 0
    মুসলিম বিশ্বের উচিত এখনেই সৌদির বিষয়ে চিন্তা করা। এরা জাস্ট আমেরিকা ও ইসরাইলের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। যে কোন ব্যক্তি বা দেশ এদের অন্যায় এর বিরুদ্ধে কথা বলে তারা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
    Total Reply(0) Reply
  • Monir mamun ৯ জুন, ২০১৯, ১:২৭ এএম says : 0
    Nice Write-up
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ