বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
ইসলামী শরীয়তের দলিল হলো চারটি। যথা: ১. আল কোরআনুল কারীম। ২. রাসূলুল্লাহ সা.-এর হাদিস। ৩. উম্মতে মুহাম্মাদিয়ার ইজমা বা ঐকমত্য। ৪. শরয়ী কিয়াস। (মিজানুল ইতিদাল : খন্ড ১, পৃ. ১৯)। এই দলিল চতুষ্টদয়ের মধ্য হতে আজ আমরা ইসলামী শরীয়তের দ্বিতীয় দলিল রাসূলুল্লাহ সা.-এর হাদিস সম্পর্কে আলোকপাত করতে প্রয়াস পাবো, ইনশাআল্লাহ।
বস্তুত রাসূলুল্লাহ সা.-এর উক্তি, কর্ম ও অনুমোদনসমূহকে হাদিস বলে। রাসূলুল্লাহ সা.-এর উক্তিকে কওলি (উক্তিমূলক) হাদিস এবং তার কর্মকে ফে’লি (কর্মমূলক) হাদিস এবং তার সামনে শরীয়তের অনুসারী কোনো মুসলমান কিছু করেছে অথবা তার অনুপস্থিতিতে কোনো কাজ করেছে, সে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সা. অবগত হয়েছেন, কিন্তু এর প্রতি বিরূপ মন্তব্য না করে সম্মতির লক্ষণ হিসেবে নীরবতা অবলম্বন করেছেন, তাকে তাকরিরী (মৌন সম্মতিমূলক/অনুমোদনমূলক) হাদিস বলে। (মিজানুল ইতিদাল : খন্ড ১, পৃ. ৯)।
তবে যে হাদিসের বর্ণনাকারীর সংখ্যা সকল যুগে এত অধিক যে, তাদেরকে মিথ্যা কোনো উক্তির ওপর একমত হওয়া অথবা তাদের সকল থেকে মিথ্যা প্রকাশ পাওয়া সম্ভব নয়, তাকে হাদিসে মুতাওয়াতির বা খবরে মুতাওয়াতির বলা হয়। (মিজানুল ইতিদাল : খন্ড ১, পৃ. ৯)। হাদিসে মুতাওয়াতির দ্বারা সুনিশ্চিত জ্ঞান লাভ হয়, যেমনটি কোরআনুল কারিম দ্বারা লাভ হয়ে থাকে। সুতরাং কোরআন মাজীদের অস্বীকারকারী যেমন কাফের, তেমনি মুতাওয়াতির হাদিস অস্বীকারকারীও কাফের ও অবিশ্বাসী। (কাশফুল আসরার : খন্ড ২, পৃ. ৬৮১; মিজানুল ইতিদাল : খন্ড ১, পৃ. ৯)।
আর যে হাদিস বর্ণনাকারীর সংখ্যা সকল স্তরে মুতাওয়াতিরের সমান নয়, কিন্তু কোনো স্তরে তিন হতে কম নয়, তাকে মশহুর হাদিস বা খবরে মশহুর বলে। (কাশফুল আসরার : খন্ড ২, পৃ. ৬৭৮)। খবরে মশহুর ও শরীয়তের দলিলের দ্বারা নিশ্চিত জ্ঞান লাভের দলিল। এর দ্বারা নিশ্চিত জ্ঞান লাভের পথ সহজতর হয়। খবরে মশহুর অস্বীকারকারীও ইসলাম থেকে খারিজ বলে বিবেচিত হবে।
আর যে হাদিসের বর্ণনাকারীর সংখ্যা যেকোনো স্তরে তিন থেকে কম হয়, তাকে খবরে ওয়াহিদ বলে। (কাওছারুন নবী সা. : পৃ. ৫)। খবরে ওয়াহিদের দ্বারা ধারণামূলক জ্ঞান (ইলমি যন্নি) অর্জিত হয়। (মিজানুল ইতদাল : খন্ড ১, পৃ. ৯)। প্রকৃতপক্ষে খবরে ওয়াহিদ শরীয়তের হুজ্জাতসমূহ থেকে একটি হুজ্জাত বা প্রমাণ। কেননা, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রাসূলুল্লাহ সা.-কে সম্বোধন করে নির্দেশ দিয়েছেন, ‘হে রাসূল, আপনার প্রভুর পক্ষ থেকে আপনার নিকট যে বাণী অবতীর্ণ করা হয়েছে তা পৌঁছে দিন।’ প্রসঙ্গত এ কথা সর্বজনবিদিত যে, হযরত মুহাম্মাদ সা. সমগ্র মানুষের প্রতি রাসূল হিসেবে আগমন করেছিলেন আর তার ওপর সকল মানুষের তাবলীগ ছিল অত্যন্ত সুকঠিন। কেননা, সকল মানুষের নিকট সরাসরি তাবলীগ রাসূল সা.-এর একার পক্ষে ছিল অসম্ভব। অনুরূপভাবে মুতাওয়াতির পদ্ধতিতে সকলের কাছে আল্লাহপাকের বাণী বা শরীয়তের বিধান পৌঁছানোও সম্ভব ছিল না, সে জন্য অবস্থাভেদে খবরে ওয়াহিদের ওপর আস্থা স্থাপন করা অপরিহার্য ছিল। (ফাতহুল বারী : খন্ড ১৩, পৃ. ২৯২)।
এ পর্যায়ে স্মরণ রাখা দরকার যে, কোরআনুল কারিমে যে ‘যন্ন’ বা ধারণার অনুসরণ করা হতে বারণ করা হয়েছে, তা এমন ধারণামূলক জ্ঞান, যার পেছনে কোনো দলিল-প্রমাণ নেই। যেমন- সূরা বাকারাহর ৪৬ নম্বর আয়াত এবং সূরা সোয়াদের ২৪ নং আয়াতে এজাতীয় যন্নের বা ধারণার কথা তুলে ধরা হয়েছে। আর খবরে ওয়াহিদ এমন ‘যন্ন’ বা ধারণামূলক জ্ঞান দান করে, যার ইতিবাচক দিকটি অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। যাতে যন্নে গালিব বা সুস্পষ্ট ধারণা বলা হয়। সুতরাং আল কোরআনের এমন আয়াত দ্বারা খবরে ওয়াহিদ হুজ্জাত নয় বলে মনে করা বা দাবি করা সম্পূর্ণই ভুল ও বাতিল। মোটকথা, খবরে ওয়াহিদের মুনকির বা অস্বীকারকারীকে কাফের বলা না গেলেও তাকে পথভ্রষ্ট, ফাসিক ও ফাজির অবশ্যই বলা যাবে। (শরহে আকায়েদ সিফারানিয়াহ : খন্ড ১, পৃ. ১৯)।
আর এ কথাও সত্য যে, রাসূলুল্লাহ সা.-এর যুগে অনেক সাহাবির নিকট হাদিস লিখিত আকারে সংরক্ষিত ছিল। যেমন হযরত আলী রা., ইবনে আব্বাস রা., জাবির রা., আনাস রা., আমর বিন হিসাম রা., আবু হুরাইরাহ রা., আব্দুল্লাহ বিন আমর রা., আব্দুল্লাহ বিন ওমার রা. প্রমুখ সাহাবাদের নিকট লিখিত রূপে হাদিস মজুদ ছিল। এ হাদিসগুলো পরবর্তীকালে জনগণের নিকট খবরে ওয়াহিদের পদ্ধতিতেই হস্তগত হয়েছে। (সহিহ বুখারী : খন্ড ১, পৃ. ২৮; সহীহ মুসলিম : খন্ড ১, পৃ. ৪৯৫)।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।