বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে তিনজন সাধক প্রচারকের মালাবারের হিন্দু রাজার দরবারে গমন এবং তার কাছে রাসূলুল্লাহ (সা.) কর্তৃক চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়ার ঘটনা এবং রাজার ইসলাম গ্রহণের অপূর্ব কাহিনী তুলে ধরছি। বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থে ঘটনাটি বিভিন্নভাবে উল্লেখিত হলেও এখানে আমরা বিখ্যাত গ্রন্থ ‘তোহফাতুল মোজাহিদীনে’র বরাতে বর্ণিত তথ্যাবলির আলোকে ঘটনাটি আমাদের আলোচ্য বিষয়। হিজরী দ্বিতীয় শতকে কয়েকজন ইসলাম প্রচারক, বুজর্গ-সাধক হিন্দুস্থানে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আগমন করেছিলেন। তাদের উদ্যোগ প্রচেষ্টার বিবরণ এই :
শেখ শরীফ ইবনে মালেক, ভ্রাতা মালেক ইবনে দীনার, তাদের ভ্রাতুষ্পুত্র মালেক ইবনে হাবীব এবং তাদের অন্য কয়েকজন সঙ্গী সিংহল দ্বীপে অবস্থিত ‘আদম দুর্গ’ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। পথে ‘কারাঙ্গানূর’ নামক স্থানে অবতরণ করেন। তাদের আগমনের খবর যখন মালাবারের রাজার কাছে পৌঁছে তখন তিনি তাদের সকলকে তলব করেন। তারা যখন পৌঁছেন, তখন রাজা তাদের স্বাগত জানান এবং আদরযত্ম করেন।
শেখ শরীফ রাজার এ উত্তম আচার-ব্যবহারে সাহসী হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)- এর অবস্থা ও ঘটনাবলি রাজার নিকট তুলে ধরেন এবং ইসলামের আরকান ও তার বাস্তবতা রাজাকে বুঝিয়ে বলেন। এতদ্ব্যতীত ‘শক্কুল কামার’ (চাঁদ দ্বিখন্ডিত হওয়ার) মোজেযার স্বরূপ বর্ণনা করেন। এসব কথা প্রচারের ফলে রাজার অন্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রিসালতের ওপর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে। তাঁর প্রতি মোহাব্বত-ভালোবাসায় তার বুক আলোকিত হয়ে ওঠে এবং তাঁর প্রতি সততার সাথে ঈমান আনেন। উল্লেখ্য, এ বর্ণনায় রাজার নামটি উল্লেখ নেই এবং ঘটনাটি ভিন্নভাবে নামসহ অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে।
রাজার ইসলাম গ্রহণের পর শেখ শরীফ যখন রাজার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে চান, তখন তিনি তাগিদ করে তাকে বললেন, ‘আদম দুর্গ জিরায়ত শেষে তিনি যেন স্বীয় সঙ্গীসহ ‘কারাঙ্গানূরে’ ফিরে আসেন। আমি আপনাদের সঙ্গে মক্কা মোয়াজ্জমায় হজ করতে এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারতের উদ্দেশ্যে অবশ্যই আরবে গমন করব।’ রাজা তাদের এ কথাও বুঝিয়ে দেন যে, ‘আমার এ ইচ্ছার কথা মালাবারের কোনো লোকের নিকট প্রকাশ করবেন না।’
যখন শেখ শরীফ এবং তার সঙ্গীগণ হারমাইন শরীফ জিয়ারত শেষে দ্বিতীয়বার কারাঙ্গানূরে প্রত্যাবর্তন করেন, তখন রাজাও সব লোকের সঙ্গে জাহাজে আরোহণ করে আরবে রওনা হন এবং সাম্রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব তার এক নায়েবের ওপর অর্পণ করে যান। মক্কা ও মদীনায় কিছু দিন অবস্থান করার পর তিনি এই উদ্দেশ্যে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন যে, সেখানে গিয়ে তিনি ইচ্ছেমতো ইসলামের তবলীগ প্রচারে আত্মনিয়োগ করবেন এবং স্থানে স্থানে মসজিদ নির্মাণ করবেন।
কিন্তু পথেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এ রোগেই তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুর পূর্বে শেষ অবস্থায় রাজা নিজের সঙ্গীদের ওসিয়ত করে যান যে, ‘মালাবারে দ্বীনে হকের প্রচারের জন্য তিনি যে দৃঢ় সংকল্প করেছিলেন তা যেন কোনো অবস্থাতেই মুলতবি হয়ে না যায়, তোমরা সেখানে ঘরে ঘরে গিয়ে লোকদের খোদার বাণী পৌঁছে দেবে।’ এ উদ্দেশ্যে রাজা এক খানা জোরালো পত্রও তার নায়েবের নামে লিখে শেখ শরীফের হাতে প্রদান করেন।
শেখ শরীফ ও তাঁর সঙ্গীরা চিঠিখানাসহ কারাঙ্গানূরে আসেন এবং রাজার নায়েবের নিকট হস্তান্তর করেন। নায়েব চিঠিখানা পাঠ করার পর কয়েকটি ভূমিখন্ড এবং দু-চারটি বাগান শেখ শরীফ ও তার সঙ্গীদের প্রদান করেন, যাতে তারা সেখানে বসবাস করতে পারেন এবং বাগানের আয় দ্বারা নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন। রাজা তাদের সাম্রাজ্যের সর্বত্র ঘুরে ঘুরে তবলীগ করার এবং সকল স্থানে মসজিদ নির্মাণের অনুমতি প্রদান করেন।
মালেক ইবনে দীনার কারাঙ্গানূরে তার বসবাসের জন্য বাড়িঘর নির্মাণ করেন। সেখানে তিনি একটি মসজিদ নির্মাণ করেন এবং স্থায়ীভাবে অবস্থান করতে মনস্থ করেন। এছাড়াও তিনি সেখানে স্থানীয়ভাবে ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন।
ইবনে দীনারের ভ্রাতুষ্পুত্র মালেক ইবনে হাবীব কিছুদিন পর কারাঙ্গানূরে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। অতঃপর প্রতিটি স্থানে মসজিদ নির্মাণের জন্য কারাঙ্গানূর হতে যাত্রা করেন। তিনি প্রথমে ‘কুলিন’ শহরে পৌঁছেন, সেখানে তার পরিবারবর্গের বসবাসের ব্যবস্থা করেন এবং একটি মসজিদ কায়েম করেন। এর পর ‘হুবাই মুবাদি’ শহরে যান। সেখানে তিনি কিছু কিছু লোককে মুসলমান করেন এবং মসজিদ নির্মাণ করে, একটির পর একটি শহরের দিকে রওনা হন এবং সেখানে তবলীগ করেন, তাছাড়া লোকদের মুসলমান করার পর সেখানেও বহু মসজিদ কায়েম করতে থাকেন।
অতঃপর হুবাই মুবাদিতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং সেখানে তিন মাস অবস্থানকালে তবলীগ অব্যাহত রাখেন। ফের সেখান থেকে রওনা হয়ে ‘জারাফাতান’, ‘দারাফাতান’, ফিন্দারিয়া’ এবং ‘শালিয়াতে’র শহরগুলোতে গমন করেন এবং ঐ সব শহরে তবলীগের পর বহু মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। শালিয়াতে তিনি পাঁচ মাস অবস্থানকালে তবলীগ করেন।
অতঃপর মালেক ইবনে হাবীব কারাঙ্গানূরে অবস্থানকারী তার চাচা মালেক ইবনে দীনারের নিকট প্রত্যাবর্তন করেন, যাতে নতুন রাজার সাথে সাক্ষাৎ করে নির্মিত মসজিদগুলোর ওয়াক্ফ ইত্যাদির ব্যবস্থা করা যায়। রাজার ফরমান ইত্যাদি লাভ করে তিনি আবার এক দীর্ঘ সফরে বের হন এবং সমস্ত মসজিদের উপযুক্ত দেখভালের ব্যবস্থা করে কারাঙ্গানূরে ফিরে আসেন। এবার তার অন্তর খোদার রহমত এবং তার করুণা অনুগ্রহের জন্য শোকর আদায় করেন। কেননা সেখানে অতীতে ব্যাপকভাবে মূর্তিপূজা চালু ছিল।
অতঃপর মালেক ইবনে দীনার ও মালেক ইবনে হাবীব তাদের সংশ্লিষ্ট সঙ্গীদের নিয়ে কুলিন শহরে চলে আসেন। সেখানে মালেক ইবনে হাবীব স্থায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করেন। কিন্তু মালেক ইবনে দীনার তার স্বদেশ খোরাসানে চলে যান। পরবর্তীকালে ইবনে হাবীব তার ছেলেদের কুলিনে পুনর্বাসিত করেন এবং তিনি স্ত্রীসহ কারাঙ্গানূরে চলে আসেন এবং সেখানে স্বামী-স্ত্রী উভয় ইন্তেকাল করেন।
মালাবারের হিন্দু রাজার দরবারে খোরাসানের প্রচারক দলের ইসলাম প্রচারের ফলে রাজার মুসলমান হয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে গোটা মালাবার রাজ্যে ইসলামের আলো বিকশিত হওয়ার ঘটনা ইসলামী ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।