বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শবে বরাত-৩
সুনানে ইবনে মাজায় বর্ণিত হয়েছে : হযরত আলী ইবনে আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
চলছে মাহে রমজান। সমগ্র পৃথিবীর মানুষ আল্লাহকে খুশি করার জন্য রোজা রাখছেন। রোজা রেখেই মানুষ বুঝতে পারেন, আল্লাহ আমাদের কি নেয়ামত দিয়েছেন। রোজা রেখেই আমরা বুঝতে পারি পানির মূল্য। উপলব্ধি করতে পারি খাদ্যের কদর। এ উপলব্ধির সত্যিকার স্ফুরণ ঘটে ইফতারকালে। তাই ইফতারের সময়টা শুকর ও কৃতজ্ঞতায় আনত হওয়ার সময়। এ সময় প্রাণখুলে শুকর আদায় করা চাই।
ভক্তি-রসে স্নাতকণ্ঠে বলে ওঠা চাই, ‘হে আল্লাহ! তোমারই সব প্রশংসা। তোমাকেই জানাই সব কৃতজ্ঞতা। হে আল্লাহ! তোমারই জন্য রোজা রেখেছি, তোমারই ওপর নির্ভর করেছি এবং তোমারই দেয়া রিজিক দ্বারা ইফতার করেছি। তোমার দেয়া নিয়ামতে ঘুচে গেছে সারা দিনের সব ক্লান্তি। নিবারণ হয়েছে ক্ষুধা-পিপাসা। দেহমনে ছেয়ে গেছে শান্তি ও প্রশান্তি। হে আল্লাহ! পিপাসা মিটে গেছে, শিরাগুলো সিঞ্চিত হয়েছে আর ইনশাআল্লাহ সওয়াব তো আছেই।’
এভাবে টানা এক মাস চলে নিয়ামতের মূল্য বোঝা ও শুকর আদায়ের প্রশিক্ষণ। দিনের বেলা পানাহার বর্জন করে ক্ষুধা-পিপাসার কষ্টভোগ ও সেই কষ্টভোগের মাধ্যমে জীবনের জন্য খাদ্য-পানীয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব, পরিশেষে ইফতার করে ক্ষুধা-পিপাসার কষ্ট নিবারণ ও তা নিবারণের মাধ্যমে খাদ্য-পানীয়ের মহিমা হৃদয়ঙ্গম- এ ধারাতেই রোজাদারের মন শুকরগোজারির অনুপ্রেরণা পায় এবং শুকরের ভাষা হৃদয়-মন ছাপিয়ে চোখে-মুখে বাঙময় হয়ে ওঠে।
টানা এক মাস এবং মাত্র এক মাস। মাসের শেষ দিকেই শরীর জবাব দিতে শুরু করে দেয়। তারপর আরো রোজা হলে বড় কষ্ট হতো। দয়াময় আল্লাহ সে কষ্ট হতে বান্দাকে মুক্তি দিয়েছেন। এমনকি মাসের ভেতরেও যদি কষ্ট সীমা ছাড়িয়ে যায় অর্থাৎ অসুস্থতা, বার্ধক্য বা অতিরিক্ত দুর্বলতার কারণে রোজা রাখা সম্ভব না হয় তবে রোজা রাখার ফজিলত থেকে বান্দা যাতে বঞ্চিত না হয়, সে সুযোগও রাখা হয়েছে। কাজা বা ফিদয়ার সে সুবিধাও তাঁর আরেক নিয়ামত।
কৃতজ্ঞতাবোধকে বিকশিত করে তোলার এও আরেক সুযোগ। অপারগতার ক্ষেত্রে রমজানের রোজার যদি কোনো বিকল্প না থাকত, তবে বান্দা পেত কি মননশীলতা চর্চার এ সুযোগ? কিংবা যদি সারা বছরই থাকত রোজা, তবে অখন্ড চর্চায় সম্ভব হতো কি নিজেকে জুড়ে রাখা? সুতরাং বান্দা, শুকর আদায় করো আল্লাহ প্রদত্ত এ সুবিধার জন্য। শুকরগোজারিই এ সুবিধার লক্ষ্য। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তোমাদের পক্ষে যা সহজ সেটাই করতে চান। তোমাদের জন্য জটিলতা সৃষ্টি করতে চান না, যাতে তোমরা রোযার সংখ্যা পূরণ করে নাও এবং আল্লাহ তোমাদেরকে যে পথ দেখিয়েছেন সেজন্য আল্লাহর তাকবির পাঠ করো এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো। (সূরা বাকারা : আয়াত ১৮৫)।
রমজানের পর রোজা ফরজ না থাকার ফলে রোজার অন্যান্য শিক্ষার সাথে শুকরগোজারির শিক্ষাকেও কাজে লাগানোর সুযোগ লাভ হয়েছে। যখনই পিপাসা তখনই পানি পান এবং যখনই খিদে তখনই খাদ্যগ্রহণ করতে পারার ফলে অন্তরে এই কৃতজ্ঞতাবোধ জাগ্রত হতে পারে যে, ইয়া আল্লাহ! জীবন রক্ষা ও দেহমনে শক্তি জোগানোর এই যে আয়োজন, এ তো তোমারই দান। রোজা রাখিয়ে তুমি বুঝিয়ে দিয়েছ, তোমার এ দান কত মূল্যবান এবং কত প্রয়োজনীয়!
সেই মহামূল্যবান নিয়ামত আবার এই দিনগুলোতে করে দিয়েছ অবারিত। এখন যখনই ইচ্ছা ও যখনই প্রয়োজন তা ভোগ করতে পারছি। নেই পরিমিত চাহিদা দমনের চাপ, নেই প্রয়োজন পূরণে বারণ-বাধা। কতই না অনুগ্রহ তোমার। সুতরাং এভাবে রমজানে রোজা রাখার দ্বারা পানাহার সামগ্রীর নিয়ামত বোঝা ও তার শুকর আদায়ের যে সবক ও প্রশিক্ষণ লাভ হয়েছে, তার বদৌলতে সারা বছরই বান্দা এ নিয়ামতের জন্য শুকরগোজার হয়ে চলতে পারে।
সেই সঙ্গে অপরাপর নিয়ামতের জন্যও। কেননা এক নিয়ামত তো অন্য নিয়ামতেরও স্মারক। রোজা রাখার সাথে সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গসহ শারীরিক সুস্থতা, জানমালের নিরাপত্তা, দারা-পরিবার সবার পারস্পরিক সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, মোটকথা শান্তিপূর্ণ জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুরই সম্পর্ক রয়েছে। আর আল্লাহ তায়ালা যেহেতু নিজ দয়ায় এসব কিছুর ব্যবস্থা করেছেন তখন রোজার মাধ্যমে যে কৃতজ্ঞতাবোধের উন্মেষ ও বিকাশ নিজ চরিত্রে সাধিত হয়ে যায়, সকল ক্ষেত্রেই তার স্বাক্ষর রাখা সম্ভব হয়ে ওঠে।
কিন্তু বান্দা সে সম্ভাবনাকে কাজে লাগায় কি? কিংবা ঠিক কতজন তা কাজে লাগায়? আল্লাহ তায়ালা আক্ষেপের ভাষায় বলেন, ‘আমার শুকরগোজার বান্দা বড় কম। হে আল্লাহ! বোঝা যাচ্ছে কম হলেও তোমার শুকরগোজার বান্দা বাস্তবে আছে। তুমি নিজ দয়ায় আমাদেরকেও সেই অল্পসংখ্যকদের কাতারভুক্ত করে নাও।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।