Inqilab Logo

শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

ভূমধ্যসাগরে মরণযাত্রা

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ১৪ মে, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

বাংলাদেশ থেকে ভারত। ভারত থেকে শ্রীলংকা অথবা দুবাই হয়ে লিবিয়া। লিবিয়া থেকে সাগর পেরোলেই ইতালি। ইউরোপের দেশ ইতালিতে কাজের কোনো অভাব নেই। মাস শেষে লাখ লাখ টাকা ইনকাম। তুলনামূক অল্প খরচে ইউরোপে পাড়ি জমানোর এমন প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে কর্মী পাঠাচ্ছে দালালচক্র। ঢাকার গুলিস্তান ও ফকিরেরপুলে অফিস নিয়ে চুটিয়ে ব্যবসা করলেও সব সময় এরা থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। দুর্ঘটনা ঘটলেই এরা গাঢাকা দেয়। মৃত্যুর দায় কেউ নেয় না।
গত শুক্রবার লিবিয়া থেকে সাগরপথে ইতালি যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরে ডুবে মারা গেছে ৩৭ বাংলাদেশি তরুণ। উদ্ধার হয়েছে আরও ১৪ বাংলাদেশি। নিহত ৩৭ জনের মধ্যে চারজন সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের একই পরিবারের সদস্য। সিলেটের ইয়াহিয়া ওভারসিজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনপ্রতি আট লাখ টাকায় তারা ইতালি যেতে চেয়েছিল। দালালের সহায়তায় তারা মাস ছয়েক আগে ভারত যান। সেখান থেকে শ্রীলংকা ও দুবাই হয়ে লিবিয়া যান। ভূমধ্যসাগরের সেই মরণযাত্রা থেকে ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছেন বাংলাদেশের আহমেদ বেলাল। এএফপির কাছে তিনি সেই ভয়ঙ্কর যাত্রার বর্ণনা দিয়েছেন। বেলাল জানান, ভূমধ্যসাগরে যাত্রা শুরু হয় বড় বোট দিয়ে। এক পর্যায়ে বড় বোট থেকে ছোট একটি প্লাস্টিকের বোটে তোলা হয় ৭৫ জন অভিবাসীকে। বোটটি এতই ছোট ছিল যে, একসঙ্গে এত মানুষের স্থান সংকুলান হচ্ছিল না তাতে। গাদাগাদি করে তাতেই উঠতে হয় বেলালদের।
বেলালের ভাষায়, বোটে ওঠার মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে প্রচন্ড ঢেউয়ের আঘাতে ডুবে যায় এটি। আর চোখের সামনে একে একে মানুষ নির্মমভাবে মরতে থাকে। বেলালেরও ঠান্ডা পানিতে ডুবে মরার উপক্রম হয়েছিল। তবে ঠিক তখনই একটি জেলে নৌকা তাদেরকে উদ্ধারে এগিয়ে আসে। জেলে নৌকায় উঠে এ যাত্রায় কোনোমতে নিজের প্রাণ বাঁচিয়েছেন বেলাল। তবে বোটে থাকা বেশির ভাগেরই ভাগ্য সহায় হয়নি। জেলেরা মাত্র ১৬ জনকে জীবিত উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। বেলাল তাদের মধ্যে একজন। কিন্তু সাগরে ডুবে মরতে হয়েছে বাকি ৬০ অভিবাসীর। সাহায্যের জন্য করুণ আকুতি তখন সমুদ্রপৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়েছে। দূরে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এসেছে সেই আহাজারি। কিন্তু শূন্য সমুদ্রে তাকিয়ে স্বজনের মৃত্যু দেখা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না ৩০ বছর বয়সী বেলালের। এমন মৃত্যু আর ভয়াবহতা দেখে তিনি চিৎকার শুরু করেছিলেন। বলেন, বয়সে ছোট আমার দুই নিকট আত্মীয় পানিতে হারিয়ে গেল। তাকিয়ে দেখলাম আর চিৎকার করলাম। কান্না থামাতে পারছিলাম না কোনোভাবেই।
সেই ভয়াবহ দৃশ্যকে কোনোভাবেই ভুলতে পারছেন না বেলাল। এখনো হাউমাউ করে কাঁদছেন তিনি। মৃত্যুবিভীষিকা তার বুকে সৃষ্টি করেছে এক আতঙ্ক।
বেলাল বলেছেন, ৬ মাস আগে থেকে তার ইউরোপ যাত্রার মিশন শুরু হয়েছিল। অন্য তিনজনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি চলে যান দুবাইয়ে। সেখান থেকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে। ইস্তাম্বুল থেকে তারা একটি ফ্লাইটে করে চলে যান লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপোলি। বেলাল বলেন, সেখানে আরো প্রায় ৮০ জন বাংলাদেশির সঙ্গে যোগ দেই আমরা। আমাদেরকে তিন মাস লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে একটি রুমে আটকে রাখা হয়েছিল। এ অবস্থায় মনে হয়েছিল, ওই লিবিয়াতেই বুঝি মারা যাবো। দিনে মাত্র একবার আমাদেরকে খাবার দেয়া হতো। তাও পরিমাণে কম। এই ৮০ জন মানুষের ব্যবহারের জন্য ছিল মাত্র একটি টয়লেট। আমরা গোসল করতে পারতাম না। পারতাম শুধু মুখ ধুতে। দিন-রাত শুধু কাঁদতাম আমরা। খাবার চেয়ে কান্নাকাটি করতাম।
বেলাল যখন বাড়ি ছাড়েন তখন আন্দাজ করতে পারেন নি এই সফরের পরিণতি কি হতে পারে। সিলেটে থাকা অবস্থায় তিনি দেখেছেন বহু মানুষ ইউরোপে বসবাস করছেন। তারা উন্নত জীবনযাপন করছেন। তা দেখে তিনি প্রলুব্ধ হয়েছিলেন। তাই জমি বিক্রি করেছেন। ‘গুড লাক’ ডাকনামের এক বাংলাদেশি পাচারকারীর হাতে এই সফরের জন্য দুই সন্তানের জনক বেলাল তুলে দিয়েছেন প্রায় ৭ হাজার ডলার। তিনি বলেন, ওই পাচারকারী বলেছিল, আমার জীবন উন্নত হবে। সব পাল্টে যাবে। আমরা তাই বিশ্বাস করেছিলাম। আমি নিশ্চিত তিনি এই পথে যত মানুষ পাঠিয়েছেন তার বেশির ভাগই মারা গেছেন।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) এর দৃষ্টিতে লিবিয়া থেকে ইউরোপে যাওয়ার ভূমধ্যসাগরীয় রুটটি সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওই পথ দিয়ে ইতালিতে পৌঁছার চেষ্টা করেছেন-এমন প্রতি ৫০ জনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে। ভূমধ্যসাগরের ওই রুটে যাত্রাকে অনেকেই মরণযাত্রা বলে অবিহিত করেছেন। কিন্তু তারপরেও থামছে না সেই যাত্রা।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এবং জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের হিসাবে গত কয়েক বছরে অন্তত কয়েকশ› বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে ভূমধ্যসাগরে ডুবে। তারা অবৈধভাবে ইউরোপ প্রবেশের চেষ্টা করেছিলেন। ইন্টারনেটে পাওয়া ইউএনএইচসিআরের তথ্যানুযায়ী, গত এক দশকে অন্তত এক লাখ বাংলাদেশি ইউরোপে আশ্রয় চেয়েছেন। শুধু ২০১৫ সালেই আশ্রয়ের আবেদন করেন ১৮ হাজার বাংলাদেশি। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান, লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাকের সঙ্গে বাংলাদেশি নাগরিকরাও অবৈধ পথে ইউরোপ যাচ্ছেন।
আইওএমের ২০১৭ সালের একটি জরিপে দেখা গেছে, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি ঢোকার চেষ্টা করছে যেসব দেশের নাগরিক, তার শীর্ষ পাঁচে রয়েছে বাংলাদেশ। গত বছরের জুনে প্রকাশিত ইউরোপীয় পরিসংখ্যান দপ্তর ইউরোস্ট্যাটের হিসাব অনুযায়ী, অবৈধভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) প্রবেশ করা নাগরিকের সংখ্যা বিচারে বাংলাদেশের অবস্থান ৩০টি দেশের মধ্যে ১৬তম। ২০০৮ সাল থেকে সেখানে অবৈধভাবে গেছেন ১ লাখ ৪ হাজার ৫৭৫ বাংলাদেশি। ২০০৮ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ৯৩ হাজার ৪৩৫ জন বাংলাদেশি অবৈধ অনুপ্রবেশ করেছেন। ২০১৬ সালে অনুপ্রবেশ করেছেন ১০ হাজার ৩৭৫ জন। চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সংখ্যাটি সোয়া থেকে দেড় লাখে দাঁড়িয়েছে বলে ধারণা করা হয়। ইউরোপ থেকে তাদের তাড়াতে ১২ মিলিয়ন ইউরো বরাদ্দ করেছে ইইউ। ব্র্যাক মাইগ্রেশনের তথ্য বলছে, গত এক দশকে ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে ভূমধ্যসাগরে ডুবে। কিন্তু ১৯ লাখ মানুষ ইউরোপ প্রবেশ করতে পেরেছে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে বেকারত্ব, বৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার সুযোগ কমে যাওয়া এবং ইউরোপের মোহে তরুণরা অনেক সময় ডিঙি নৌকায়ও ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করে না। দালালরা তরুণদের এ স্বপ্নকে পুঁজি করে পাতছেন প্রতারণার ফাঁদ। বিদেশে বাংলাদেশিদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ দিন দিন কমে যাওয়াকে অবৈধ পথে তরুণদের পা বাড়ানোর একটি কারণ বলে মনে করা হয়। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ থেকে ১০ লাখ আট হাজার কর্মী বিদেশ যান। পরের বছর যান সাত লাখ ৩৪ হাজার। চলতি বছরেরও জনশক্তি রফতানি নিম্নমুখী। সউদী আরব, ওমান ও কাতার ছাড়া আর কোনো দেশে বড় সংখ্যায় বাংলাদেশি কর্মীরা যেতে পারছেন না। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ প্রায় আট মাস। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাজার বন্ধ প্রায় অর্ধ যুগ।
বাংলাদেশি শ্রমিকদের জন্য বরাবরই ইউরোপের শ্রমবাজারে প্রবেশাধিকার নেই। তার পরও ২০১৪ সাল পর্যন্ত ইতালিতে সংখ্যায় কম হলেও বাংলাদেশি শ্রমিকরা যেতে পারতেন। ২০০৭ সালে দেশটিতে ১০ হাজার ৯৫০ কর্মী যেতে পেরেছিলেন। কিন্তু গত দুই বছরে একজন কর্মীও যেতে পারেননি। যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য দেশেও বাংলাদেশিদের জন্য শিক্ষা ভিসার সুযোগ একেবারেই সীমিত হয়ে গেছে। এ কারণে অবৈধ অভিবাসন বেড়েছে বলে মনে করছেন জনশক্তি সংশ্নিষ্টরা।
দালালচক্র সক্রিয়
কম টাকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্ন যারা দেখান সেই দালালচক্র ঢাকা, সিলেটসহ সারাদেশেই সক্রিয়। ঢাকার গুলিস্তান ও ফকিরেরপুলে অফিস নিয়ে তারা চুটিয়ে ব্যবসা করছে। ইউরোপের পাঠানোর কথা বলে এরা ফ্রি ভিসায় তরুণদের প্রথমে ভারত, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, দুবাই নিয়ে যায়। সেখান থেকে লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগরে মরণযাত্রার যাত্রী করে উচ্চভিলাসী তরুণদের। ঢাকার দালালচক্রের একজন সদস্য জানান, ফ্রি ভিসায় বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন পার করার জন্য আগে থেকে কন্ট্রাক করা থাকে। জনপ্রতি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে পার করতে হয়। অন্যথায় ইমিগ্রেশন আটকে দেয়। গুলিস্তানে অফিসের মাধ্যমে এমনিভাবে প্রতি সপ্তাহে তরুণদের বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। এর মধ্যে অনেকেরই খোঁজ নেই বহুদিন ধরে। আবার কেউ কেউ ইউরোপে গিয়ে বেশ ভালই আছে। জানা গেছে, চিহ্নিত দালালচক্রের বিরুদ্ধে মতিঝিল ও পল্টন থানায় অনেক জিডি আছে। সঠিক তদন্তের অভাবে সেগুলোর নেপথ্যের ঘটনা আলোর মুখ দেখে না।



 

Show all comments
  • KM Abdullah ১৪ মে, ২০১৯, ১২:৫৪ এএম says : 0
    এইসবে করে কেউ সাগর পাড়ি দিতে পারে? এসব দালাল চক্রের কাজ। টাকা নিয়ে মাঝ খানে গিয়ে নৌকা ডুবিয়ে দেয়
    Total Reply(0) Reply
  • Pritish Sarkar ১৪ মে, ২০১৯, ১২:৫৪ এএম says : 0
    আর বিদেশে কষ্ট করতে হবে না
    Total Reply(0) Reply
  • Sabujlan Ropu ১৪ মে, ২০১৯, ১২:৫৫ এএম says : 0
    খুবই ভালো লাগছে চমত্কার খবর এটা তো নতুন কিছু নয় আমি আপনে কেন যাই এটা তো দালালদের কোন দোষ নাই যারা বেশি লোভ করে তাহলে এই ভাবে মারা যায
    Total Reply(0) Reply
  • Md Miaraz Sheikh ১৪ মে, ২০১৯, ১২:৫৫ এএম says : 0
    ইস কস্ট পেলাম
    Total Reply(0) Reply
  • Aminul Islam Mamun ১৪ মে, ২০১৯, ১২:৫৫ এএম says : 0
    অভাব,অতৃপ্তি আর অসন্তোষের গল্প.
    Total Reply(0) Reply
  • Rafi Ahmed Rafi Ahmed ১৪ মে, ২০১৯, ১২:৫৫ এএম says : 0
    জীবন কে বাজি লাগানো ঠিক না। একটি জীবনের রয়েছে অনেক আসতা ভালো বাসা
    Total Reply(0) Reply
  • Rafiul Islam Ranak ১৪ মে, ২০১৯, ১২:৫৫ এএম says : 0
    তারপরও থামবে না
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammad Munna ১৪ মে, ২০১৯, ১২:৫৬ এএম says : 0
    karap lagteca
    Total Reply(0) Reply
  • MD Majedul Islam ১৪ মে, ২০১৯, ১২:৫৬ এএম says : 0
    হাইরে জীবন
    Total Reply(0) Reply
  • MD Jibon Ahmed ১৪ মে, ২০১৯, ১২:৫৬ এএম says : 0
    allah tader k jannat basi koren Amin
    Total Reply(0) Reply
  • Mohammad Abu Musa ১৪ মে, ২০১৯, ১২:৫৭ এএম says : 0
    ‌লো‌ভে পাপ, পা‌পে মৃত্যু! নি‌জেরাই দায়ী
    Total Reply(0) Reply
  • Najir ahammed ১৪ মে, ২০১৯, ৯:৪০ এএম says : 0
    এই ঘটনা থেকে আমাদের সকলের শিক্ষা নেয়া উচিত।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাংলাদেশ


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ